Monday, September 23

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে গবেষণানির্ভর হয়ে উঠবে?

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে গবেষণানির্ভর হয়ে উঠবে?

লোগো

আসিফ বায়েজিদ

 প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০০:০৬


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভিন্ন। এর প্রতিষ্ঠার মূল কারণ রাজনৈতিক। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান অভিলাষ থাকে এর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। এখানকার শিক্ষার্থীরা গবেষণায় নয়, চাকরি পেতে মনোযোগী। একে কীভাবে গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে এগিয়ে নেওয়া যায়? প্রথমেই শিক্ষাক্রম। বছর দশেক আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু বিভাগে সিলেবাস বা পাঠ্যক্রম প্রচলিত ছিল, যা কিনা নিছক পাঠ্য বিষয়ের তালিকা। বেশ কয়েকটি গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রকাশিত উদ্দেশ্য না থাকায় শিক্ষার্থীরা সিলেবাস অনুসরণ করে পড়াশোনায় আগ্রহ হারাচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উদ্যোগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উদ্দেশ্যভিত্তিক শিক্ষাক্রম উন্নয়নের কার্যক্রম আরম্ভ হয়। উদ্দেশ্যভিত্তিক শিক্ষাক্রমে কোর্স এবং প্রোগ্রামে উদ্দেশ্য, বিষয়বস্তু, শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি, মূল্যায়নের উপায়, বরাদ্দ সময় ইত্যাদি স্পষ্টভাবেই প্রকাশিত থাকে। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী শুরু থেকেই অবগত থাকেন, তারা কী পড়ছেন এবং ডিগ্রি শেষে তাদের গন্তব্যও পরিষ্কার।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এমনকি দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার্থীরা কোনো একটি বিভাগে পড়তে গেলে যথেষ্ট পরিমাণে বিকল্প নির্বাচন করতে পারেন। যেমন, গণিত বিভাগে সম্মান স্তরের একজন শিক্ষার্থী খুব সহজেই ইংরেজি সাহিত্য এবং সংগীত বিষয়ে মাইনর কোর্স নিতে পারেন। অর্থাৎ মূল কোর্সগুলো বাধ্যতামূলক রেখে অনেক সহায়ক কোর্সের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। এমনকি ক্রেডিট ঘণ্টা পূরণ করা সাপেক্ষে একাধিক মেজরও করতে পারেন। এটি কেবল শিক্ষার্থীর বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রমবিকাশ নয়, বরং জ্ঞান ও দক্ষতার জগতে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে উৎসাহ দেয়। আমাদের বড় আশা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের একটি বিভাগেই বন্দি না রেখে জ্ঞানের মুক্ত জগতে ঘুরে আসার সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। 

মুক্ত বিচরণ কি কেবল বিমূর্তভাবেই হয়? বৈশ্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা একাধিকবার এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে থাকেন। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা একাধিক সেমিস্টারে অংশগ্রহণ করে আসেন। এই পরিদর্শন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, নতুন শিক্ষক, নতুন সতীর্থ দেয় কেবল তা নয়; নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া শিখতেও শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং পাকিস্তানে এক্সচেঞ্জ শিক্ষার্থী পাঠানো শুরু করেছে। আমাদের জন্য তেমন কোনো চুক্তি করা হয়তো এখনও সম্ভব নয়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশের অভ্যন্তরেই অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমিস্টার পড়ে এবং কাজ করে আসলে কী আনন্দের বিষয়ই না হতো! তেমনই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের জ্ঞান এবং গবেষণার অভিজ্ঞতা বিলিয়ে দেওয়ার জন্য দু’এক সেমিস্টার ঘুরে যেতে পারেন।

আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির মূলমন্ত্র ছিল নির্বিঘ্নে নিজের প্রশ্নের উত্তর খোঁজা, অর্থাৎ কিনা গবেষণা। পরিতাপের বিষয়, একটি গবেষণানির্ভর প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গতি বড় মন্থর। তবে বাস্তবসম্মত পরিবর্তন প্রস্তাব করতে গেলে শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্য এবং মূল্যায়ন অংশে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। বিভাগ যদি শিক্ষার্থীকে মুখস্থকারী না বানিয়ে গবেষকে পরিণত করার উদ্দেশ্যে গ্রহণ করে, তবে প্রতিটি কোর্সের মূল্যায়ন তার একটি গবেষণার কাজ যাচাই করার মধ্য দিয়েই হওয়া উচিত। আরও সহজ করে বললে, ঘণ্টা তিনেকের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার বদলে একটি প্রমাণ আকারের গবেষণাকর্ম তৈরি করতে পারে। ঐ কোর্সটি সেমিস্টারজুড়ে যে তত্ত্ব বা বিষয়বস্তু পড়াবে, তার ওপরই প্রত্যেক শিক্ষার্থী নিজের আগ্রহ অনুযায়ী গবেষণা করবেন। এতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই তাদের অজানাকে খুঁজে বের করার প্রবণতা তৈরি হবে। সেই সঙ্গে প্রথম সেমিস্টার থেকেই গবেষণা পদ্ধতির ওপর অন্তত একটি করে কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা গেলে সোনায় সোহাগা। এতে সম্মান বা স্নাতকোত্তরের শেষে একটি মনোগ্রাফ বা থিসিস করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সক্ষমতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী থাকবেন। শিক্ষকরাও প্রশ্নপত্র প্রণয়নের জটিল প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত হবেন। 
স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্সে এক বছরে কেবল দুটি সেমিস্টারে অল্প কয়টি কোর্স এবং একটি থিসিস বা একটি শিক্ষানবিশি দিয়ে দায়সারা গোছে মাস্টার্স করে শিক্ষার্থীরা খুব উপকৃত হন না। পৃথিবীর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও এই এক বছরের মাস্টার্সকে অনার্সের বর্ধিতাংশ বলেই চিহ্নিত করেন। স্নাতকোত্তরটি যদি দুই বছরব্যাপী করে একটি বছর কোর্স এবং শিক্ষানবিশি এবং আরেকটি বছর সম্পূর্ণভাবে গবেষণার জন্য বরাদ্দ করে দেওয়া যায়, তবে শিক্ষার্থীরা একটি সামগ্রিক অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারবেন। সেই অভিজ্ঞতা কর্মজীবনে এমনকি ডক্টরেট অর্জনেও কাজে লাগাতে পারবেন। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কারকল্পে শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকদের ধারাবাহিক পেশাগত উন্নয়ন, আবাসিক সমস্যার সমাধান, ভর্তি পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়-কর্মক্ষেত্র সংযোগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সংলাপ প্রয়োজন। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকারের পরিচালনা পর্ষদে বিচক্ষণ উপদেষ্টামণ্ডলী রয়েছেন এবং তারা সার্বিক মঙ্গলের জন্যই সংস্কারের কাজ হাতে নিয়েছেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। তাদের কাছে আমাদের দাবি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রাজনৈতিক ঘাঁটি বানিয়ে না রেখে সত্যি সত্যি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হতে দিলে দেশেরই উপকার হবে। 

আসিফ বায়েজিদ: শিক্ষাক্রম ও শিক্ষানীতি গবেষক, যুক্তরাজ্য
bayezid777@gmail.com 


শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়