মাহবুবুর রশিদ:
২০২৪ সাল। পত্রিকার পাতায় বিভিন্ন সময়ে সংবাদের শিরোনামে ছিলো সিলেটের সীমান্তবর্তী কানাইঘাট উপজেলা। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে পুরো উপজেলা। জঘ্যনতম ঘটনারও সাক্ষী হয়েছে। বছরের শুরুতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘটেছে নানা নাটকীয় ঘটনা; এরপর পুরো বছরজুড়ে বিভিন্ন সময় খুন, অপহরণ, আত্মহত্যা এবং ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় সংবাদের শিরোনাম হয়েছে এই উপজেলা।
বহুল আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিলো শিশু মুনতাহা হত্যাকান্ড, সীমান্ত থেকে বিচারপতি মানিককে আটক, আপন তিন ভাই-সহ একই পরিবারের চারজনের মৃত্যু, চাচাতো ভাইকে গলাকেটে হত্যা, প্রকাশ্যে ছাত্রদল নেতা খুন। কবর থেকে লাশ উঠিয়ে এনে হারিছ চৌধুরীকে পূণরায় সমাহিত করার মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে কানাইঘাটের জন্য আলোচিত এই বছর। ২০২৪ সালের ঘটে যাওয়া আলোচিত-সমালোচিত কয়েকটি ঘটনা কানাইঘাট নিউজ’র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
মধ্যযুগীয় কায়দায় যুবককে নির্যাতন ও হত্যা:
মধ্যযুগীয় কায়দায় এক যুবককে নির্যাতন করে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে বছরের প্রথম মাসেই। ২৬ জানুয়ারি উপজেলার বড়চতুল ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামে গরু চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে একই গ্রামের আব্দুস সামাদের পুত্র নজরুল ইসলামের উপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায় তারই প্রতিবেশি মাহমুদ ও তার পরিবারের লোকজন। ৩১ জানুয়ারি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নজরুল। ঘটনাটি নিন্দার ঝড় তুলে পুরো উপজেলাজুড়ে।
তুচ্ছ ঘটনায় সিএনজি চালককে হত্যা:
কানাইঘাট উপজেলায় বহুল আলোচিত একটি ঘটনা ড্রাইভার আলমগীর হত্যাকান্ড। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঝিঙ্গাবাড়ী ইউনিয়নের তিনচটি গ্রামের মৃত আলী আহমদ মিস্ত্রীর পুত্র সিএনজি চালিত অটোরিক্সা ড্রাইভার আলমগীর হোসেন (৩২)-কে কুপিয়ে হত্যা করা হয় প্রকাশ্যে জনসমাগমের জায়গায়। গাছবাড়ী বাজারে পল্লীবিদ্যুৎ মোড়ের সিএনজি স্ট্যান্ডে ঘটনাটি ঘটে ৭ ফেব্রæয়ারি তারিখে। ঐদিন দক্ষিণ বাণীগ্রাম ইউনিয়নের আকুনি গ্রামের শাহাব উদ্দিনের ছেলে সাদিক আহমদের মোটরসাইকেলের সাথে ধাক্কা লাগে আলমগীরের গাড়ির। কথাকাটাকাটি হয়। এই তুচ্ছ ঘটনার কয়েক ঘন্টার মাথায় সন্ধ্যার পর পর সিএনজি স্ট্যান্ডে অবস্থিত একটি রেস্টুরেন্টে বসে থাকায় অবস্থায় বখাটে সাদিক ও তার কিছু লোক চাকু ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে আলমগীরকে। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান এই যুবক।
একসঙ্গে চার সন্তানের জন্ম:
একসঙ্গে চার সন্তানের জন্মের বিষয়টি উপজেলায় ব্যাপক আলোচিত ছিলো। ২২ ফেব্রæয়ারি সিজারিয়ান ডেলিভারির মাধ্যমে একসঙ্গে চার সন্তানের জন্ম দেন ফৌজিয়া বেগম নামে এক মা। শিশু চারটির বাবা উপজেলার রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের রুহুল আমিন।
কিশোরের গলাকাটা লাশ পাঠালো বিএসএফ, সীমান্তে যুবকের মৃত্যু:
২৩ ফেব্রুয়ারি উপজেলার লক্ষীপ্রসাদ পশ্চিম ইউনিয়নের সোনাতনপুঞ্জি গ্রামের নুরুল হকের ছেলে মাসুমের (১৫) গলাকাটা লাশ সুরইঘাট সীমান্ত দিয়ে বিজিবির কাছে বুঝিয়ে দেয় বিএসএফ। ১৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সীমান্তবর্তী বাদশা বাজার থেকে নিখোঁজ হয়েছিলো কিশোর মাসুম। এক সপ্তাহ পর নিখোঁজ কিশোরের গলাকাটা লাশ সীমান্তের ওপার থেকে ফিরে আসায় স্থানীয় জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
কয়েক মাস পর ২৩ আগস্ট একই সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারত থেকে চিনি আনতে গিয়ে আব্দুল কাদির (৪০) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। তিনি সোনাতনপুঞ্জি গ্রামে নির্মিত সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে বসবাসরত আইয়ুব আলীর ছেলে।
নববধূর রহস্যজনক মৃত্যু:
হাতে মেহেদির রং শুকানোর আগে তানহা আক্তার রিপা (১৯) নামে এক নববধূর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। ২৯ মার্চ গভীর রাতে উপজেলার লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের দনা পাতিয়ালা গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। রিপা ওই গ্রামের নিজাম উদ্দিনের স্ত্রী ও পাশ^বর্তী জকিগঞ্জ উপজেলার তেরাপুর গ্রামের মৃত সুরুজ আলীর মেয়ে। রিপার বাবার বাড়ির লোকজনের দাবি, বিয়ের মাত্র ছয় মাসের মাথায় স্বামীর বাড়ির লোকজন তাকে নির্যাতন করে হত্যার পর আত্মহত্যার নাটক সাজায়।
ট্রিপল মার্ডারসহ একই পরিবারের চার জনের মৃত্যু :
এই চাঞ্চল্যকার ঘটনাটি ঘটে উপজেলার বড়চতুল ইউনিয়নের হারাতৈল মাঝবড়াই গ্রামে। মসজিদের সীমানার জায়গা নিয়ে বিরোধের জের ধরে সংঘর্ষে আপন ভাই নিহত হন ভাতিজাদের হাতে। ট্রিপল মার্ডারের ঘটনাটি সিলেটজুড়ে আলোচনার ঝড় তোলে। আপনজন ও পরিবারের মুরব্বীদের হারিয়ে দুশ্চিন্তায় একই পরিবারের রুমানা নামের এক পুত্রবধূর মৃত্যু হয়। ২২ এপ্রিল নিহত তিন ভাইয়ের আপন বড় ভাই সমছুল হক ও ভাতিজা আলমাছ উদ্দিন, কামাল আহমদ, সুহেল আহমদ, রুহুল আহমদ-সহ অন্যরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে জয়নাল আবেদীন, ছয়ফুল্লাহ, আব্দুল্লাহর উপর। গুরুত্বর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক এক করে মৃত্যু ঘটে তিন ভাইয়ের।
যুক্তরাষ্ট্রে খুন, কানাইঘাটে মাতম:
২৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বাফেলো শহরে কৃষ্ণাঙ্গ দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন উপজেলার ঝিঙ্গাবাড়ী ইউনিয়নের তিনচটি গ্রামের নুরুল হক মেম্বারের ছেলে ইউসুফ আলী জনি (৪২)। জনি স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে সেখানে থাকতেন। কৃষ্ণাঙ্গ সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশে থাকা বাবা, মা ও স্বজনেরা ভেঙে পড়েন। এই ঘটনায় পুরো এলাকাজুড়ে মাতম সৃষ্টি হয়।
তিন নির্মাণ শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু :
২ মে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে পৌরসভার লালারচক গ্রামের আব্দুছ ছালামের পুত্র নির্মাণ শ্রমিক হেলাল আহমদের মৃত্যু হয়। ৯ সেপ্টেম্বর পৌরসভার দারুল উলূম মাদরাসার পাশে অবস্থিত একটি নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যান কামরুল ইসলাম (২০) নামের আরেক নির্মাণ শ্রমিক। তিনি বড়চতুল ইউনিয়নের লখাইরগ্রামের (কুল্লা) আজিজুর রহমানের ছেলে। ২০ অক্টোবর উপজেলার ঝিঙ্গাবাড়ী ইউনিয়নের দর্জিমাটি গ্রামে টিনশেড ঘর নির্মাণের কাজ করার সময় বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে আব্দুল মালিক (৪৯) নামে আরেকজনের মৃত্যু হয়। তিনি পাশর্^বর্তী তিনচটি গ্রামের মৃত আব্দুল লতিফের ছেলে।
ফুফু-ভাইজির মৃত্যু:
৪ মে একইদিনে পৃথক ঘটনায় ফুফু ও ভাইজির মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা সবাইকে নাড়া দেয়। উপজেলার দিঘীরপার পুর্ব ইউনিয়নের মাঝরগ্রামের হাফিজ আব্দুল আহাদের তিন বছর বয়সী মেয়ে পানিতে ডুবে মারা যায়। ভাতিজির মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে ফুফু একই ইউনিয়নের দর্পনগর পশ্চিম (নয়াগ্রাম) এর আব্দুস শহীদের স্ত্রী রুকিয়া বেগম (৩০) বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে সড়কের বাজার এলাকায় টমটম উল্টে গুরুত্বর আহত হন। ঐদিনই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
ভয়াবহ বন্যার কবলে কানাইঘাট-সহ উত্তর-পুর্ব সিলেট:
বাইশের ভয়াবহ বন্যার ক্ষত কাটিয়ে উঠার আগেই চব্বিশের বন্যা আবারো তছনছ করে দেয় সিলেটের কয়েকটি উপজেলাকে। স্মরণকালের ভয়াবহ এই বন্যায় পুরো কানাইঘাট উপজেলা ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে। সামগ্রিকভাবে বাইশের বন্যা সিলেট অঞ্চলের জন্য সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গকারী হলেও চব্বিশের বন্যা শুধু কানাইঘাটের উপজেলার ক্ষেত্রে বাইরের বন্যারও ভয়াবহতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। ৩০ মে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কানাইঘাট উপজেলায় ভয়াবহ বন্যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। জুনের প্রথম কয়েকদিন এই বন্যা ছিলো।
৫ জুন বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেও কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভয়াবহ বন্যার সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কিনা- এ নিয়ে ভোটারদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দিলেও শেষমেষ ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়।
বাড়ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, পাঁচজনের মৃত্যু:
সারাদেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বাড়ছে। এই হার কানাইঘাট উপজেলায় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। ২০২৪ সালে এই উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় যত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তার প্রায় ৭০% কেবলই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। এই বছর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৫ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ভিকটিমদের সবাই তরুণ এবং কলেজ পড়–য়া।
৮ মার্চ আখলাক হোসেন নামে ১৭ বছর বয়সী এক কলেজ শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। কানাইঘাট সদর ইউনিয়নের বীরদল পুরানফৌদ গ্রামের স্কুল শিক্ষক বদরুল আলম উজ্জ্বলের পুত্র আখলাক কানাইঘাট সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলো। ২৮ জুন সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কের কানাইঘাট উপজেলার রামপুর যাত্রী ছাউনির সামনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হন শাহরিয়ার আহমদ স্বপন (২৪) নামের আরেক কলেজ শিক্ষার্থী। তিনি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা ডিগ্রি কলেজের ডিগ্রি ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৬ জুলাই জকিগঞ্জে দুই মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে কানাইঘাটের দুই কিশোর নিহত হন। তারা হলেন- দিঘীরপার পূর্ব ইউনিয়নের দর্পনগর পূর্ব খরচটি গ্রামের আব্দুস সাত্তারের ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন (১৬) ও একই ইউনিয়নের মানিকপুর গ্রামের এবাদুর রহমানের ছেলে মারজান আহমদ (১৭)। ৯ সেপ্টেম্বর সড়কের বাজার এলাকায় দেলোয়ার হোসেন (২৫) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী একটি গাড়ির ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
বজ্রপাতে পাঁচজনের মৃত্যু :
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার মতো ২০২৪ সালে বজ্রপাতেও পাঁচজনের প্রাণহানি ঘটে এই উপজেলায়। মসজিদে নামাজ পড়াতে যাওয়ার সময় ২১ এপ্রিল বজ্রপাতে মারা যান কবীর উদ্দিন (৩৫) নামের এক ইমাম। তিনি উপজেলার বড়চতুল ইউনিয়নের সোনাতলা এলাকার এবাদুর রহমানের ছেলে। ২ মে দিঘীরপার পূর্ব ইউনিয়নের একটি হাওরে বোরো ধান কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে বাবুল আহমদ (৪৮) নামের এক কৃষক মারা যান। বাবুল আহমদ দক্ষিণ কুওরের গ্রামের মৃত আব্দুস সালামের পুত্র। ৬ মে মাঠে গরু চরাতে গিয়ে বজ্রপাতে মাহতাব উদ্দিন মাতাই নামের এক ওমান প্রবাসীর মৃত্যু হয়। তিনি দর্পনগর পশ্চিম করচটি গ্রামের রফিকুল হকের পুত্র। ২১ সেপ্টেম্বর মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে মারা যান লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের কেউটিহাওর গ্রামের জমশেদ আলীর ছেলে কালা মিয়া (৩৫) ও পৌরসভার উত্তর দলইরমাটি গ্রামের তুতা মিয়ার ছেলে নূর উদ্দিন (৫৮)।
৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থীর আতœহত্যা:
১৪ জুলাই খালেদ আহমদ (১৩) নামে ৭ম শ্রেণির এক স্কুল শিক্ষার্থীর ঘরের তীরের সাথে রশি প্যাঁচিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা সবার হৃদয়ে দাগ কাটে। উপজেলার গৌরিপুর গ্রামের প্রবাসী আব্দুল আহাদের একমাত্র পুত্র খালেদ সামান্য বিষয় নিয়ে অভিমান করে আত্মহত্যা করে।
ধান খেয়েছে ছাগল, নিহত হয়েছে যুবক:
তুচ্ছ ঘটনায় ২০২৪ সালে কানাইঘাট উপজেলায় একাধিক মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে উপজেলার দিঘীরপার পূর্ব ইউনিয়নের জয়ফৌদ গ্রামের এক যুবকের মৃত্যু ঘটনাও একটি। ৯ জুন ছাগল কর্তৃক ক্ষেতের ধান খাওয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়। গুরুত্বর আহত একই গ্রামের শাহিন আহমদ (২৭)। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১১ জুন মারা যান।
থানা, বিজিবি ক্যাম্পের মালামাল লুট:
৫ আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনার। ৬ আগস্ট কানাইঘাট থানা ও সুরইঘাট বিজিবি ক্যাম্পে একদল লোক প্রবেশ করে জব্দকৃত বিভিন্ন প্রকার যানবাহন ও মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। এই ঘটনার ৪৫ দিন পর সুরইঘাট বিজিবি ক্যাম্পের পক্ষ থেকে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৩০০/৪০০ লোককে অজ্ঞাতনামা আসামী করে বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ পেনাল কোডের বিভিন্ন ধারায় মামলা দায়ের করা হয়।
সীমান্ত দিয়ে পালানোর হিড়িক:
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের দেশত্যাগের হিড়িক পড়ে। সিলেটের কিছু সীমান্ত দিয়ে অনেকে পালিয়ে যান প্রতিবেশি ভারতে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের অনেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য নিরাপট রুট হিসেবে কানাইঘাটের দনা ও সোনাতনপুঞ্জি সীমান্ত বেছে নেন। স্থানীয় কিছু দালাল এই সুযোগে বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়। অনেককে ওপারে পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয় তারা বড় অংকের টাকার বিনিময়ে।
সীমান্তের গ্যাড়াকলে বিচারপতি মানিক:
বহুল আলোচিত সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের আটক হওয়ার ঘটনাটিও ছিলো বহুল আলোচিত। কানাইঘাট সীমান্তে আটক হওয়ার খবরটি সেদিন ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’ ছিলো। তিনি সীমান্তের গ্যাড়াকলে পড়ে যান। সেই গ্যাড়াকলে পড়ার বিষয়টি সোশ্যাল মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ২৩ আগস্ট উপজেলার দনা সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এই সময় তাকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে কানাইঘাট থানায় একটি মামলাও লিপিবদ্ধ হয়।
টাওয়ারে নৈশ প্রহরীর লাশ:
কানাইঘাট উপজেলা সদরে অবস্থিত আন-নূর টাওয়ারের নৈশ প্রহরীর লাশ টাওয়ারের নিচের একটি গর্ত থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত ব্যক্তির নাম আব্দুল জলিল (৬০)। তিনি উপজেলার লালারচক গ্রামের মৃত আখলু মিয়ার ছেলে। ১৭ সেপ্টেম্বর তারিখে এই লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটে।
কানাইঘাটের দুই বাসিন্দার মর্মান্তিক মৃত্যু কাতারে:
কানাইঘাটের দুই কাতার প্রবাসীর মর্মান্তিক এলাকায় শোকের ছায়া নামিয়ে আনে। ১ অক্টোবর কাতারে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে গাড়ি উল্টে এই দুইজন নিহত হন। নিহতরা হলেন ঝিঙ্গাবাড়ী ইউনিয়নের আমরপুর গ্রামের আরজান আলীর ছেলে ফারুক আহমদ ও একই ইউনিয়নের গর্দনাকান্দি গ্রামের মাসুক আহমদের ছেলে মোহাম্মদ আলী।
হারিছ চৌধুরীর লাশ উত্তোলন:
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব ও বিএনপি নেতা মোঃ আবুল হারিছ চৌধুরীর লাশ ১৬ অক্টোবর তারিখে সাভারের একটি কবর থেকে উত্তোলন করা হয়। তিন বছর আগে হারিছ চৌধুরী মারা যান প্রতিক‚ল রাজনৈতিক পরিবেশে। এই সময় তাঁকে ভিন্ন নামে দাফন করা হয়। হারিছ চৌধুরীর পরিচয় শনাক্ত করে তাঁকে স্বনামে তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী কানাইঘাটের মাটিতে পূণরায় দাফন করার জন্য হাইকোর্টে রিট মামলা করেন হারিছ চৌধুরী-তনয়া ব্যরিষ্টার সামিরা তানজিন চৌধুরী। ডিএনএ পরীক্ষার পর পরিচয় শনাক্ত হলে হাইকোর্ট ৪ ডিসেম্বর এক রায়ে হারিছ চৌধুরীকে কানাইঘাটে শফিকুল হক চৌধুরী মেমোরিয়াল এতিমখানা প্রাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পূণরায় দাফনের জন্য আদেশ প্রদান করেন। প্রয়োজনীয় সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে তাঁর লাশ কানাইঘাটের মাটিতে পূণরায় সমাহিত করা হবে। জাতীয় নেতা হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু, ভিন্ন নামে দাফন, লাশ উত্তোলন, ডিএনএ টেস্ট এবং কানাইঘাটের মাটিতে আবার দাফন করার বিষয়টি পুরো দেশজুড়েই আলোচিত।
কানাইঘাটে ভয়ংকর নভেম্বর:
কানাইঘাট উপজেলাবাসীর কাছে ভয়ঙ্কর এক মাসের নাম ছিলো নভেম্বর। এই মাসে ২২ দিনের ব্যবধানে পাঁচটি খুন ও কয়েকটি রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বহুল আলোচিত মুনতাহা অপহরণ ও খুনের ঘটনায় কাঁদিয়েছে পুরো দেশের মানুষকে।
শিশু মুনতাহা হত্যাকান্ড:
ছয় বছরের শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনের করুণ পরিণতি সর্বত্র ক্ষোভের সঞ্চার করে। তার অপরহরণ ও লাশ উদ্ধারের ঘটনা পুরো দেশজুড়ে আলোচিত হয়। মুনতাহার দরদমাখা কন্ঠ আর মায়াবী চেহারার হাসিতে কেঁদেছে পুরো নেট দুনিয়া। ৩ নভেম্বর বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় কানাইঘাট সদর ইউনিয়নের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে মুনতাহা। নিখোঁজের আট দিন পর ১০ নভেম্বর মুনতাহার লাশ বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত কর্দমাক্ত ডোবায় পুঁতে রাখা অবস্থা থেকে সরানোর সময় প্রতিবেশী নারীকে হাতেনাতে ধরে ফেলে জনতা। উদ্ধার হয় মুনতাহা, আর পুলিশ গ্রেফতার করে অপহরণ ও হত্যার সাথে জড়িত কয়েকজনকে।
পুকুর থেকে যুবকের লাশ উদ্ধার:
মুনতাহার ঘটনা দিয়ে যে নভেম্বর শুরু, সেই নভেম্বরে সংঘটিত আরো কয়েকটি ঘটনা সবাইকে নাড়া দিয়ে যায়। ৭ নভেম্বর রেজোয়ান আহমদ (৩০) নামে এক যুবকের লাশ নিজ বাড়ির পুকুর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। পেশায় অটোরিকশা চালক রেজোয়ান উপজেলার ২নং লক্ষীপ্রসাদ পশ্চিম ইউনিয়নের গোরকপুর (খাইল্লাকোনা) গ্রামের খলিলুর রহমানের ছেলে। পরিবারের দাবি, রেজোওয়ানকে পুকুরে ফেলে হত্যা করা হয়েছে অথবা হত্যার পর পুকুরে তার লাশ ফেলে রাখা হয়েছে।
চাচাতো ভাইকে গলাকেটে হত্যা:
এমনো পৈশাচিক ঘটনার সাক্ষী হলো কানাইঘাট। জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে ৮ নভেম্বর উপজেলার দক্ষিণ বাণীগ্রাম ইউনিয়নের বাউরভাগ নয়াগাউ গ্রামে ৬৫ বছর বয়সী ফয়জুল হোসেনকে গলাকেটে হত্যা করে তারই আপন চাচাতো ভাই পাষন্ড সুলতান আহমদ (৪৮)। ঘটনার পর পর গ্রামবাসী সুলতানকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।
শ্বশুর বাড়ির গাছে জামাইয়ের লাশ:
১৩ নভেম্বর বড়চতুল ইউনিয়নের চতুল সরুফৌদ গ্রামে শ্বশুর বাড়ির গাছের ডাল থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় জুবায়ের আহমদ (৫০) নামের এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত জুবায়ের আহমদ পার্শ্ববর্তী জৈন্তাপুর উপজেলার চারিকাটা ইউনিয়নের আমিরাবাদ গ্রামের আব্দুল বারীর ছেলে। এই মৃত্যুকে রহস্যজনক মনে করছেন অনেকে।
কাঠমিস্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু:
১৫ নভেম্বর উপজেলার দক্ষিণ বাণীগ্রাম ইউনিয়নের নয়াগাউ মাছুখাল বাজারে একটি ফার্নিচারের দোকান থেকে আব্দুশ শুক্কুর (২৬) নামের এক কাঠমিস্ত্রীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঝুলন্ত লাশ উদ্ধারের ঘটনাটি নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। নিহত আব্দুশ শুক্কুর এই ইউনিয়নের কায়স্তগ্রামের আব্দুন নূরের ছেলে।
প্রকাশ্য দিবালোকে ছাত্রদল নেতা খুন:
বহুদিন পর কানাইঘাটে এক রাজনৈতিক কর্মীর হত্যাকাÐ ঘটে ঘটনাবহুল ২০২৪ সালে। ১৮ নভেম্বর বিকালে কানাইঘাট বাজারে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন পৌর ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক ও পৌরসভার ধনপুর গ্রামের তাজ উদ্দিনের ছেলে আব্দুল মুমিন (২৮)। পূর্ব বিরোধের জের ধরে ঘাতক রাজু ধারালো অস্ত্র দিয়ে মুমিনের তলপেটে আঘাত করে। স্থানীয় জনতা মুমিনকে সাথে সাথে উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
আইসক্রিম বিক্রেতার লাশ উদ্ধার:
২২ নভেম্বও কানাইঘাট উপজেলা সদর থেকে আব্দুর রহমান লাল মিয়া (৪০) নামে এক আইসক্রিম বিক্রেতার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত লাল মিয়া উপজেলার বড়চতুল ইউনিয়নের লখাইরগ্রামের মৃত হাসন আলীর পুত্র। এই হত্যাকান্ডের ঘাতক রুবেলকে গত ২৩ নভেম্বর ভোর রাতে গোয়াইনঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী হাদারকান্দি বেরিবিল এলাকার আত্মীয়ের বাড়ি থেকে একদল পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে পুলিশ।
বসত ঘর থেকে ঝুলন্ত লাশ:
৫ ডিসেম্বর কানাইঘাট সদর ইউনিয়নের উমাগড় গ্রামের মৃত হাফিজ মাহমুদ আলীর পুত্র সব্বির আহমদ (৪০) বসত ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে ফাস দিয়ে আতœহত্যা করে। পরিবারের লোকজন জানিয়েছেন তিনি দীর্ঘদিন থেকে মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছিলেন।
এবং সর্বশেষ গত ২৫ ডিসেম্বর সিলেট জকিগঞ্জ সড়কে সড়ক দূর্ঘটনায় তিন বছরের এক শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।
শান্তিপ্রিয় জনপদ হিসেবে পরিচিত এই উপজেলায় চলতি বছরে প্রকাশ্যে দিবালোকে খুন, অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং অপহরণের ঘটনায় জনমনে ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিলো। কেন খুন ও নানা রকম ফৌজধারি অপরাধের ঘটনা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলো কানাইঘাট উপজেলায়? এই ব্যাপারে কানাইঘাট গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি গবেষক এহসানুল হক জসীম তিনটি কারণ উল্লেখ করেন। নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়, আইনের শাসনের অনুপস্থিতি এবং সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার অভাবে কানাইঘাট উপজেলায় খুন, গুম ও রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা বেড়েছে বলে তিনি মনে করেন।
কানাইঘাট উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মো. মহি উদ্দিন বলেন, ‘নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে ইদানীং এসব ঘটনা ঘটছে। মানুষের মাঝে ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে প্রতিটি পরিবারের অভিভাবককে সন্তানের বিষয়ে আরো অনেক বেশি সচেতন হতে হবে।’
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়