অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের ধারাবাহিকতায় বৈঠক করে বেরিয়েছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও খেলাফত মজলিসের নেতৃবৃন্দ।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে বৈঠকে অংশ নেন মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক ও যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জালাল উদ্দিন।
এছাড়া অপর অংশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আবদুল বাছিত আজাদের নেতৃত্বে দলটির মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আব্দুল কাদের, নায়েবে আমির মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জাহাঙ্গীর হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব মুনতাসীর আলী ও প্রশিক্ষন বিষয়ক সম্পাদক কাজী মিনহাজুল ইসলাম মিলন বৈঠকে অংশ নেন।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে উভয় দল নির্বাচন, রাজনীতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও আইন-প্রশাসনসহ বেশ কিছু বিষয়ে নিজেদের প্রত্যাশা ও সংস্কার প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
বাংলাদেশে খেলাফত মজলিসের পক্ষ থেকে ৬ দফা দাবি প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান দলটির মহাসচিব ও আলোচিত হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হক।
যা ছিল তাদের দাবি:
১. প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা:
ক. নির্বাচন সংক্রান্ত সংস্কার: জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগকারীদের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা। সেজন্য আসনভিত্তিক বিজয়ী সংসদ সদস্যদের বাইরে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সংসদে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা।
খ. নির্বাচনবিধি সংক্রান্ত সংস্কার: প্রার্থীদের নিজস্ব প্রচারণার পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রচার ও প্রকাশনার ব্যবস্থা করা। যোগ্য, সৎ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা।
২. সাংবিধানিক সংস্কার:
ক. বর্তমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া একচ্ছত্র ক্ষমতা স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেয়। তাই এ ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ভারসাম্য সৃষ্টি করা।
খ. দুই মেয়াদের বেশি একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা বন্ধ করা।
গ. প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দলীয় পদ থেকে পদত্যাগের বিধান করা।
ঘ. সংসদ সদস্যদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেওয়ার সুযোগ রাখা।
৩. বিচারব্যবস্থার সংস্কার:
ক. বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করা। বিচার বিভাগে সরকারের হস্তক্ষেপমুক্ত রাখার স্বার্থে বিচারপতি নিয়োগ ও বিয়োগের জন্য জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করা।
৪. শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করা: শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিতর্কিত বিষয়গুলো বাদ দিয়ে ধর্মীয় ও নৈতিকতা শিক্ষা সংযোজন করা।
৫. পুলিশ ও প্রশাসন: পুলিশ ও প্রশাসনকে সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের ব্যবহারের পথ বন্ধ করা।
৬. ধর্মীয় আইন: কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী আইন ও নীতি প্রণয়ন না করা।
এদিকে বৈঠকে খেলাফত মজলিসের পক্ষ থেকে ১২ দফা দাবি ও ৭ দফা সংস্কার প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে।
যেসব দাবি তুলে ধরা হয়েছে:
১. মানবতাবিরোধী ও গণহত্যাকারী খুনী হাসিনাকে দ্রুত দেশে এনে বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা এবং স্বৈরাচারের দোসর, লুটেরা ও দুর্নীতিবাজদের ‘বিশেষ ট্রাইবুনালে’ দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
২. ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকালে শহীদ, চিরতরে অক্ষম ও আহতদের দ্রুত তালিকা প্রণয়নপূর্বক ক্ষতিগ্রস্তদের অবস্থা অনুযায়ী আশু ও ক্ষেত্র বিশেষে দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা এবং আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে জুলাই বিপ্লবে শহীদদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণা করতে হবে।
৩. দেশের ধ্বংসপ্রায় বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগ, প্রশাসনিক বিভাগ, অর্থ ও ব্যাংকিং বিভাগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগসহ সকল বিভাগকে দ্রুত সংস্কারের আওতায় এনে মানুষের কল্যাণে কর্মক্ষম করে তুলতে হবে।
৪. দেশের আইন সভা-জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনিক বিভাগ যেনো স্বাধীনভাবে ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সমন্বয় করে স্বার্থক ও সুন্দরভাবে চলতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে।
৫. ভারতের সেবাদাস পতিত হাসিনা সরকারের সাথে ভারতের সম্পাদিত সকল চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন এবং দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল ও ক্ষেত্র বিশেষে চুক্তির ধারা সংশোধন করতে হবে।
৬. বিডিআর হত্যাকাণ্ডের অপ্রকাশিত তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ, প্রয়োজনে নতুন তদন্ত কমিশন গঠন এবং প্রকৃত দায়ীদের সনাক্ত করে দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। একই সাথে শাপলা চত্ত্বর হত্যা, সাগর-রুনি হত্যা, ‘আয়না ঘর’ কাণ্ডসহ সকল গুম ও খুনের যথাযথ বিচার করতে হবে।
৭. রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও দমন-পীড়নের উদ্দেশ্যে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মী, আলেম-উলামাসহ বিরোধী মতের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সময়ে দায়েরকৃত সকল মিথ্যা মামলা দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে।
৮. জুলাই বিপ্লবের মূল নিয়ামক ছাত্র-জনতার ঐক্যকে সংহত ও এগিয়ে নিতে হবে। বিপ্লব বিরোধী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে গড়ে উঠা ঐক্যকে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। দেশের স্বাধীনতা- সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আরো আধুনিক ও শক্তিশালী করা এবং সক্ষম সকল নাগরিককে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. দ্রুত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে দ্রব্যমূল্য কমানো, ভারতের পানি আগ্রাসন মোকাবিলা ও পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
১০. বিপ্লব পরবর্তী পরিস্থিতির উপর দ্রুত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, সংস্কার কার্যক্রম জোরদার এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে যৌক্তিক দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
১১. আওয়ামী দলীয় ক্যাডারদের হাতে থাকা সকল বৈধ-অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১২. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।
খেলাফত মজলিসের সংস্কার প্রস্তাবে যা রয়েছে:
১. সরকার ব্যবস্থায় সংস্কার: দেশের বর্তমান ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকে যে ব্যাপক ক্ষমতা ও স্বেচ্ছাচারী হওয়ার প্রভূত সুযোগ দেওয়া হয়েছে তা দূরীকরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বিধান করতে হবে। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি কেউই যেন একাধিক্রমে দুই মেয়াদের বেশী স্বপদে থাকতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি দলীয় প্রধান থাকতে পারবেন না।
২. নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার: অবিলম্বে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একইসঙ্গে দীর্ঘ মেয়াদে দল নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা চালু করা। সৎ ও যোগ্য প্রার্থীরা যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে সেজন্যে নির্বাচনী ব্যয় কমানো, শুধু নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে প্রার্থীদের নির্বাচনী সভার আয়োজন করা এবং অর্থ ও পেশী শক্তির দাপট নিবারণ-সহ সকল অব্যবস্থাপনা দূর করতে হবে। নিম্ন কক্ষে সংসদীয় আসন ৫০০ তে উন্নীত করার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারী দল থেকে স্পীকার ও বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পীকার করতে হবে।
৩. স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার সংষ্কার: স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তাকে স্থানীয় উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিভাগ স্থানীয় সরকারের অধীনে দিতে হবে। সংসদ সদস্যগণ যাতে দেশের আইন ও নীতি প্রণয়নের কাজে ব্যস্ত থাকেন ও স্থানীয় সরকারের কাজে কোনরূপ হস্তক্ষেপ না করেন তার কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
৪. প্রশাসনিক সংষ্কার: সীমাহীন দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনের সর্বস্তরে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার যে প্রচণ্ড ক্ষতের সৃষ্টি করে গেছে তা দ্রুত দূর করার জন্য প্রশাসনিক সংষ্কার কমিশন গঠন করে জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনসহ সর্বত্র সুষ্ঠু নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠা ও শৃঙ্খলা বিধান নিশ্চিত করতে হবে যাতে প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
৫. অর্থ ও ব্যাংক ব্যবস্থা সংস্কার: দুর্নীতিবাজ মাফিয়া হাসিনা সরকার দেশের সামগ্রীক অর্থনীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থায় যে সীমাহীন দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা ও দূরাবস্থা সৃষ্টি করেছে দ্রুত আর্থিক সংস্কার কমিশন গঠন করে তা উত্তরণে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও ইতিবাচক ও আস্থার পবিবেশ দ্রুত ফিরিয়ে আনতে হবে। দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রণয়নে গঠিত জাতীয় কমিটি যাতে দ্রুত তা প্রণয়ন ও প্রকাশ করে তার ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে।
৬. শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার: দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে মানসম্মত নৈতিক, কারিগরী ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে দ্রুত শিক্ষা কমিশন গঠন, নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তণ এবং চলমান শিক্ষানীতি ও ক্রম বাতিল করতে হবে।
৭. আইনী সংস্কার: ব্যাপকভাবে সমালোচিত বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল, আইসিটি ও ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট সংশোধন এবং অনাস্থা প্রস্তাব ও বাজেট প্রস্তাব পাশের ক্ষেত্র ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রয়োগের ধারা বাতিল করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত করার জন্য ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার প্রবর্তিত বিচারপতি অভিশংসন আইন বাতিল করতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে প্রতিটি প্রশাসনিক বিভাগে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপন করতে হবে।
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়