ক্যানসার সারা বিশ্বে মরণব্যাধি হিসেবে পরিচিত। ইংরেজিতে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘ক্যানসার হ্যাজ নো অ্যানসার।’ প্রাথমিক স্তরে ধরা না পড়লে এই রোগ থেকে সেরে ওঠা দুঃসাধ্য। কিন্তু যাদের শরীরে ক্যানসার নেই, তারা চাইলেই এই রোগের ঝুঁকি কমাতে পারেন। তাও মাত্র একটি মাত্র পানীয় পান করে।
নিশ্চয়ই জানার জন্য মন আনচান করছে, কী সেই ম্যাজিক পানীয়। দুর্লভ কিছু নয়, আপনার পরিচিত চা-ই পারে মরণব্যাধি ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে। অনেকের তো চায়ে রীতিমতো আসক্ত। সকালে এক কাপ চা না খেলে তাদের দিনই শুরু হয় না।
এছাড়া অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে কাজের ফাঁকে কিংবা অবসর কাটাতে এক কাপ চা না হলে ঠিক মানায় না। শীতে উষ্ণতা পেতে এক কাপ গরম চায়ের তুলনা নেই। মানসিক চাপ হোক বা কাজের চাপ, বিধ্বস্ত লাগলেই চায়ের প্রতি ভরসা করেন অনেকে। সেই চা-ই ক্যানসারের ঝুঁকি কমায় বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।
চা পান করা দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যার জন্য একটি টনিকের মতো। সবুজ, সাদা বা কালো চা হোক, এই সতেজ পানীয়টির বেশ কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য রক্ষা থেকে শুরু করে হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি সবই করতে পারে চা।
এমনকি, নিয়মিত চা পান কয়েকটি নির্দিষ্ট ধরনের ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারে এবং সেই কারণে এটিকে ক্যানসার-বিরোধী পানীয় হিসাবেও অভিহিত করা হয়। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা নিয়মিত চা পান করেন, তাদের নির্দিষ্ট ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি কম থাকে।
বিজ্ঞানীরা গবেষণায় লক্ষ্য করেছেন, কম মাত্রায় ব্ল্যাক টি সেবন করলে মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যারা দিনে ২-৩ কাপ চা পান করেন তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা, যারা একদমই চা পান করেন না তাদের থেকে ৯-১৩ শতাংশ কম।
এই গবেষণাটি মূলত যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের একটি শাখা, ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। আবার অতিরিক্ত চা পান করলে কার্ডিও ভাস্কুলার সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তার সঙ্গে ইস্কেমিক হার্টের সমস্যা এবং স্ট্রোকও হতে পারে।
অ্যানালস অব ইন্টারনাল মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত এই সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে, বিশ্বব্যাপী অসংখ্য মানুষ প্রতিদিনই নিয়মিত চা পান করেন। তবে যারা মূলত ব্ল্যাক টি সেবন করেন তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম।
চা পানের ফলে জেনেটিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মেটাবলিজম হারও প্রভাবিত হয়। এনআইএইচ-র সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, চা তৈরির সময় প্রয়োজনমত তাপমাত্রা বৃদ্ধি করা, চায়ের সঙ্গে দুধ বা চিনি মেশানো ইত্যাদি মানবদেহে ক্যাফিন মেটাবলিজমের হারকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে।
আমাদের শরীরে সব সময় নানা রকম রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হচ্ছে, যা বিপাক বা মেটাবলিজম নামে পরিচিত। এটা অভ্যন্তরীণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই বিপাক ক্রিয়ার ফলে অথবা দূষিত রাসায়নিক পদার্থ, গুরুপাক খাদ্য, ধূমপান, পরোক্ষ ধূমপান প্রভৃতি কারণে অস্থিতিশীল একক অক্সিজেন পরমাণু তৈরি হয়।
এরা হলো ‘মুক্তমূলক’ বা ফ্রি র্যাডিক্যালস। এই অক্সিজেনমূলক বা ফ্রি র্যাডিক্যালগুলো দেহের ভেতর কিছু উপকারী ভূমিকা পালন করে। কিন্তু যদি এদের সংখ্যা খুব বেড়ে যায়, তাহলে শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। কারণ, এদের উপস্থিতিতে দেহের কোষ বিনষ্টকরণের হার বেড়ে যায়। তখন দেখা দিতে পারে নানা রকম অসুস্থতা।
এগুলোর মধ্যে ক্যানসার একটি। তাই দরকার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। চায়ে আছে পলিফেনল, যা অতি উৎকৃষ্ট মানের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। ফ্রি র্যাডিক্যালগুলোকে প্রশমিত বা নিষ্ক্রিয় (নিউট্র্যালাইজ) করতে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টগুলো কাজ করে।
গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, জারণের ফলে ফ্রি র্যাডিক্যাল দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত কোষসমূহের মাধ্যমেই ক্যানসার সৃষ্টি হয়। এক হিসাবে প্রমাণ পাওয়া গেছে যে মানবদেহেও একটি কোষের ডিএনএ প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার জারণ-আঘাত (অক্সিডেটিভ হিটস) প্রাপ্ত হয়। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এসব আঘাতের ফলে ক্ষতির আশঙ্কা কমিয়ে ক্যানসারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
চায়ে আছে এপিগ্যালোক্যাটেচিন-গ্যালেট (ইজিসিজি) নামের এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ, যা খুব কার্যকর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। ভিটামিন সি এর চেয়ে ১০০ গুণ বেশি ফলদায়ক। এটা কোষের ডিএনএকে এমনভাবে সুরক্ষা দেয়, যেন ক্যানসারের প্রভাবে এর রূপান্তর না ঘটে।
প্রতিদিন এক-দুই কাপ কালো চা বা সবুজ চা পান করি, তাহলে ক্যানসারের আশঙ্কা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। অন্য অনেক উপকার তো আছেই।
চায়ে আছে ফাইটোকেমিক্যালস। এটি হাড় শক্ত করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা চা পান করেন না তাদের তুলনায় চা পানকারীদের হাড় বেশি মজবুত থাকে। গ্রিন টি দাঁতের জন্য ভালো। এতে আছে ফ্লুরাইড ও ট্যানিন নামক উপাদান। এটি দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়তা করে।
চায়ের উপাদানগুলোর মধ্যে ৭ শতাংশ আছে থিওফাইলিন ও থিওব্রোমিন। শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির জন্য এগুলো অনেক উপকারী। চা এন্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হলেও এতে রয়েছে ক্যাফেইন নামক উত্তেজক পদার্থ।
সাধারণত এক কাপ চায়ে রয়েছে প্রায় ৩০-৪০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন। ক্যাফেইনের কারণেই ঘুম কম হওয়া, হজমে ব্যাঘাত ঘটা ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তবে এই ক্যাফেইনের কিছু ভালো দিকও রয়েছে। এটি হৃৎপিণ্ড ও দেহের অন্যান্য পেশি সতেজ রাখতে সহায়তা করে।
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়