বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকেই ভিসা জটিলতায় ভারতে কমেছে বাংলাদেশি পর্যটক ও চিকিৎসা প্রত্যাশীদের আনাগোনা। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার কয়েকটি হাসপাতাল এবং কয়েকজন চিকিৎসক ‘বাংলাদেশি রোগী দেখব না’ বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে ভারতগমন আরও কমেছে বাংলাদেশি চিকিৎসা প্রত্যাশীদের। এতে ধস নেমেছে কলকাতাসহ ভারতের অন্যান্য শহরে হাসপাতাল ব্যবসায় ব্যপক ধস নেমেছে।
পূর্ব ভারতের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সংগঠন জানাচ্ছে বাংলাদেশের রোগী আসা প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে। যেসব হাসপাতাল বাংলাদেশি রোগীদের ওপরে অনেকটাই নির্ভরশীল ছিল, তাদের কাছে এটা বড় ধাক্কা। শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরা নয়, বাংলাদেশি রোগী আসা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ায় ভারতের সব হাসপাতালেই তার প্রভাব পড়ছে।
ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে যে ব্যাপকভাবে তাদের কথায় 'ভারত-বিরোধিতা' চলছে, সেই প্রেক্ষিতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কলকাতার ও আগরতলার একটি করে হাসপাতাল এবং কলকাতা এবং শিলিগুড়ির দুজন চিকিৎসক।
কলকাতার জে এন রায় হাসপাতালের পরিচালক শুভ্রাংশু ভক্ত সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘দেশ সবার ওপরে। তার ওপরে কিছুই হতে পারে না। চিকিৎসা পরিষেবা একটি মহৎ পেশা, কিন্তু দেশের সম্মান সবার ওপরে। তিনি এও বলেন যে অন্যান্য হাসপাতালগুলিও তাদের পথেই হাঁটবে বলে তার আশা। এই হাসপাতালটির পরিচালনার সঙ্গে কলকাতার বিজেপি নেতা ও কলকাতা পৌর নিগমের কাউন্সিলর সজল ঘোষ জড়িত আছেন বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে ত্রিপুরার আগরতলায় আইএলএস হাসপাতালে প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশি রোগী আসতেন। সেখানে একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন দিন কয়েক আগে দাবি সনদ পেশ করে যাতে ওই হাসপাতালে কোনও বাংলাদেশি রোগীকে পরিষেবা না দেওয়া হয়।
আইএলএস আগরতলার প্রধান নির্বাহী অফিসার গৌতম শইকিয়া গণমাধ্যমের সামনেই ঘোষণা করেন যে তারা ওই সংগঠনটির দাবি মেনে বাংলাদেশি রোগীদের সব পরিষেবা দেওয়া বন্ধ রাখছেন।
ডাক্তার হিসেবে এটা বলা যায় না
কলকাতার একটি হাসপাতাল ও দুজন চিকিৎসকের বাংলাদেশি রোগী না দেখার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন চিকিৎসকও।
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্সের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ডা. মানস গুমটা বলেন, ‘একজন চিকিৎসক হিসেবে কোনও বিশেষ দেশের বা বিশেষ ধর্মের রোগী দেখব না এটা বলা যায় না। ডাক্তার হতে গেলে যে শপথ নিতে হয়, এ ধরনের কথা তার পরিপন্থি। একজন অপরাধীও আমাদের কাছে রোগী হিসাবে এলে তার চিকিৎসা করাটাই আমাদের অন্যতম শপথ’।
অ্যাসোসিয়েশন অব হসপিটালস্ অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট ও কলকাতার উডল্যান্ডস হসপিটালের প্রধান নির্বাহী অফিসার রূপক বড়ুয়া বলেন, ‘একজন রোগী তো রোগীই– তার তো কোনও জাত, ধর্ম থাকতে পারে না। আমাদের দায়িত্ব তিনি এলে তাকে চিকিৎসা দিতে হবে। বাংলাদেশি রোগী দেখব না, এটা বলা যায় না। ভাবাবেগ থাকতেই পারে, কিন্তু কোনও ঘটনার দায় তো বাংলাদেশের সবার ওপরে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। আমাদের অ্যাসোসিয়েশনে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পর্যায়তেও আসেনি ‘
হাসপাতাল ব্যবসায় ধাক্কা
মূলত গত আগস্ট মাস থেকেই বাংলাদেশি রোগীদের ভারতে আসা ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
রূপক বড়ুয়া জানান, ‘আগে প্রতিমাসে গড়ে ভারতের মেডিক্যাল ভিসা দেওয়া হতো ২০-২৫ হাজার। এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৭০০ থেকে এক হাজার। তাও মূলত নতুন রোগী নয়– পুরোনো রোগী – যাদের চেকআপ ইত্যাদি আছে, তারাই ভিসা পাচ্ছেন। তাই পুরো ভারতের হাসপাতাল শিল্পের ওপরেই বড় ধাক্কা এসেছে।’
ভারতের অন্যতম বৃহৎ হাসপাতাল গোষ্ঠী মনিপাল হসপিটালসের পূর্বাঞ্চলীয় চিফ অপারেটিং অফিসার ডা. অয়নাভ দেবগুপ্তর কথায়, ‘এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে বাংলাদেশে অস্থিরতার কারণে সেখান থেকে বহু রোগী ভারতের হাসপাতালগুলোতে আসতে পারছেন না। আমাদের হাসপাতালগুলোতেও বহির্বিভাগ এবং রোগী ভর্তি কমে গেছে। কিন্তু আগে থেকে ঠিক করে রাখা কোনও অপারেশন আমাদের পিছিয়ে দিতে হয়নি। তবে আমাদের যারা পুরনো রোগী, তাদের চিকিৎসায় যাতে ছেদ না পড়ে, সেজন্য আমরা টেলি-মেডিসিনের ব্যবস্থা করেছি। অনলাইন কনসাল্টেশনের সংখ্যাটা বাড়ছে।’
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালে ভারতে চিকিৎসা নিতে বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মানুষ। ভারতে যত বিদেশি নাগরিক চিকিৎসা করাতে আসেন, তাদের মধ্যে বাংলাদেশিরাই সর্বাধিক।সূত্র: বিবিসি
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়