Wednesday, January 8

সিলেটের প্রখ্যাত শায়খুল হাদিস আল্লামা মুকাদ্দাস আলী আর নেই


রহমত আলী হেলালী:

জীবদ্দশায় একাধারে দীর্ঘ ৬৯ বছর বুখারী শরীফের শিক্ষাদানের বিরল দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী শায়খুল হাদীস আল্লামা মুকাদ্দাস আলী ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লা ওয়াইন্নাইলাহি রাজিউন। আজ বুধবার (০৮ জানুয়ারী) সকাল ৮ টায় তার নিজ বাড়ি জকিগঞ্জ উপজেলার সোনাসার এলাকার বারগাত্তা গ্রামের বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তিনি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বারগাত্তা গ্রামে ১৩৪০ বাংলার ২০ চৈত্র আনুমানিক ১৯৩৩ সালের জন্ম গ্রহণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।

মরহুমের জানাযার নামাজ আজ বুধবার (৮ জানুয়ারী) বিকাল সাড়ে ৪ টায় তার নিজ গ্রামের পার্শ্ববর্তী সোনাসার বাসষ্টেশনের পূর্ব মাঠে অনুষ্ঠিত হবে।

তার মৃত্যুতে পুরো সিলেটজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সিলেটের প্রবাদপুরুষ ‘মাটিয়া ফেরেশতা’ নামে খ্যাত শায়খুল হাদিস আল্লামা মুকাদ্দাস আলী একজন নিভৃতচারী বুজুর্গ ছিলেন। পার্থিব দুনিয়ার মোহ-মহব্বত ছিলনা তার মাঝে। কিতাব অধ্যয়নেই তার ছিল সব আনন্দ-আহ্লাদ। সব প্রশান্তি যেন ছিল সাদা কাগজের কালো হরফগুলোতে, যেখানে লেখা রয়েছে কোরআন মাজিদের আয়াত, তাফসি ও হাদিসের বাণী। জীবনের শেষ সময়ে বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়লেও কিতাবের মায়া এবং ছায়ায় ছিলেন ফুরফুরে। একদিকে যেমন ইলমে হাদিসের ওপর অগাধ পাণ্ডিত্য, অন্যদিকে নিভৃতচারিতা ও বুজুর্গিতে অতুলনীয় ছিলেন সিলেটের এই মহান বুজুর্গ। টানা ৬৯ বছর ধরে তিনি সিলেটের নিভৃত পল্লীতে থেকে হাদিসশাস্ত্রের সবচেয়ে বিশুদ্ধ সংকলন সহিহ বোখারি শরিফের দরস প্রদান করে আসছিলেন।

জানা যায়, শায়খুল হাদীস আল্লামা মুকাদ্দাস আলী (রহ.) শিশুবয়সেই নিজ পিতাকে হারান। মায়েরও বিয়ে হয়ে যায় অন্যত্র। ফলে অবুঝ বয়সেই মাওলানা মুকাদ্দাস আলীকে নানা প্রতিকূলতা মাড়াতে হয়। শৈশব-কৈশোরে মা-বাবার স্নেহ-ছোঁয়াহীন তার বেড়ে ওঠা। প্রথমে ফুফুর কাছে, তারপর নানার কাছে লালিত-পালিত হন। এ সময় তাকে নানা পরীক্ষা-প্রতিকূলতা ডিঙাতে হয়। ৭ বছর বয়সে তার মস্তিষ্কে বড় এক রোগ হয়। এই রোগে তিনি দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। একপর্যায়ে সুস্থ হলেও মাথার তালুতে সেই রোগের ক্ষত থেকে যায়, যা এখনো রয়েছে। এরপর মাত্র ১২ বছর বয়সেই পিতৃহারা বালক আল্লামা মুকাদ্দাস আলী ফুফুর বাড়িতে কিছুদিন থাকেন। তবে এতসব পরীক্ষাও তার লেখাপড়ার অদম্য স্পৃহার কাছে হার মানে।

শিক্ষাজীবনে শায়খুল হাদীস আল্লামা মুকাদ্দাস আলী প্রথমে স্থানীয় সোনাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পাশাপাশি মসজিদের ইমাম মাওলানা মাহমুদ হুসাইনের কাছে কায়দা-আমপারাসহ দ্বীনের বুনিয়াদি শিক্ষা অর্জন করেন। দ্বীনি শিক্ষার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল বিধায় স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে চলে যান ফুফুর বাড়িতে। ভর্তি হন মাদ্রাসায়ে সাইদিয়া ভরন সুলতানপুরে। সেখানে এক বছর লেখাপড়ার পর নানাবাড়ি চলে যান। ১৩৬৭ হিজরিতে নানা তাকে ভর্তি করিয়ে দেন বর্তমান ভারতে অবস্থিত বছলার মারকাজুল উলুম ভাঙ্গা মাদ্রাসায়। ভাঙ্গা মাদ্রাসার প্রায় সব শিক্ষকই ছিলেন শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর সান্নিধ্যধন্য, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। এখানে নাহবেমীর থেকে জালালাইন পর্যন্ত একটানা আট বছর পড়াশোনা করেন।

সিলেটে তখন শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। ফলে এ সময়ে শায়খ মাদানির বেশ কয়েকজন খলিফার সাহচর্য ও শিষ্যত্ব লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন তিনি। এরপর উচ্চশিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে ১৩৭৪ হিজরিতে চলে যান উপমহাদেশের অন্যতম দ্বীনি মারকাজ দারুল উলুম দেওবন্দে। পুনরায় ভর্তি হন জালালাইন জামাতে। দেওবন্দে তিন বছর ‘ফুনুনাত’ পড়ে ১৩৭৭ হিজরিতে ভর্তি হন দাওরায়ে হাদিসে। বোখারি শরিফের দারস ও সনদ গ্রহণ করেন হজরত ফখরুদ্দিন মুরাদাবাদী (রহ.)-এর কাছ থেকে। এ ছাড়া আল্লামা ইবরাহিম বালিয়াভি (রহ.)-এর কাছে সহিহ মুসলিম ও সুনানে তিরমিজি, মাওলানা ফখরুদ্দিন মুরাদাবাদি (রহ.)-এর কাছে সুনানে আবু দাউদ, মাওলানা জহুরুল হক (রহ.)-এর কাছে শরহে মাআনিল আসার, মাওলানা সাইয়্যিদ হাসান (রহ.)-এর কাছে সুনানে ইবনে মাজাহ, কারি তৈয়্যব (রহ.)-এর কাছে মুআত্তাইন কিতাব পড়েন এবং ইজাজত পান।

শায়খ মুকাদ্দাস আলী দারুল উলুম দেওবন্দে তার লেখাপড়ায় অভূতপূর্ব কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। আল্লামা মুকাদ্দাস আলী যে বছর দাওরা পড়েন, তার মাত্র বছর দুয়েক আগে শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর ইন্তেকাল হয়। তাই সরাসরি শায়খ মাদানির ছাত্রত্ব গ্রহণের সুযোগ পাননি। তবে পাঠভুক্ত ক্লাস ছাড়া অন্য ক্লাসে বসার সৌভাগ্য লাভ করেছেন কয়েকবার। দেওবন্দে দাওরা পরীক্ষার পর মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুর গিয়ে সেখানে কিছুদিন শায়খুল হাদিস জাকারিয়া (রহ.)-এর সাহচর্য গ্রহণ করেন এবং তার কাছ থেকে বোখারি শরিফের লিখিত ইজাজত লাভ করেন।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্তির পর আল্লামা মুকাদ্দাস আলী দেশে ফিরে আসেন। এরপর ১৩৭৯ হিজরি ১৯৬০ সালে জন্মভূমি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার মুনশিবাজার মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের শুরু হয়। তখন মুনশিবাজার মাদ্রাসায় হাদিসের জামাত ছিল না, ফলে মিশকাতুল মাসাবিহ, তাফসিরে বয়জাবিসহ গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি পাঠদান করেন। পরের বছরই সেখানে দাওরায়ে হাদিস খোলা হয় এবং প্রত্যাশিতভাবে তরুণ মাওলানা মুকাদ্দাস আলী শায়খুল হাদিসের মসনদ অলংকৃত করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৬৯ বছর ধরে সহিহ বোখারির দরস দিয়ে আসছিলেন। অবশ্য মাঝখানে একবার দু'বছরের জন্য সিলেটের আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিস হিসেবে ছিলেন, তারপর আবার ফিরে আসেন মুনশিবাজারে এবং সেই থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ছায়া দিয়ে গেছেন পূর্ব সিলেটের প্রাচীন মাদ্রাসা মুনশীবাজার জামিয়ায়।

জকিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সহ সভাপতি মাওলানা রহমত আলী হেলালী জানান, বাংলাদেশে একাধারে এত দীর্ঘকাল সহিহ বোখারির দারস দিয়েছেন, এমন কোনো শায়খুল হাদিসের নাম আমরা এখনো জানতে পারিনি। ধারণা করা হয়, পুরো উপমহাদেশেও দ্বিতীয় কোনো মনীষী নেই এমন, যিনি এত দীর্ঘকাল বোখারির দারস দিয়েছেন। তবে অনেকেই আছেন এমন, যাদের শিক্ষকতা জীবন ৭০ বছর পাড়ি দিয়েছে, সহিহ বোখারিও পড়িয়েছেন; কিন্তু তাদের এই পাঠদান শুধু বোখারি শরিফ এবং একাধারে দীর্ঘ এত সময় ছিল না, বরং বিচ্ছিন্নভাবে পড়িয়েছেন।

হুজুরের ঘনিষ্ঠজনরা জানান, আল্লামা মুকাদ্দাস আলী কিংবদন্তিতুল্য একজন শায়খুল হাদিস হওয়ার পাশাপাশি একজন উঁচুমাপের বুজুর্গও ছিলেন। দেওবন্দে দাওরা শেষ করেই ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যিদ আসআদ মাদানি (রহ.)-এর হাতে আত্মশুদ্ধি ও সুলুকের বায়াত হন। এরপর দেশে ফিরে আসায় যোগাযোগ অসুবিধার কারণে ফেদায়ে মিল্লাতের নির্দেশে শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর অন্যতম খলিফা কায়েদে উলামা মাওলানা আবদুল করীম শায়খে কৌড়িয়ার হাতে বায়াত হন এবং ১৩৮৩ হিজরির ২৭ রমজান খেলাফত লাভ করেন। এরপর থেকে হাদিসের পাঠদানের পাশাপাশি আধ্যাত্মচিকিৎসায় মনোযোগ দেন। বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক মেহনতের লক্ষ্যে একটি খানকা চালু করেছিলেন তিনি।

বর্তমান সিলেটে খানকাওয়ারি মেহনতের ধারাটি জকিগঞ্জের মুনশিবাজার মাদ্রাসা মসজিদেই কেবল চালু আছে। আর খানকার পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে ছিলেন আল্লামা মুকাদ্দাস আলী। প্রতিবছর রমজানের শেষ দশকে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন জকিগঞ্জ ছুটে যেতেন তার সাহচর্যে থেকে ইতেকাফ করার জন্য।

ইতিমধ্যে আধ্যাত্মিক তরিকায় বেশ কয়েকজন ব্যক্তিত্বকে তিনি খেলাফত প্রদান করেছেন। তাদের অন্যতম হলেন কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়ার শায়খুল হাদিস মাওলানা শফিকুর রহমান জালালাবাদী। তিনি প্রতিবছর রমজানের শেষ দশকে কিশোরগঞ্জ থেকে ছুটে আসতেন শায়খের সাহচর্যে ইতেকাফের জন্য।

পারিবারিক জীবনে মাওলানা মুকাদ্দাস আলী ১৩৮১ হিজরিতে জকিগঞ্জের পরচক নিজগ্রামের আলহাজ মুহিবুর রহমানের বড় মেয়ে আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। আট সন্তানের মধ্যে তিন মেয়ে শৈশবেই মারা যান। বর্তমানে তিন ছেলে আর দু'জন মেয়ে রয়েছেন। দুই ছেলে আলেম, হাফেজ এবং দ্বীনি খেদমতে নিয়োজিত আছেন।


শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়