Saturday, July 6

বরাক পারের বয়ান : নতুন যুগের প্রথম দলিল


সরওয়ার ফারুকী::

“আজি হতে শতবর্ষ পরে

কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি

কৌতূহলভরে—

আজি হতে শতবর্ষ পরে।”
বিশ্বকবির অমর আকুতির মতো শতবর্ষ পরের কৌতূহলী কোনো পাঠক যদি আজকের (২০২২-২৪ খ্রি:) সময়ের কানাইঘাট-জৈন্তাপুরের সমাজ-জীবন জানতে চান— তাঁর জন্য ‘বরাক পারের বয়ান’ নিঃসন্দেহে অদ্ভুত এক অমৃতসুধা। অতীতের প্রতি উঁকি দেওয়া মানুষের সহজাত বৃত্তি, কেউ-না-কেউ এসে উঁকিঝুকি করবে; অতীতকালের খোঁজখবর নিবে— তার জন্যই দুনিয়ার কবিগণ কোনো-না-কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান, কোনো রক্তরাগ—অনুরাগে সিক্ত করে পাঠাচ্ছেন তাহাদের তরে।
বরাক পারের বয়ান— সুনির্দিষ্ট এলাকায় যাপিত জীবনের প্রথম এবং প্রত্যক্ষ দলিল। সুনির্দিষ্ট এ এলাকা হচ্ছে কানাইঘাট ও জৈন্তাপুর। এ দু উপজেলার সামাজিক ইতিহাসের এমন দলিল অতীতকালে কেউ রচনা করেননি, এজন্য এ বই নতুন ইতিহাসের প্রথম ফলক— যেখান থেকে যাত্রাপথের আরও অনেক ফলক যুক্ত হবে অনাগত কোনো বয়ানকারীর মাধ্যমে। কোনো ঘটনা, বিষয় যত মহৎ কিংবা বৃহৎ হোক— তা যদি কলমের ছোঁয়ায় কাগজের পাতায় না-ওঠে তাহলে তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বা মাহাত্ম্য তৈরী হয় না। খ্যাত কিংবা অখ্যাত কোনো লেখকের আলতো ছোঁয়া ব্যতীত মানুষের ইতিহাস গঠিত হয় না; লেখকরাই রিলে রেইসের মতো মানব সভ্যতাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছান।
কানাইঘাট ও জৈন্তার আধুনিক ইতিহাস দীর্ঘ নয়, অথচ নাতিদীর্ঘ এই ইতিহাস পাঠের ক্ষেত্রেও রয়েছে বিপুল তথ্য-ঘাটতি। এজন্য, কলোনিয়াল যুগের ঐতিহাসিক আলবার্ট গেইট থেকে এই সময়ের ‘কিশোর কানাইঘাট’ পর্যন্ত প্রকাশিত বইগুলোর সূচিপত্র ঘুরেফিরে একরকম, বিষয়বৈচিত্রহীন। এই প্রথম এ অঞ্চলের ইতিহাস পাঠে বিষয়বৈচিত্র যুক্ত হয়েছে, যুক্ত করেছেন বরাক পারের বয়ান বইয়ের লেখক এহসানুল হক জসীম। এ অঞ্চলের ইতিহাস বুঝতে আমরা যেসকল বইয়ের উপর নির্ভর করি— সেসকল বই সংকলিত— যা শ্রুতি, স্মরণ কিংবা বর্ণনানির্ভর। স্বাভাবিকভাবেই ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে সেসকল বইয়ের তথ্য-ঘাটতি, বিভ্রান্তি, স্থান-কালের অসংগতি সচেতন মহলকে পীড়িত করে। এ অঞ্চলে অতীতকালের কোনো মনিষীর আত্মকথন, সাক্ষাৎকার কিংবা সফরনামা না-থাকায় স্থান-কাল-পাত্রনির্ভর নানান মিথ জমে উঠছে। এ অঞ্চলের কবি, লেখক, গবেষক বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আত্মজীবনী, সাক্ষাৎকার বা স্মৃতিচারণমূলক কোনো লেখা নেই— তাই, অঞ্চলের সামাজিক ইতিহাস অন্ধকারের রূদ্ধ কপাটে আবদ্ধ, এই প্রথম কেউ একজন সেই রূদ্ধ কপাটের খিল খুললেন— তিনি হলেন এহসানুল হক জসীম! এহসানুল হক জসীম পেশায় সাংবাদিক, স্বীকৃত একজন গবেষকও। তিনি ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ জাতীয় সম্মাননা-২০২৩’ পদকপ্রাপ্ত। ইতিপূর্বে তার লেখা 'ইসলামী রাজনীতির ব্যবচ্ছেদ' নামক বইটি এ দেশের ইসলামী রাজনীতির চিত্র-চরিত্র বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বরাক পারের বয়ানে লেখক তিনটি পরিশিষ্ট সহ মোট আটান্নটি অধ্যায়ে আলোচনা সঞ্চালন করেছেন। সূচীপত্রের ৯-১০ ও ১৭ থেকে ২০, কিংবা ২১-২২ অধ্যায়ের বিষয়বস্তুর মধ্যে যোগসূত্র থাকায় অধ্যায়সূচী আটান্ন হলেও তা তিপ্পান্নটি বিষয়সূচির মধ্যে চলে এসেছে। বাদবাকী বিষয়সূচী সম্পূর্ণ আলাদা বা পরস্পর সম্পর্কহীন, এতে বইয়ের মান কিংবা গুণ ক্ষুন্ন হয়নি, বরং সৌন্দর্য বেড়েছে। এ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘শতবর্ষে কানাইঘাটের লড়াই’— এই একটিমাত্র অধ্যায় নানান সময় নানানভাবে নানান বইয়ে আলোচিত হয়েছে, এছাড়া বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ের আলোচনা একেবারেই নতুন এবং বিষয়সমূহ বৈচিত্রে পূর্ণ। লেখকের দেওয়া শিরোনামগুলোও মনকাড়া, শৈল্পিক, কবিতার মতো ছন্দময়। উদাহরণ: যদি কানাইঘাটকে জানতে সাধ হয়/তুমিও স্বৈরাচার, তুমিও জালিম/ তারে ফুল দিতে যেন ভুলে না যাই/ সুরম্য মসজিদের ইমামের বেতন কত?/স্মরণের আবরণে মরণেরে যত্নে রাখি ঢাকি/ ফুসতাত থেকে দুবাই— প্রতিটি শিরোনামই মন ছুঁয়ে যায়, আঘাত করে, ভেতর দেখার খায়েশ জাগায়।
এ বইয়ের আলোচ্য বিষয়সমূহ আমাদের নিত্যদিনের ঘটনাপর্ব। চারপাশে আমরা যা দেখি, যা করি, যেসকল সুখ-দুখের সঙ্গে আমাদের নিত্যদিনের বসবাস— সেসবই বইয়ের আলোচ্য বিষয়। কেমন চলছে এ সমাজ, কী তার রোগবালাই, কেমন তার সুখ-দুঃখের ধরণ— তা জানতে এ বইয়ের পাঠ অপরিহার্য। এভাবে, আপন সময়ের সমাজচিত্রের বয়ান এ অঞ্চলের কেউ কখনো লিখেন নি— এখানেই এ বই অনন্য। ভবিষ্যতে যে বা যারা এ অঞ্চলের ইতিহাস চর্চা করবেন— তাদের কাছে এ বই অমূল্য, চলতি দিনের দর্পণ, আগামী দিনের চোখ। তাই, দিন যত যাবে এ বইয়ের মূল্য তত বাড়বে। দুই-চার প্রজন্মের পরবর্তী পাঠকের কাছে এ বই এমন এক টাইম মেশিন— যার মধ্য দিয়ে পূর্বযুগের সময়চিত্র দেখা যাবে!
বইয়ের শেষাংশে জুড়ে দেওয়া পরিশিষ্টের তিনটি অধ্যায় বড়ই বেমানান— যদিও অধ্যায়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পরিশিষ্টের তিনটি অধ্যায় নিয়ে আলাদা তিনটি বই করা যেত, এতে ইতিহাস সমৃদ্ধির পাশাপাশি অনেক আবর্জনাও দূর হতো। লেখকের হাতে যত তথ্য, তত্ত্ব কিংবা সওয়াল-জওয়াব রয়েছে তাতে প্রতিটি বই আকর গ্রন্থের মর্যাদা পেত নিঃসন্দেহে। গবেষক এহসানুল হক জসীমের কাছে এমন প্রত্যাশা বাড়াবাড়ি নয়।
পরিশিষ্ট-১-এ আল্লামা মুহাম্মদ মুশাহিদ বাইয়মপুরির কর্মচঞ্চল জীবনের চিত্র এঁকেছেন তিনি। মুহাম্মদ মুশাহিদ বাইয়মপুরির জীবনচরিত্রে সেঁটে দেওয়া প্রচলিত মিথ সমূহের বাইরে গিয়ে তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও দার্শনিক সত্ত্বা ফুটিয়ে তোলবার চেষ্টা করেছেন। লেখকের এ প্রচেষ্টা মুশাহিদ বাইয়মপুরিকে বোঝার ক্ষেত্রেও মাইলফলকের ভূমিকায় থাকবে।
একইভাবে, পরিশিষ্ট-২-এ লেখক ‘কানাইঘাটের মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামে একটি অধ্যায় যুক্ত করেছেন— যা কানাইঘাটের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠের জন্য অনন্য এক দলিল। কানাইঘাটের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠে এরচেয়ে সমৃদ্ধ প্রবন্ধ আগে আর রচিত হয়নি।
পরিশিষ্ট-৩-এর শিরোনাম ‘সিলেট-৫ : একাল সেকাল’। এ অধ্যায়ে লেখক এই সংসদীয় আসনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পরিচয় এনেছেন। ভারতবর্ষের প্রথম প্রত্যক্ষ ভোটের ফলাফল থেকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ীদের উপর কিঞ্চিৎ আলোকপাত করেছেন— এতে এ আসনের ব্যাপারে সাধারণ পাঠকের ধারণা সমৃদ্ধ হবে।
বইয়ের নামকরণ নিয়ে এ প্রজন্মের অনেকেই ধাঁধায় পড়বেন। কোন নদীর নাম যে বরাক— তা অনেকেই হয়তো জানেন না। সুরমা-কুশিয়ারা নদীর উৎসমূল হচ্ছে বরাক নদী যা বর্তমান ভারতের অংশ। জকিগঞ্জ উপজেলার আমলশিদ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় বরাক নদী সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দু ভাগ হয়েছে। এই ভাগ-মুখে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই বেড়াতে যান, আনন্দ ভাগাভাগি করেন। কিন্তু এ অঞ্চলের সামাজিক জীবনযাত্রায় বরাক নামের কোনো ধ্বনি-প্রতিধ্বনি নেই, তাই নামকরণের যৌক্তিকতা বুঝাতে বইয়ের ভূমিকায় লেখককে কোর্টকাছারির ব্যাখ্যা এনে যুক্ত করতে হয়েছে। নামকরণ আর পরিশিষ্টের ছন্দপতন ছাড়া এই বইয়ের আপাদমস্তক মনোলোভা, সচেতন পাঠকের মনের খোরাক।
বরাক পারের বয়ানে ইতিহাস আছে, স্মৃতি আছে, দুঃখ-শোকের প্রবাহ আছে, আশা-নিরাশা, মান-অভিমানের দ্বন্ধ আছে, অসঙ্গতির প্রতি গর্জন আছে। এ বইয়ে ক্রোধ আছে, সমীহ আছে, কবির মনের মতো রোমান্টিকতা আছে, সর্বোপরি— সমাজ-দরদী এক লেখকের দরদের সুস্পষ্ট স্বাক্ষর আছে।
তিনটি পরিশিষ্ট সহ আটান্নটি অধ্যায়ে বিভক্ত এ বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা ২৬১। প্রকাশক: কানাইঘাট ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদ। যুতসই প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী জাহেদ হোসাইন রাহিন। ঢাকা থেকে ছেপে আনা এ বইয়ের ছাপায় বেশ দুর্বলতা রয়েছে, বাঁধাই মানহীন, কাটিং ত্রুটিপূর্ণ— এ সবই লেখকের তাড়াহুড়োর সুস্পষ্ট প্রমাণ। তবে, ইতিহাসের অনন্য এই দলিল নির্মাণে লেখকের তাড়াহুড়োর ত্রুটি হয়তো ক্ষমা করাই যায়!

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়