নির্বাচন কবে হবে, এই প্রশ্ন জনগণের মতো সরকারেও সারাক্ষণ আছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেছেন, ‘আপনারা লক্ষ্য করেছেন নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছি। কয়েকদিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে যাবে।’
অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার একশ দিন পূর্তি উপলক্ষ্যে রবিবার সন্ধ্যা ৭টায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা একথা বলেন। আধা ঘণ্টাব্যাপী তার এই ভাষণ বিটিভিসহ রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমে প্রচার করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যের শুরুতে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গত জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহীদদের স্মরণ করেন।
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘নির্বাচন আয়োজন করার সমস্ত দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তাবে। নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হাল নাগাদসহ আরো কিছু কাজ শুরু করে দিতে পারবে, যা একটি অবাধ নির্বাচনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত।’
প্রথম বারের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিরা পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে যাতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেই লক্ষ্যে তার সরকার কাজ করছে বলে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা।
বলেন, ‘তবে আমরা মনে করি না যে একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করে দিলেই নির্বাচন আয়োজনে আমাদের দায়িত্ব শেষ। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সংস্কার আমাদের এই সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। আপনারাই আমাদেরকে এই ম্যান্ডেট দিয়েছেন।’
‘যে ছয়টি সংস্কার কমিশন আমরা শুরুতে গঠন করেছিলাম তারা ইতোমধ্যে তাদের কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে আপনারা তাদের কার্যক্রমের আপডেটও দেখছেন। কয়েকটি সংস্কার কমিশন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গঠন করেছে।’ এই প্ল্যাটফর্মে উৎসাহ সহকারে মতামত জানাতে দেশের মানুষের প্রতি অনুরোধ জানান প্রধান উপদেষ্টা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘প্রথম ছয়টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে একটি হলো নির্বাচন সংস্কার কমিশন। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য এই কমিশনের সুপারিশমালা অত্যন্ত জরুরি। তাদের প্ল্যাটফর্মে যান। আপনার মতামত খোলাখুলিভাবে তুলে ধরুন। আপনি দেশের মালিক। আপনি বলে দিন আপনি কি চান। কীভাবে চান।’
জাতিকে উদ্দেশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আপনাদের সকল বক্তব্য বিনা দ্বিধায় বলতে থাকুন। সবার মনের কথা তুলে ধরুন। আমার অনুরোধ সংস্কারের কথাটাও একইসঙ্গে বলুন। সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে যাবেন না।’
‘নির্বাচনের কথা বলার সঙ্গে নির্বাচন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সংস্কারের কথাটিও বলুন। সংস্কার হলো জাতির দীর্ঘ মেয়াদি জীবনী শক্তি। সংস্কার জাতিকে বিশেষ করে আমাদের তরুণ-তরুণীদের নতুন পৃথিবী সৃষ্টির সুযোগ দেবে। জাতিকে বঞ্চিত করবেন না।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন আয়োজনে যে সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় রাজনৈতিক দলসমূহ এবং দেশের সকল মানুষের মতামত অপরিহার্য সে কমিশন হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই সুপারিশমালার কোন অংশ সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে তার ভিত্তিতে নির্বাচনী আইন সংশোধন করতে হবে। সমান্তরালভাবে ভোটার তালিকা হাল নাগাদ করার প্রক্রিয়া চলতে থাকবে।’
সকলকে ধৈর্য্য রাখার আহ্বান জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমি নিশ্চিত নই, সংস্কার প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নের সুযোগ আমরা কতটুকু পাবো। তবে আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, আপনারা সুযোগ দিলে প্রয়োজনীয় কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার কাজ শেষ করেই আমরা আপনাদের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন আয়োজন করবো। ততদিন পর্যন্ত আমি আপনাদের ধৈর্য্য ধারণ করার অনুরোধ করবো।’
‘আমরা চাইবো, আমরা যেন এমন একটি নির্বাচন ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারি যা যুগযুগ ধরে অনুসরণ করা হবে। এর ফলে সাংবাৎসরিক রাজনৈতিক সংকট থেকে আমাদের দেশ রক্ষা পাবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সময়টুকু আমি আপনাদের কাছে চেয়ে নিচ্ছি। নির্বাচনী সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে খুব দ্রুত আপনারা নির্বাচনের রোডম্যাপও পেয়ে যাবেন।’
প্রধান উপদেষ্টা জানান, অন্তর্বর্তী সরকার সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতিকে নীতির কাঠামোয় আনার জন্য এবং রাজনীতির জন্য নতুন পরিবেশ সৃষ্টির নিবিড় আকাঙ্ক্ষা থেকে। এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা থেকে জাতিকে বঞ্চিত না করার আহ্বান জানান তিনি।
নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে আমাদের অনেকগুলি কাজ সেরে ফেলতে হবে। এই ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে সেটা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি আমরা তার জন্য রেল লাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি আর তা হবে রাজনৈতিক দলসমূহের ঐক্যমত্যের মাধ্যমে।’
‘ইতোমধ্যে অন্যান্য সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা নিয়ে আলাপ চলতে থাকবে। নির্বাচন ছাড়াও আরো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করার ব্যাপারে ঐক্যমত্য গঠনের জন্য অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হতে পারে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশবাসীর কাছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলির কাছে আমরা ক্রমাগতভাবে প্রশ্ন তুলতে থাকবো কী কী সংস্কার নির্বাচনের আগে আপনারা করে নিতে চান। নির্বাচনের আয়োজন চলাকালীন কিছু সংস্কার হতে পারে। সংস্কারের জন্য নির্বাচনকে কয়েক মাস বিলম্বিতও করা যেতে পারে।’
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিনদিন পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। সেই হিসাবে অন্তবর্তী সরকার একশ দিন পার করেছে।
এর আগে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সেদিনই প্রথম দফায় জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা। এর ১৭ দিন পর ২৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দ্বিতীয় দফায় ভাষণ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন তিনি। আর দায়িত্ব নেওয়ার এক মাসের মাথায় ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে তৃতীয় দফায় ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের তিন মাসের মাথায় উপদেষ্টা পরিষদের আকার আরেক দফা বাড়ানো হয়। গত ১০ নভেম্বর নতুন তিনজন উপদেষ্টা শপথ নেওয়ার পর এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যসংখ্যা ২৪ জন।
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়