ইলিয়াস মশহুদ::
আলেম-উলামার অঞ্চল নামে খ্যাত সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলা একটি আলোকিত জনপদ। এ জনপদে জন্মগ্রহণ করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম ও সমাজ সংস্কারকরা। তাদেরই একজন হলেন মাওলানা মুহাম্মদ বিন ইদ্রিস লক্ষ্মীপুরী। বৃহত্তর সিলেটের সর্বসাধারণের কাছে সমাদৃত আস্থাভাজন বুজুর্গ। শায়খে লক্ষ্মীপুরী নামে খ্যাত বহুমাত্রিক দ্বীনি খেদমতে নিবেদিত এই বুজুর্গকে নিয়ে লিখেছেন ইলিয়াস মশহুদ
যুগে যুগে আল্লাহতায়ালা এমন কিছু মহান ব্যক্তিকে পৃথিবীতে পাঠান, যারা আল্লাহর দ্বীনের অনুসারীদের শিরক, বিদআত ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে সরল-সঠিক ও নির্ভেজাল পথের নির্দেশনা প্রদান করেন। এ সব মনীষীর মধ্যে আলেমকুল শিরোমনি, দেশ ও ইসলামের তরে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব, আধ্যাত্মিক জগতের ধ্রুবতারা মাওলানা মুহাম্মদ বিন ইদ্রিস লক্ষ্মীপুরী অন্যতম একজন। তিনি শায়খে লক্ষ্মীপুরী নামে খ্যাত।
মাওলানা মুহাম্মদ বিন ইদ্রিস লক্ষ্মীপুরী নববি চরিত্রের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। পূর্ববর্তী আলেম-উলামাদের পদাঙ্ক অনুসারী। সাহাবি আদর্শের উজ্জ্বল নমুনা। সরল-সঠিক পথের গগনচুম্বী মিনারা। দৃঢ় সংকল্প আর হিম্মতের ওপর পর্বতসম অটল। ভ্রষ্টতার আঁধারে আচ্ছন্ন সমাজে প্রদীপ্ত মশাল। তাকওয়া ও আত্মশুদ্ধির মূর্ত প্রতীক। তিনি আলেম সমাজের উজ্জ্বল এক নক্ষত্র। বৃহত্তর সিলেটের সর্বসাধারণের কাছে সমাদৃত আস্থাভাজন এক প্রবাদতুল্য বুজুর্গ। তিনি একাধারে একজন মাদ্রাসা পরিচালক, শায়খুল হাদিস ও বহুমাত্রিক দ্বীনি খেদমত আঞ্জাম দানকারী এবং আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী (রহ.)-এর সার্থক উত্তরসূরি।
শায়খুল ইসলাম সাইয়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর চারণভূমি, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বসতভূমি সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপুরী গ্রামে ১৯২৪ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মাওলানা ইদ্রিস আহমদ (রহ.) ও মা নুরুন্নেসা খানম। জন্মের পর বাবা-মা আদর করে তার নাম রাখেন মুহাম্মদ।
পিতা মাওলানা ইদ্রিস (রহ.) একজন ধীমান আলেম ছিলেন। ঐতিহ্যবাহী কানাইঘাট মাদ্রাসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। বিচক্ষণ এই আলেম ১৯২২ সালের কানাইঘাটে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় তিনি এই মাদ্রাসার মুহতামিম ছিলেন এবং যুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী (রহ.) সহ বহু জ্ঞানী-গুণীর শিক্ষক ছিলেন তিনি।
তার বয়স যখন মাত্র তিন বছর, তখন পিতা মাওলানা ইদ্রিস (রহ.) ইন্তেকাল করেন। পিতৃহারা সন্তান মায়ের স্নেহ মমতায় লালিত-পালিত হন ও তারই তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক লেখাপড়ার হাতেখড়ি। এরপর গ্রামের সাবাহি মক্তব (সকালের মক্তব) আরবি শিক্ষাগ্রহণ করে বায়মপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে লেখাপড়া করেন। এরপর মাওলানা মুফতি ফয়জুল হক (রহ.) তাকে লালারচক রহমানিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। শিশুকালে পিতৃহারা হওয়ার কারণে একটু দেরিতে তিনি মাদ্রাসায় যান। এখানে তিনি শরহে জামী (আলিয়া সুওম) পর্যন্ত অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে লেখাপড়া করেন। ১৯৫৩ সালে আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী (রহ.) কানাইঘাট মাদ্রাসায় চলে এলে ১৯৫৭ সালে তিনিও চলে আসেন কানাইঘাট দারুল উলুম মাদ্রাসায়। ভর্তি হন মুখতাসারুল মাআনি জামাতে। মুখতাসার থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত অত্যন্ত সুনাম ও সুখ্যাতির সঙ্গে লেখাপড়া করে ১৯৬২ সালে তাকমিল ফিল হাদিস পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ অধিকার করে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। তা ছাড়া প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে ঈর্ষণীয় ফলাফল অর্জন করেন।
সাধারণত যারা ছাত্রজীবনে লেখাপড়ায় মেধাবী ও ভালো হন, সুন্নতের ওপর যতœশীল ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী হন, সেসব ছাত্রকে শিক্ষকরা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের উস্তাদ হিসেবে নিয়োগ দিতে খুবই আগ্রহী হন। মাওলানা লক্ষ্মীপুরীর বেলায় তাই হয়েছে। তিনি দাওরায়ে হাদিস সমাপনের পর আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী (রহ.) তাকে কানাইঘাট দারুল উলুমে শিক্ষক হিসেবে দেন। কানাইঘাট মাদ্রাসাই তার ছাত্রজীবনের শেষ অধ্যায় এবং এখানেই কর্মজীবনের সূচনা। যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস স্বীয় উস্তাদদের সঙ্গে অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে পাঁচ বছর শিক্ষকতা করেন এখানে। এরপর আল্লামা বায়মপুরী (রহ.) তাকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুশাহিদিয়া খাগাইল মাদ্রাসায় সদরুল মুদাররিস হিসেবে পাঠিয়ে দেন। এখানে তিনি অত্যন্ত সুনাম ও সুখ্যাতির সঙ্গে তিন বছর শিক্ষকতা করেন। ১৯৭০ সালে আল্লামা বায়মপুরী (রহ.) ইন্তেকাল করলে আল্লামা মুজাম্মিল (রহ.)-এর নির্দেশে আবারও তিনি কানাইঘাট মাদ্রাসায় চলে আসেন। ১৯৭০ সাল থেকে সুদীর্ঘ অর্ধশতাব্দী তিনি দরসে নেজামীর গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল কিতাবাদিসহ হাদিসের বিশুদ্ধ কিতাব সহিহ বোখারি দীর্ঘ চারদশক ধরে অত্যন্ত সুনাম ও সুখ্যাতির সঙ্গে পাঠদান করে আসছেন। তার দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনের সোনালি ফসল হিসেবে বহু কৃতী শাগরিদ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে দ্বীনের বহুমুখী খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
আল্লামা বায়মপুরী (রহ.) লক্ষ্মীপুরী হুজুরকে জ্ঞান-বুদ্ধি, ইলম, আমল ও সুন্দর ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত স্নেহ করতেন। এমনকি দূর সম্পর্কে ভাগনে হওয়া সত্ত্বেও নিজের মেয়েকে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে নতুনভাবে আবারও আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করেন। ১৩৭০ বাংলা সনে আল্লামা বায়মপুরী (রহ.)-এর বড় মেয়ে রায়হানা বেগমের সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। তার ঘরে কোনো সন্তানাদি না হওয়ায় চড়িপাড়ায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় সংসারে এক কন্যাসন্তান জন্মের পরই মৃত্যুবরণ করেন। পারিবারিক জীবনে তার আর কোনো সন্তান না থাকলেও হাজার হাজার রুহানি সন্তান আছে দেশে-বিদেশে।
তিনি মাদ্রাসায় শিক্ষাদানের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন। তিনি দীর্ঘদিন কানাইঘাট মাদ্রাসার নায়েবে মুহতামিমের দায়িত্ব পালনের পর ২০০৭ সালে তার ওপর মুহতামিমের গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তিনি সব মত-পথের ঊর্ধ্বে উঠে মাদ্রাসার উস্তাদ ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে এই দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। কানাইঘাট মাদ্রাসা ছাড়াও লালারচক রহমানিয়া মাদ্রাসার মুহতামিমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া সিলেটের আলেম-উলামাদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম আজাদ দ্বীনি এদারায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি মুশাহিদিয়া কেরাত প্রশিক্ষণ শিক্ষা বোর্ডের প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
তাজকিয়ায়ে নফস তথা আত্মশুদ্ধির জন্য তিনি আপন উস্তাদ ও শ্বশুর শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী (রহ.)-এর হাতে বায়াত গ্রহণ করে ইজাজত লাভ করেন। আধ্যাত্মিকতার জগতে আল্লামা বায়মপুরী (রহ.) ছিলেন খুব উচ্চমাপের সাধক। তিনি হাতেগোনা কয়েকজনকে খেলাফত প্রদান করেন, এর মধ্যে মাওলানা লক্ষ্মীপুরী অন্যতম। বর্তমানে তিনিই তার একমাত্র জীবিত খলিফা।
তিনি সুদীর্ঘ অর্ধশতাব্দী ধরে মাদ্রাসায় পাঠদান ও পরিচালনার পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে দ্বীনি শিক্ষা দেওয়ার উদ্দেশে ওয়াজ-নসিহত ও দাওয়াতের খেদমত করে যাচ্ছেন। তিনি কোরআন-হাদিসের আলোকে ইখলাস ও দরদের সঙ্গে বয়ান করেন। বৃহত্তর সিলেটের প্রায় মসজিদ-মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলে বয়ান পেশ করেন। তার বয়ানে উপকৃত হন সর্বসাধারণ। তিনি নব্বইয়ের দশক থেকে কানাইঘাট বাজার মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তার বয়ানে বসলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়, সুন্নতের অনুসরণের প্রতি মনে আগ্রহ জন্মে, আমল ও ইবাদত-বন্দেগির প্রতি মনে ঝোঁক সৃষ্টি হয়। পরকালের শাস্তির ভয়ে দুচোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হয়।
মাওলানা লক্ষ্মীপুরী এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার বায়তুল্লাহ শরিফ জিয়ারতের সৌভাগ্য লাভ করেছেন। তিনি শ্বেতী (ধবল) রোগে আক্রান্ত। এই রোগ নিয়ে সাধারণের মনে অনেক কুসংস্কার আর ভ্রান্তি আছে। তবে এটি কোনো ছোঁয়াচে বা অভিশপ্ত রোগ নয়। ১৯৮২ সালে পবিত্র হজপালনে গিয়ে আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে দোয়া করেন ‘হে আল্লাহ! তুমি সাদা রঙ কালো রঙ সব রঙের সৃষ্টিকর্তা, হয়তো তুমি আমার সারা শরীর কালো করে দাও, না হয় সাদা করে দাও।’ আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় বান্দার দোয়া কবুল করলেন। তার শরীর সাদা রঙে পরিবর্তন হয়ে যায়। হজ থেকে আসার পর তাকে কেউ চিনতেই পারেননি। পূর্বের লক্ষ্মীপুরী আর এখনকার লক্ষ্মীপুরীর মধ্যে অনেক ব্যবধান। এখন আর তিনি শ্বেতী রোগী নন। মাওলানা লক্ষ্মীপুরী ৮৫ বছর বয়সে ব্রেইন স্ট্রোক করেন। ডানপাশ অবশ হয়ে যায়, আল্লাহর রহমতে এখন তিনি কারও সাহায্য ছাড়া অনায়াসেই হাঁটতে পারেন। এগুলো কোনো অতিরঞ্জিত ঘটনা নয়। আসলে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অলৌকিক ঘটনাবলি সত্য।
মাওলানা মুহাম্মদ বিন ইদ্রিস লক্ষ্মীপুরীকে দেখলে হৃদয়ে আলাদা প্রশান্তি আসে, তিনি একজন আল্লাহর অলি। তার খেদমতে গেলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। আল্লাহর অলি ও ইলমে দ্বীনের মহান এই খাদেমের বয়স এখন ৯৯ বছর। বর্তমানে তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করি, তিনি যেন তাকে সুস্থতার সঙ্গে নেক ও বরকতময় হায়াত দান করেন আমিন।
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়