Tuesday, December 3

হঠাৎ কেন বাড়ল ওষুধের দাম

 


* নিয়ম মানে না বেশিরভাগ কোম্পানি

* কাঁচামাল ও ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাত
* ছোট দেশ থেকে কাঁচামাল এনে দেখানো হয় বড় দেশ
* ১১০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বৃদ্ধি
* কিছু ওষুধের দাম সমন্বয়ের কথা বলছে ঔষধ প্রশাসন
* চিকিৎসকরা কমিশন নেয়া বন্ধ করলে
ওষুধের দাম ৪০ শতাংশ কমে যাবে
* ভোক্তার ঘাড়ে বাড়তি খরচ, ব্যবস্থা নেয়ার দাবি

জীবন রক্ষাকারী অর্ধশতাধিক ওষুধের দাম আবারও বেড়েছে। গত তিন মাসে কোনো কোনো ওষুধের দাম ১১০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের নিয়মের তোয়াক্কা করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিত্যপণ্য কিনতে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষ এ ধাক্কা সামলাতে খাদ্যপণ্যে কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে দীর্ঘমেয়াদে পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মধ্যে দেখা দেবে পুষ্টি ঘাটতি। এখন নিম্ন ও মধ্যবিত্তকে ওষুধের বাড়তি দাম চুকাতে হবে প্রাণের মূল্যে! যদিও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালানি তেল ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কিছু ওষুধের দাম সমন্বয় করা হয়েছে।

জানা গেছে, অত্যাবশ্যকীয় ১১৭টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। এর বাইরে যত ওষুধ বাজারে রয়েছে, বেশিরভাগই উৎপাদক কোম্পানির ঠিক করা দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে এজন্যও কিছু প্রক্রিয়া মানতে হয় কোম্পানিগুলোকে। নতুন দরের যুক্তিসহ অনুমোদনের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরে আবেদন করতে হয়। সরকার আমদানি কাঁচামালের সোর্স কান্ট্রি, দর, মানসহ বিভিন্ন বিষয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে যাচাই শেষে সমন্বয় করে। কিন্তু খোদ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও এ নিয়ম মানেনি কোম্পানিগুলো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাজারে দাম কার্যকর করে তা অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বড় বড় উৎপাদক প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই সরকারকে চাপে রাখে। যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের সক্ষমতা না থাকায় অধিদফতরও মেনে নিতে বাধ্য হয়।

প্রতি মাসেই মায়ের জন্য উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ওষুধ কেনেন মিরপুরের বাসিন্দা মতিউর রহমান। সঙ্গে কেনেন কিছু ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনও। মায়ের ওষুধের পেছনে তিন মাস আগেই তার মাসিক খরচ ছিল ৬ হাজার টাকা। ওষুধের দাম বাড়ার কারণে এখন সেই খরচ বেড়ে ৯ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। শুধু মতিউর নন, তার মতো অসংখ্য মানুষের মাসের খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে ওষুধের নতুন দাম। যদিও বহু মানুষের আয় বাড়েনি।

ক্ষুব্ধ অনেক ক্রেতা বলেন, এমনিতেই মানুষ তার উপার্জনের বড় অংশ নিজের কিংবা পরিবারের  চিকিৎসায় ব্যয় করছে। গত তিন মাসে ওষুধভেদে ১০ থেকে ১১০ শতাংশ দাম বেড়েছে, গড়ে যা ২৯ শতাংশ। হঠাৎ ওষুধের দামের লাফে সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়েছে।

গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মেসিতে অন্তত ৫০টি ওষুধ বাড়তি দামে বিক্রি হতে দেখা যায়। এসব ওষুধের মধ্যে আটটির দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ ১১টি, ১০ থেকে ৩০ শতাংশ ২২টি ও ৯টি ওষুধের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১১০ শতাংশ। বৃদ্ধির তালিকায় থাকা ২১টি ওষুধ স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের। এছাড়া এসিআই, এরিস্ট্রো ফার্মা, সার্ভিয়ার ফার্মা, ইউনিমেড ইউনিহেলথ, ড্রাগ ইন্টার ন্যাশনাল, বীকন ফার্মা ও নুভিস্তা ফার্মার বিভিন্ন ওষুধের দাম বেড়েছে। বৃদ্ধির তালিকায় যেমন শিশুর সর্দি-কাশির সিরাপ রয়েছে, তেমনি তালিকায় রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক, ভিটামিন, ব্যথা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ওষুধ।

মিরপুরের গার্মেন্ট শ্রমিক আসলাম উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তিনি জানান, সংক্রামক এ রোগ নিয়ন্ত্রণে তাকে মাসে ৪-৫ হাজার টাকার ওষুধ খেতে হতো। এখন লাগছে ৬-৭ হাজার টাকা। চাল-ডাল কিনতে নাভিশ্বাস ওঠা নজরুল কী করবেন, দিশা পাচ্ছেন না। একই অবস্থা রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা মো. শাহিনূরের। দুই মাস আগে হার্টে রিং বসিয়ে নিয়মিত ওষুধ সেবন করছেন। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী প্রতি মাসে তিন হাজার টাকার ওষুধ লাগছে। প্রাণ বাঁচাতে খাদ্যপণ্যে কাটছাঁট করতে হচ্ছে, এতে পরিবারকে কষ্ট দেওয়া হচ্ছে বলে আক্ষেপ করেন তিনি।

বিভিন্ন ওষুধের দোকানিদের তথ্যে দেখা যায়, অনিয়ন্ত্রিত-২ ডায়াবেটিস রোগীর ব্যবহৃত এমজার্ড এম ট্যাবলেট ৫/৫০০ মিলিগ্রামের প্যাকেট ৫০০ থেকে হয়েছে ৫৪০ টাকা এবং ডাইমাইক্রন এম ৩০ মিগ্রা ৩৮০ থেকে হয়েছে ৪২০ টাকা। এমপামেট ৫ মিগ্রা+৫০০ ট্যাবলেট ১০০ টাকা বেড়ে ৬০০, এরিস্ট্রো ফার্মার প্লুভান প্লাস ৫০ মিগ্রা ২২০ টাকা বেড়ে ৭২০ টাকা, লিনাগ্লিপ-এম ৫০০ মিগ্রা ৩৬০ টাকা থেকে ৪২০ টাকা, কমেট ৫০০ মিগ্রা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, গ্যাস্ট্রিকের ফ্যামোট্যাক ২০ মিগ্রা ট্যাবলেট ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকা, মোটিগাট ১০ মিগ্রা ৩৫০ থেকে ৪২৫ টাকা, ১০ টাকার অ্যানাফ্লেক্স ম্যাক্স ২১ টাকা এবং ২০ টাকার ভায়োডিন মাউথওয়াশ ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীর মিরপুরের একটি ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী জানান, বিভিন্ন ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে। গত তিন বছরে বিভিন্ন দফায় সব প্রতিষ্ঠানই ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। কোনো কোনো ওষুধের ক্ষেত্রে একাধিকবার দাম বাড়ানো হয়েছে। যারা নিয়মিত ওষুধ কেনেন, তারা মাসের ব্যবধানে এসে দেখছেন ৫০ টাকার ওষুধ ১০০ টাকা হয়ে গেছে।

একইভাবে মূত্রথলির অতিকার্যকারিতায় ব্যবহৃত ইউট্রোবিন ৫ মিগ্রা ট্যাবলেট ৪৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০০ টাকা। পাইলস রোগীদের ড্যাফলন ৯০০+১০০০ মিগ্রা ৬৯০ থেকে ৮৪০ টাকা, বাত  চিকিৎসার অ্যানাফ্লেক্স ৫০০ মিগ্রা ৯ থেকে ১৬ টাকা, উচ্চ রক্তচাপের ন্যাট্রিলিক্স এসআর ১.৫ মিগ্রা ২৭০ থেকে ৩৩০ টাকা, হৃদরোগের ভাস্টারেল এমআর ট্যাবলেট ৫৪০ থেকে ৭২০ টাকা (সার্ভিয়ার ফার্মা), ওএমজি-৩ ক্যাপসুল ২৭০ থেকে ৩৩০ টাকা, প্রাথমিক হৃদরোগ প্রতিরোধে রসুভা ৫ মিগ্রা ট্যাবলেট ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা ও রসুভা ৫ মিগ্রা. ৬০০ থেকে এক লাফে হয়েছে ৬৬০ টাকা।

ভিটামিন বি ট্যাবলেট বিকোবিয়ন ৯০ টাকা বেড়ে ৩৯০ টাকা, হাড় ক্ষয়রোধে ওভোক্যাল ডি ৩০০ থেকে ৩৬০ টাকা, ব্যথা নিরাময়ে এভেনাক ১০০ মিগ্রা ট্যাবলেট ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা, মারভ্যান ১০০ মিগ্রা ট্যাবলেট ৩০০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৭০০ টাকা। সংবেদনশীল ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের চিকিৎসা ব্যবহৃত জিরোটিল প্লাস ২৫০ মিগ্রা ৪২০ টাকা থেকে হয়েছে ৬৩০ টাকা, ফেক্সো ১৮০ মিগ্রা ট্যাবলেট ৩০০ থেকে ৩৬০ টাকা, মাইগ্রেনজনিত সমস্যায় ব্যবহৃত ফ্লুভার ট্যাবলেট ২০০ টাকা বেড়ে ৭০০ টাকা, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনোলজি ডিজিজ (সিওপিডি) বা অ্যাজমা রোগীদের ডক্সোমা ২০০ মিগ্রা ট্যাবলেট ২৫০ থেকে ৪০০ টাকা, শীতকালীন অ্যালার্জিজনিত রুপিন ১০ মিগ্রা ১০০ টাকা বেড়ে ৬০০ টাকা, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালসের বিলাস্টিন ২০ মিগ্রা ট্যাবলেট ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকা, অ্যালাট্রোল ৫ মিগ্রা ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, ফেবুস ৪০ মিগ্রা ট্যাবলেট ৩৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫০ টাকা করেছে কোম্পানিগুলো।

নারীর প্রজননজনিত ব্যাধি নিরাময়ে ডাইনোজেস্ট ২ মিগ্রা ট্যাবলেট ২০০ টাকা বেড়ে ১ হাজার টাকা, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভাবস্থা প্রতিরোধে ডাইড্রোন ১০ মিগ্রা ট্যাবলেট ৩০০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ২০০ টাকা, অস্ত্রোপচার-পরবর্তী ব্যথা নিরাময়ের টোরাক্স ১০ মিগ্রা ট্যাবলেট ৬০০ থেকে ১ হাজার টাকা এবং ৩৬০ টাকার অ্যানাডল এসআর ১০০ মিগ্রা ট্যাবলেট এক লাফে হয়েছে ৫১০ টাকা।

ওষুধের দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কয়েকটি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অন্তত চারজন দাবি করেন, ওষুধের কাঁচামাল অধিকাংশই চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা হয়। কিছু কাঁচামাল ইতালি, পোল্যান্ডসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা হয়। যে ফর্ম বা সংস্করণেই আসুক না কেন, সব কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে কাস্টমস শুল্ক দিতে হয়। হাতে গোনা কয়েকটি ওষুধের কাঁচামালের শুল্কছাড়ের সুবিধা রয়েছে। উৎপাদন খরচের সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়ে ওষুধের দাম বাড়ানো হয়, যা ১০ থেকে ২৯ শতাংশের বেশি নয় বলে দাবি তাদের।

এ বিষয়ে বীকন ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপক (পণ্য ব্যবস্থাপনা) মাসুদ বিল্লাহ ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, গত তিন বছরের বেশি সময় ধরে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এতে উৎপাদন খরচ ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। ওষুধের প্রায় শতভাগ কাঁচামাল আদমানিনির্ভর। উৎপাদনের পর ওষুধের দোকানকেও লাভের সুযোগ দিতে হয়। এমন পর্যায়ে গেছে, তাতে কোনো ওষুধে লাভ খরচের মার্জিনে গিয়ে দাঁড়ায়। মিনিমাম প্রফিট না থাকলে উৎপাদনও বন্ধ করে দিতে হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এম শফিউজ্জামান ডেইল বাংলাদেশকে বলেন, গত ছয় মাসে সব ধরনের ওষুধে ৩৫ শতাংশ উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর পরও তিন মাসে কোনো ওষুধের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়নি। কিছু ওষুধের দাম সমন্বয় করা হয়েছে, যেগুলোর আবেদন তিন থেকে চার বছর আগের। তবে এটা সত্যি, কিছু ওষুধের দাম না বাড়ালে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হবে।

এদিকে, নতুন দামকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের সাবেক উপপরিচালক (আইন) নুরুল আলম ডেইলি বাংলাদশকে বলেন, সম্প্রতি ঔষধ প্রশাসন অযৌক্তিকভাবে বিভিন্ন ওষুধের অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ করেছে। তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে এটি করতে পারত। এখন দাম নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, মন্ত্রণালয় চাইলে নতুন করে বৈঠকের মাধ্যমে সমাধান করতে পারে। কারণ গত বছর প্রস্তাব পেয়ে অধিদফতর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কোম্পানির প্রতিনিধিরা বৈঠক করেন। যাচাই-বাছাই করে তখন স্বাস্থ্য সচিব বলেছিলেন, নতুন করে ওষুধের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। তাহলে কী এমন হলো যে, বছর না যেতেই দাম বাড়ল?

তিনি বলেন, কোনো কোনো কোম্পানি ১১০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু উৎপাদন খরচ কি এত বেড়েছে? আসলে এ খাতের মা-বাপ নেই। কোম্পানিগুলো চীন থেকে কাঁচামাল এনে দেখায় শ্রীলংকার। জীবনে একবার ইউরোপ থেকে আনলেও বছরের পর বছর সেটি দেখিয়ে অন্য দেশেরটি চালিয়ে দিচ্ছে। এসব দেখবে ঔষধ প্রশাসন। কিন্তু তারাও নির্বিকার।

অবশ্য ঔষধ প্রশাসনের পরিচালক (প্রশাসন) আশরাফ হোসেন ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, এবার ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে ওষুধের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। নিয়ম মেনে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বাড়ানো যায়। কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও করতে হয়। যেমন– স্কয়ারের ১২ টাকার একটি ওষুধ হয়েছে ২০ টাকা। একই ওষুধ অন্য কোম্পানির ২৫-৩০ টাকা থাকায় সমন্বয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জীবন রক্ষাকারী অর্ধশতাধিক ওষুধের দাম আবারও কেন বাড়ল? এক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসনের সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, ওষুধের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের। তাদের নিয়ম কোনো কোম্পানি মানে না। এমনকি তারাও মানতে বাধ্য করতে পারে না। তাই মাঝেমধ্যে মাত্রাতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির অভিযোগ ওঠে। এতে বিক্রেতা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভোক্তা।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ড. আবদুর রাজ্জাক ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে গিয়ে মানুষের আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার (নিজ পকেট থেকে বাড়তি ব্যয়) বেড়েছে। এর বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে ওষুধে। বাংলাদেশে ৭০ শতাংশের ওপর আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার। এই ব্যয় কমাতে হলে ওষুধের ব্যয় কমাতে হবে। উৎপাদন খরচ বাড়তেই পারে, তবে তাতে দাম কত বাড়বে? মেডিসিন মানুষকে কিনতেই হয়। আয় বাড়েনি তবে ওষুধের ব্যয় বাড়লে অন্যান্য খাবারের খরচ কমিয়ে দিতে মানুষ বাধ্য হয়। এতে দেখা যায় মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে এবং অসুস্থই থেকে যায়।

এদিকে, দেশের প্রায় সব কোম্পানিই চিকিৎসকদের বিভিন্নভাবে কমিশন বা ঘুষ দিয়ে থাকে। কমিশনপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা সেইসব কোম্পানির ওষুধ রোগীদের ব্যবস্থাপত্রে লিখে দেন। অনেক ক্ষেত্রে যেসব ওষুধ না হলেও চলে, চিকিৎসকরা সেসব ওষুধও লিখে দেন। এতে রোগীদের বাড়তি টাকা ব্যয় করতে হয়। আবার চিকিৎসকরা ওষুধ কোম্পানি থেকে কমিশন পেলেও ওষুধ কম্পানিগুলো কমিশন বাবদ প্রদত্ত সব টাকা মানুষের পকেট থেকে তুলে নেয়। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধ কোম্পানি থেকে চিকিৎসকরা কমিশন নেয়া বন্ধ করলে ওষুধের দাম ৪০ শতাংশ কমে যাবে। ওষুধ কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের ঘুষ বা কমিশন না দিলে মানুষ ১০০ টাকার ওষুধ ৬০ টাকায় কিনতে পারত। বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের মোট বিক্রির ১০ শতাংশ অর্থ চিকিৎসকদের ঘুষ বা কমিশন বাবদ ব্যয় করে। ২০২৪ সালে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মোট ওষুধ বিক্রির পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। মোট বিক্রির ১০ শতাংশ হিসেবে প্রদত্ত কমিশনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ দেশে একটি নিয়মের মধ্যে ওষুধ বিপণন হলেও বাংলাদেশে তা অনুসরণ করা হয় না। সবচেয়ে ক্ষতিকর বিষয় হলো- এখানে ওষুধ কোম্পানির কাছে অনেক চিকিৎসক বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন। তারা অনেকটা চুক্তিবদ্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ওষুধ রোগীদের প্রেসক্রাইব করছেন। ডাক্তারের দেওয়া এই প্রেসক্রিপশন মনিটর করেন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা। অর্থাৎ দেশে ওষুধ বিপণনের ক্ষেত্রে এভাবে একটা পুরো চক্র কাজ করছে।

ওষুধ কোম্পানিগুলো ইচ্ছামতো মুনাফা করছে বলে অভিযোগ করেন পাইকারি ও খুচরা ওষুধ বিক্রেতারা। তারা বলেন, এক শ্রেণির অতি মুনাফালোভী ওষুধ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বছরের পর বছর ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। যেহেতু সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা নেই, সেই সুযোগে যে যার মতো দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে।


শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়