আলা উদ্দিন
আলা উদ্দিন
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ০০:০৯ | আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৫:০৩
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সফলতার ধারাবাহিকতায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে। গত ১৫ বছর, সামগ্রিকভাবে বললে, পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশে রাজনীতির অতিমাত্রায় দলীয়করণ হয়েছে। ফলে দুর্নীতি বৃদ্ধি, বাকস্বাধীনতার অবক্ষয় এবং রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে কৃত্রিম সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেওয়া হয়েছে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়েও রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা হয়েছে। এর ফলে তথাকথিত রাজনীতিবিদরা লাভবান হলেও সাধারণ জনগণ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ রাষ্ট্রের প্রায় সব খাতই ধ্বংসের মুখে পড়েছে। সুশাসন, ন্যায়বিচার, সাম্য এবং গণতন্ত্রের চর্চা কোথাও যথাযথ ছিল না। বিশেষ করে গত ১৫ বছরে এসব খাত প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
আমার মতে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হলো জনগণের ভোটের অধিকার তাদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া। গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন সত্যিকার অর্থে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটায়নি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণও ছিল সীমিত। এর ফলে সরকার বারবার জোরপূর্বক ক্ষমতায় থেকেছে। জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি অন্যান্য নির্বাচনের ক্ষেত্রেও যেমন সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে কোথাও কোনো জবাবদিহির স্থান ছিল না।
আমার বিবেচনায়, সব সমস্যার মূলকেন্দ্র হলো ভোটের অধিকার। জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হলে অনেক সমস্যার সমাধান সহজেই সম্ভব। যদি সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক দলগুলো ও জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক ভোট হতো এবং ভোটের মাধ্যমে সরকারসহ সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মেম্বার নির্বাচিত হতেন, তাহলে তাদের নির্দিষ্ট সময় পর, চার বা পাঁচ বছর পর জনগণের কাছে ফিরে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকত। এ পরিস্থিতিতে তাদের কাজকর্মে জনগণের স্বার্থ অন্তত ন্যূনতম পর্যায়ে হলেও নিশ্চিত থাকত। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সময়ে এমন পরিস্থিতি আংশিকভাবে হলেও লক্ষ্য করা গেছে। এর ফলে অবাধ দুর্নীতি, অবিচার, ব্যাংক ডাকাতি, বিদেশে অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার, লুটপাট ও সাধারণ জনগণকে উপেক্ষা করা– এসব থেকে দেশের মানুষ মুক্তি পেত।
যেহেতু ভোটের মাধ্যমে পুনর্নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা থাকত; শাসকদের মধ্যে দুর্নীতি, স্বৈরাচারী মনোভাব কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার এতটা গেড়ে বসত না। যদি সত্যিকার অর্থে জনগণের ভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচিত হতো এবং প্রতিনিধিত্ব জনগণের ওপর নির্ভরশীল থাকত, তাহলে পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর এতটা নির্ভর করতে হতো না। তাতে সরকারবিরোধী আন্দোলন কিংবা সমালোচনার বিরুদ্ধে বানানো আইন প্রয়োগ করে সাধারণ মানুষকে দমন কিংবা গুলি চালানোর পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতো না।
যদি এই পরিস্থিতি সৃষ্টি না হতো, তাহলে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগ এভাবে পতনের মুখোমুখি হতো না। যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ ও লালন করেন; যারা পালিয়ে যাননি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কোনো সুবিধা নেননি, তারাও আজ নানা রকম অপদস্থ হচ্ছেন এবং অন্তত মানসিক যাতনার মধ্যে রয়েছেন। আমি ভোটাধিকার হরণের এই পরিণতি নিয়ে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে, যারা সরকারদলীয় এবং বিরোধী দলের সমর্থক, আগেও অনেকবার আলোচনা করেছি।
আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আমলাতন্ত্রসহ দুর্নীতি, ব্যাংক ডাকাতি, অর্থ পাচার, জবাবদিহির অভাব, বাকস্বাধীনতা হরণ এবং সমাজে চরম বৈষম্য– এসব সমস্যার মূল সমাধান জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার মধ্যে নিহিত।
তবে এই ভোট কেবল লোক দেখানো বা কারসাজির মাধ্যমে হওয়া যাবে না। ভোট হতে হবে এমন, যেখানে সত্যিকারের প্রতিযোগিতা থাকবে এবং প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত থাকবে। এমনকি যদি কোনো দল অংশগ্রহণ না করে, তাতেও সমস্যা হবে না, যদি ভোটের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট অনুপাতের আইনি বাধ্যবাধকতা থাকে।
উদাহরণস্বরূপ সম্প্রতি ইরানে প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দু’বার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কারণ, প্রথমবারে কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশ ভোট লাভ করতে পারেননি। ফলে অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে ফের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং মাসুদ পেজেশকিয়ান দ্বিতীয় দফায় ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশেও যদি এমন একটি বিধান করা যায়– জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনে কমপক্ষে ৬০ শতাংশ (উদাহরণস্বরূপ) ভোটারকে ভোট দিতে হবে এবং বিজয়ী প্রার্থীকে ৪০-৫০ শতাংশ ভোট পেতে হবে, তাহলে কোনোভাবে কারসাজির মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না।
সর্বোপরি যদি নিশ্চিত করা যায় যেসব ক্ষমতার উৎস জনপ্রতিনিধি এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া, তাহলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে সমাজ থেকে দুর্নীতি, বৈষম্য, ব্যাংক ডাকাতি, প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাৎ, দলীয়করণসহ সব অপকর্ম বন্ধ হবে। কারণ ক্ষমতায় আসার একমাত্র পথই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়া। এই শর্ত আইনের মাধ্যমে শক্তভাবে প্রয়োগ করা গেলে গণতন্ত্রের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি। অন্যান্য সমস্যাও এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চর্চার মাধ্যমে সমাধান হবে। তাই আমি বর্তমান সরকারকে ভোটের অধিকার এবং (আইনের মাধ্যমে) আনুপাতিক ভোটের মাধ্যমে বিজয়ের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানাই।
ড. আলা উদ্দিন: অধ্যাপক ও প্রাক্তন সভাপতি, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়