Saturday, October 12

'ধর্ম যার যার, উৎসব সবার' : একটি শিরকী আক্বিদা


আসাদ উদ্দিন::

বিগত বেশ কয়েক বছর থেকে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ এই ন্যারেটিভ দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে ধর্মনিরেপেক্ষ মতবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে। এটা নিয়ে প্রতি বছরই মাতামাতি চলে। তবে মাতামাতি, আলোচনাটা প্রতি বছর দুর্গাপূজা আসলে শুরু হয়। পক্ষে বিপেক্ষে বিস্তর আলাপ চলে। ২০১১ সালে এসে বিতর্কটা আরেকটু জমে উঠে পূজামণ্ডপ পরিদর্শনে গিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্যকে ঘিরে। 

২০১১ সালের ৫ অক্টোবর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা পরিদর্শনে গিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমরা জানি এবং শুনেছি মা দুর্গা প্রত্যেক বছর কোনো না কোনো বাহনে চড়ে আমাদের এই বসুন্ধরায় আসেন। এবার আমাদের দেবী এসেছেন গজে চড়ে। গজে চড়ে এলে এই পৃথিবী ধন-ধান্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। তা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। এবার ফসল ভালো হয়েছে। মানুষ সুখে শান্তিতে আছে। তিনি আরো বলেন, ‘হিন্দুরা দুর্গা উৎসব পালন করছে। মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সকলেই এ উৎসবে অংশগ্রহণ করছে। সকলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ এটা আবারও প্রমাণিত হয়েছে।’

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর সারা দেশে সমালোচনার ঝড় উঠে। দেশের আলেম-ওলামা এবং ইসলামী সংগঠনসমূহ বিবৃতি প্রদান করে বলেন,-এ ধরনের বক্তব্য দেয়ার পর কোনো ব্যক্তি মুসলমান থাকতে পারেন না। তিনি মুসলমান হলে ঐ বক্তব্য প্রত্যাহার করে আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে। কারণ, ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস হলো আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তার মাধ্যমে মাটিতে ফসল হয়। প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেছেন তা মুসলমানদের ঈমান আকীদার পরিপন্থী।’ এবার (২০২৪) চট্টগ্রামের একটি পূজামণ্ডপে পূজা উদযাপন কমিটির আমন্ত্রণে চট্টগ্রাম কালচারাল একাডেমির একটি গানকে কেন্দ্র করে বিষয়টি নিয়ে আবার আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। হিন্দু ধর্মালম্বীরা তাদের দেব-দেবীর ওপর ভরসা করবেন সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীরা তাদের ধর্মের বিধানাবলী পালন করবেন, তাদের ধর্মের মূলনীতি মানবেন সেটা স্বাভাবিক। এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মূলনীতি বা বিশ্বাস অনুসরণ করবে না এটাই স্বাভাবিক। আর ইসলাম ধর্মে তো একত্ববাদের বিশ্বাস ফরজ, যে একত্ববাদের বাইরে কাউকে শরীক করবে তার ঈমান থাকা না থাকার প্রশ্ন চলে আসে। এব্যাপারে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে অসংখ্য আয়াত নাযিল হয়েছে, অসংখ্য হাদীস রয়েছে এ ব্যাপারে। আল্লাহ বলেন, “এবং তোমাদের ইলাহ একমাত্র আল্লাহ; সেই সর্বদাতা করুণাময় ব্যতীত অন্য কেহ উপাস্য নেই। (সূরা বাক্বারা-১৬৩)” মহাগ্রন্থ আল কোরআনের প্রসিদ্ধ আয়তসমষ্টি আয়াতুল কুরসিতে আছে, ”আল্লাহ! তিনি ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তিনি স্বাধীন ও নিত্য নতুন ধারক, সব কিছুর ধারক। তন্দ্রা ও নিদ্রা তাঁকে স্পর্শ করেনা। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু রয়েছে সবই তাঁর। কে আছে এমন, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করতে পারে? সম্মুখের অথবা পশ্চাতের সবই তিনি অবগত আছেন। একমাত্র তিনি যতটুকু ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত, তাঁর জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ত করতে পারেনা। তাঁর আসন আসমান ও যমীন ব্যাপী হয়ে আছে এবং এতদুভয়ের সংরক্ষণে তাঁকে বিব্রত হতে হয়না। তিনিই সর্বোচ্চ, মহীয়ান। (আয়াতুল কুরসী) মানবজাতির প্রতি মহানবী (সা.)-এর প্রেরণের উদ্দেশ্যই ছিলো- নিষ্কলুষ একত্ববাদের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করা। 

পৃথিবীর যত নবী-রাসূল এসেছেন সবার একটাই কমন দাওয়াত ছিলো, আল্লাহর ইবাদতের দিকে মানুষকে ডাকা এবং ত্রুটিযুক্ত বিশ্বাস থেকে বিরত রাখা এবং এই আহ্বানের জন্য পৃথিবীর তাবৎ নবী-রাসূলকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে, হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছে, আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে, করাত দিয়ে শরীর দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে, পাথরের আঘাতে শরীর জর্জরিত হতে হয়েছে, সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে, আকাশে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। তারপরও তারা একত্ববাদের প্রচার থেকে বিরত থাকেননি। সকল অত্যাচার সয়ে একত্ববাদের প্রচার করে গেছেন। 

পৃথিবীর অনেক সম্রাট, রাজা, বাদশাহ তাদের সৃষ্টিকর্তা প্রভুকে অস্বীকার করে নিজেদের খোদা দাবি করেছিলো, দেশ ও জাতিকে দাসে পরিণত করেছিলো। যুগে যুগে পৃথিবীতে মানুষ শুধু পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, গাছগাছালি, জীবজন্তু, আত্মা-প্রেতাত্মা, মানুষ ও শয়তানের সামনেই সিজদা করত না, বরং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অতি নগণ্য কীট-পতঙ্গ, পোকামাকড়ের আরাধনা করত, তাদের সামনে মাথানত করত। এরই ধারাবাহিকতায় গত শতাব্দীর শেষভাগে ভারতে দেব-দেবীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৩৩ কোটিতে। যারা এমন বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের ব্যাপারে মুসলমানদের কোনো বাড়াবাড়ির সুযোগ নেই, কিন্তু একজন মুসলমান হয়ে, নিজেকে মুসলমান দাবি করে আল্লাহর একত্ববাদের সাথে কাউকে শরীক করার কোনো অবকাশ নেই। 

আরেক ধর্মের ধর্মীয় উৎসবকে সর্বজনীন বা সবার উৎসব বলে সেখানে যাওয়ার অধিকার কোনো মুসলমানের নেই। তিনি ধর্ম পালন না করলে ভিন্ন কথা, তবে সেটা তাকে ঘোষণা দিতে হবে, মুসলমান হয়ে, মুসলিম দাবি করে সরাসরি ইসলামের মৌলিক এই বিধান অস্বীকার করার কোনো সুযোগ কোনো মুসলমানের নেই। মুসলমান হবার প্রথম এবং সর্বপ্রথম শর্ত হলো আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন করা। শিরক মানে আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার করা। সেটা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হতে পারে, ছোট বা বড় হতে পারে। সেটা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা বা গুণাবলিতে অন্য কাউকে সমকক্ষ মনে করার মাধ্যমেই হতে পারে। শিরকের চেয়ে ভয়াবহ জুলুম আর কিছু নেই। পবিত্র কোরআনে শিরককে বড় জুলুম বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘আর স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন লুকমান উপদেশচ্ছলে তার পুত্রকে বলল, হে বৎস, আল্লাহর সঙ্গে শরিক কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা বড় জুলুম। (সুরা : লুকমান : আয়াত : ১৩) এবার তাহলে আসুন দেখে নেই, ধর্ম যার যার উৎসব সবার আখ্যা দিয়ে দুর্গাপুজা বা অন্যান্য পুজায় মুসলমানদের অংশগ্রহণ কীভাবে শিরকের মধ্যে পড়ে? আপনি পুজায় অংশগ্রহণ করেছেন, মানে পুজায় যা হচ্ছে সেটা মেনে নিচ্ছেন, সেটাকে সমর্থন দিচ্ছেন। এই জায়গাতেই আপত্তি। যেখানে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পুজা হচ্ছে সেটা আপনি স্বীকার করে সেখানে অংশগ্রহণ করছেন, তার মানে পুজাকে আপনি মেনে নিচ্ছেন! এখানেই আপনি শিরকের মাধ্যমে জুলুম বা বড় অপরাধ করছেন। নিজের ঈমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, কেউ অংশগ্রহণ করতে পারবে না? অবশ্যই পারবে। জনপ্রতিনিধিরা সবার প্রতিনিধি। তারা সকল ধর্মের সকল নাগরিকের প্রতিনিধি, পাশাপাশি তারা আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার তত্ত্বাবধায়ক । 

সুতরাং এই দৃষ্টিকোণ থেকে তারা অংশগ্রহণ করবেন এবং করা উচিত। আবার আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে অবশ্যই নাশকতা প্রতিরোধ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি পূজামণ্ডপে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। আবার মন্দিরে, পূজামণ্ডপে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িত কার্ড খেলা, দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত রুখে দিতে পূজামণ্ডপ পাহারা দেয়াটাও নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যারা এমনটা করছেন তারা চরম দায়িত্বশীল কাজ করছেন। এর বাইরে ধর্ম যার যার উৎসব সবার আখ্যা দিয়ে মুসলিম হিসেবে বেড়োতে যাওয়া, মজা দেখতে যাওয়া, সুন্দরী নারী দেখতে যাওয়া অবশ্যই গর্হিত কাজ। ইসলাম ধর্মে এটা চরম অন্যায়। আবার মুসলমানদের এমন কাজে হিন্দু ধর্মের অনেকেই বিরক্ত হন। বিভিন্ন সময় তারা এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় আয়োজনে অন্য ধর্মের কেউ এলে বিরক্তবোধ করতে পারে, করাটাই স্বাভাবিক। সুতরাং এমন কাজ থেকে বিরত থাকা সকল মুসলমানের উচিত। আর ধর্ম যার যার উৎসব সবার এমন ন্যারেটিভ থেকে সকলের বেরিয়ে আসা উচিত। ধর্ম যার যার ধর্মীয় উৎসব অবশ্যই তার তার। তবে জাতীয় উৎসব সবার- যেমন- মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, নববর্ষ, বিজয় দিবস ইত্যাদি।  

লেখক: শিক্ষক, সরকারি হরগঙ্গা কলেজ, মুন্সিগঞ্জ


শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়