Wednesday, September 25

স্বাস্থ্য খাতের সমৃদ্ধিতে ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা

 স্বাস্থ্য খাতের সমৃদ্ধিতে ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফার্মাসিস্টরা স্বাস্থ্য খাতে সরাসরি রোগীর সেবায় যুক্ত থেকে অবদান রাখছেন

মো. রবিউল ইসলাম

 প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ১৭:২০


প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস পালিত হয়। ফার্মেসি পেশায় কর্মরতদের উৎসাহ প্রদান এবং এই পেশা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতেই ২০১০ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এবারের বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবসের প্রতিপাদ্য– ‘ফার্মাসিস্ট: বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য চাহিদা মেটাচ্ছেন’। এবারের প্রতিপাদ্যে এটি স্পষ্ট, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফার্মাসিস্টরা স্বাস্থ্য খাতে সরাসরি রোগীর সেবায় যুক্ত থেকে অবদান রাখছেন। যদিও বাংলাদেশের ওষুধশিল্পে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা বিপ্লব করলেও স্বাস্থ্য খাতে সরাসরি রোগীর সেবা করার সুযোগ পাচ্ছেন না। 


দেশের চিকিৎসাসেবা বলতে আমরা শুধু ডাক্তার আর নার্সকেই বুঝি। অথচ পরিপূর্ণ চিকিৎসাসেবা পেতে হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন হচ্ছে– ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, নার্স ও টেকনিশিয়ানকে একসঙ্গে রোগীর সেবা দিতে হবে। যেখানে দেশের সাধারণ মানুষকে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট ব্যতীত চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। যদিও স্বাস্থ্য খাতে ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, রোগীদের পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে এটা বাস্তবসম্মত নয়; কারণ ওষুধের বিষয়ে একজন রোগীর যেসব বিষয় জানা প্রয়োজন, তা সঠিকভাবে জানানো যাচ্ছে না। যেমন– ওষুধ গ্রহণের মাত্রা, ওষুধের কার্যকারিতা, ওষুধের সঠিক ব্যবহার, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ওষুধে-ওষুধে প্রতিক্রিয়া, ওষুধে-খাদ্যে প্রতিক্রিয়া, থেরাপিউটিক ডুপ্লিকেসি ইত্যাদি। এসব বিষয় সাধারণ মানুষকে জানাতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট ছাড়া আর কে আছে? কারণ ডাক্তার রোগ নির্ণয় করে দেওয়ার পর রোগী যে ওষুধ গ্রহণ করে আরোগ্য লাভ করে, তা কিন্তু একজন গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টের হাতে তৈরি হয়। 
কয়েকটি দৃশ্যপট কল্পনা করা যাক।


এক. আগে থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ সেবনকারী একজন নারীর ব্যবস্থাপত্রে অ্যামোক্সিসিলিন দেওয়া হলো। রোগী ব্যবস্থাপত্র নিয়ে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনে বাসায় গেলেন এবং রাতে খাওয়ার পর অ্যামোক্সিসিলিনের সঙ্গে জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ সেবন করলেন। যেহেতু অ্যামোক্সিসিলিন জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়, সেহেতু জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ সঠিকভাবে কাজ না করলে রোগীর কী অবস্থা হবে? 


দুই. একইভাবে আরেকজন রোগীর ব্যবস্থাপত্রে সিপ্রোফ্লক্সাসিন দেওয়া হলো, রোগী অ্যান্টিবায়োটিকের সম্পূর্ণ কোর্স ফার্মেসি থেকে কেনেন। কারণ রোগী জানেন অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ করতে হয়। কিন্তু সিপ্রোফ্লক্সাসিন খাওয়ার সঙ্গে দু্‌ধও খেলেন; কারণ পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, অ্যান্টিবায়োটিক খেলে শরীর দুর্বল হয়ে যায়। দুধ সিপ্রোফ্লক্সাসিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। সিপ্রোফ্লক্সাসিন সঠিকভাবে কাজ না করলে রোগী কীভাবে সুস্থ হবেন? এতে এই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং রোগী সুস্থ না হলে ডাক্তার এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোকে দোষারোপ করা হয়।
অ্যামোক্সিসিলিনের সঙ্গে জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ এবং সিপ্রোফ্লক্সাসিনের সঙ্গে দুধ সেবন করা যাবে না– এটা রোগীকে কে বলবে? রোগীর এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে হবে? 


তিন. দেশের অনেক রোগীর ব্যবস্থাপত্রে মূল চিকিৎসার বাইরে বিভিন্ন ওষুধ যোগ করা হয় (যদিও কিছু ব্যবস্থাপত্র ভিন্ন), যেগুলোর মধ্যে অধিকাংশ ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের অযৌক্তিক ব্যবহার দেখা যায়। বাংলাদেশের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে যে পরিমাণ ওষুধের অযৌক্তিক ব্যবহার হচ্ছে, তাতে সাইড ইফেক্ট ও অ্যাডভার্স ইফেক্টে সাধারণ মানুষ দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অথচ যথাযথ গাইডলাইন মেনে কাজ করলে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রোধ করা সম্ভব। 
উপরোক্ত তিনটি দৃশ্যপট ছাড়াও বাংলাদেশে এমন হাজারো ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে, কিন্তু তা সমাধানে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ঠিক এ কারণেই ক্রমান্বয়ে দেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের হার বাড়ছে এবং বাংলাদেশিদের বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার প্রবণতাও দিন দিন বাড়ছে।


বিশ্বের বহু দেশে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা এ ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করছেন ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি, হাসপাতাল ফার্মেসি এবং কমিউনিটি বা রিটেইল ফার্মেসির নামে। বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টরা কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। গবেষণায় দেখা গেছে ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি, হাসপাতাল ফার্মেসি এবং কমিউনিটি বা রিটেইল ফার্মেসিতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োজিত থাকলে বিভিন্ন অসংক্রামক রোগে (ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, হৃদরোগ ইত্যাদি) দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ গ্রহণে যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তা ৬৭ শতাংশ কমানো সম্ভব। সুতরাং স্বাস্থ্য খাতে সরকারিভাবে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের অন্তর্ভুক্তকরণ যে কতটা জরুরি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।  


স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরেও পরিপূর্ণ চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। আমাদের রোগ হলে সাধ্যের মধ্যে ওষুধ পাচ্ছি ঠিকই কিন্তু ওষুধের যথাযথ ব্যবহার করতে পারছি না। তাই স্বাস্থ্য খাতকে সমৃদ্ধকরণের জন্য জরুরিভাবে ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি, হাসপাতাল ফার্মেসি এবং কমিউনিটি ফার্মেসিগুলোতে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দিয়ে তাদের অর্জিত জ্ঞানকে জনগণের পরিপূর্ণ চিকিৎসা সেবায় কাজে লাগানোর জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বাধীন দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টার কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি। 

মো. রবিউল ইসলাম: ফার্মাসিস্ট; হেড অব ফার্মেসি, ইবনে সিনা হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা
robiulislam255@gmail.com


শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়