Monday, September 18

‘কিশোর কানাইঘাট’ ও ইতিহাসের নিবিড় পাঠ


মিলন কান্তি দাস::

প্রাচীন জৈন্তিয়া রাজ্য ইতিহাস-ঐতিহ্যের অবিস্মরনীয় এক নাম। প্রাচীন জৈন্তিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ কানাইঘাট যা বর্তমানে আমাদের কানাইঘাট উপজেলা নামে পরিচিত। জৈন্তা রাজ্যের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে কানাইঘাটের নামও চলে আসে। প্রাচীন জৈন্তার ১৭টি পরগনার মধ্যে ৮টি পরগনা নিয়ে কানাইঘাট। জন্মস্থান কানাইঘাটকে ঘিরে রয়েছে আমাদের অনেক স্বপ্ন ও ভালোবাসা। জন্মস্থানের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে জানার কৌতুহল প্রত্যেক দায়িত্ববোধসম্পন্ন মানুষের। যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি, সেদিন থেকে কানাইঘাট সম্পর্কে জানার ও বুঝার চেষ্টা করেছি। কানাইঘাটের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার চেষ্টায় রয়েছেন অনেক জ্ঞানী-গুণী ও গবেষক । 

‘কিশোর কানাইঘাট’ গ্রন্থের লেখক সরওয়ার ফারুকীও এই ধারাকে অব্যাহত রাখতে এগিয়ে এসেছেন। কানাইঘাটের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে তার অনিসন্ধিৎসু মন তাকে ‘কিশোর কানাইঘাট’ গ্রন্থটি রচনায় অনুপ্রাণিত করেছে। বইটিতে উঠে এসেছে জানা-অজানা অনেক তথ্য।

বইটির ভূমিকায় লেখক অত্যন্ত সুন্দরভাবে বইটি প্রকাশে তার স্বপ্ন-সাধনা-লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও প্রয়াসকে তুলে ধরেছেন। লিখেছেন, ‘এ বই মৌলিক গবেষণা নয় এবং এ উদ্দেশ্যে রচিতও হয়নি। কেবল, কানাইঘাটের কিশোর-তরুণদের কাছে ইতিহাসের ধারণা দেওয়া ও ইতিহাস পাঠে উদ্বুদ্ধ করাই লক্ষ্য। ফলে, পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বা বিস্তর গবেষণা নেই; যেটুকু না জানলে উৎসের সাথে সম্পর্ক তৈরী হয় না কেবল সেটুকু তুলে ধরা হয়েছে।’

বইটি সম্পূর্ণ পড়েছি, আমার মতো আরও হাজারো পাঠক হয়ত পড়বেন। লেখকের সাথে সুর মিলিয়ে আমিও বলবো ‘কিশোর কানাইঘাট’ বইটি কানাইঘাটের তরুণ সমাজের কাছে নিজ জন্মস্থানের ইতিহাস-ঐতিহ্য জানার জন্য যুগোপযোগী একটি বই। বইটি কিশোর-তরুণসহ প্রজন্মের বর্তমান ও ভবিষ্যত উত্তরাধিকারীদের জন্য সূত্র খোঁজার একটি দলিল হিসেবে কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস।

ফারুকী লিখেছেন, ‘জৈন্তা-কানাইঘাটের ইতিহাস বিষয়ক বইগুলো অনেকটা দুষ্পাঠ্য পাঠ করলে মনে হয়, এ ইতিহাস আমাদের নয়, দূর দেশের। অথচ কিশোরমন দুর্বোধ্য ভাষার পাঠোদ্ধারে ক্লান্ত হতে চায় না। তাদের জন্য প্রয়োজন সহজ সরল বই কিশোর কানাইঘাট- এ প্রয়োজন পূরনের উদ্দেশ্যে রচিত।’

জন্মস্থান কানাইঘাটের প্রতি কতটা আবেগ, প্রেম, স্বপ্ন ও দায়িত্ববোধ লেখকের মনের গভীর দীর্ঘদিন হতে লালিত তা ‘কিশোর কানাইঘাট’-এর ভূমিকার এই দুই তিনটি লাইনের মধ্যে পাওয়া যায়।

জৈন্তা নিয়ে অনেক লিখালিখি হয়েছে। জৈন্তার রাজাদের শাসন ও শাসনকাল নিয়ে অনেক লেখক ও ঐতিহাসিক অনেক বই লিখেছেন। সেই বইগুলোতে কানাইঘাট নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা খুব একটা নেই বললেই চলে। সে হিসেবে লেখকের ভূমিকায় লিখা ‘পাঠ করলে মনে হয় এ ইতিহাস আমাদের নয়, দূর দেশের’ বাক্যটির সাথে আমি সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করছি।

লেখক বলছেন কিশোর মনের ভাবনার কথা। আসলেই কিশোরমন সহজ সরল, সুপাঠ্য ভাষায় পাঠদানের প্রতি সবসময় আগ্রহী। সে হিসেবে কিশোর কানাইঘাট কিশোরদের মনের ভাবনা, ইচ্ছা ও সহজবোধ্য পাঠের জন্য প্রাসঙ্গিক সম্পূর্ণ নতুন ও ব্যতিক্রমধর্মী একটি বই।

বইটির শুরুতে জাতীয় সংগীত, রণসংগীত ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। সাথে সেই সংগীতদ্বয় রচনার পটভূমিও লেখক অত্যন্ত সুন্দর, সহজ ভাষায় তুলে ধরেছেন। অতঃপর লেখক তার নিজের লিখা ‘আমার কানাইঘাট’ কবিতাটি পাঠকদের কাছ নতুনভাবে তুলে ধরেছেন। জন্মভূমি ও জন্মস্থানের প্রতি লেখকের যে কত টান, প্রেম, মমত্ববোধ তা লেখক বইয়ের শুরুতেই জাতীয় সংগীত, রণসংগীত ও ‘আমার কানাইঘাট’ শিরোনামের কবিতার মাধ্যমে পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছেন।

প্রতিটি স্বপ্নবাজ মানুষের একটি আবেগময় শৈশব রয়েছে। সদ্য শৈশব পেরোনো কিশোরদের বেলায়ও এই আবেগের স্মৃতিতে প্রগাঢ় টান রয়েছে। লেখক তাই বইয়ের পাঠের শুরুটা তার শৈশবের স্মৃতিচারণের মাধ্যমে করেছেন। যার জন্য কিশোর কানাইঘাট- এর সূচনাটা সত্যিই অসাধারণ। স্মৃতিচারণকে টেনে টেনে কানাইঘাটের নামকরন পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। যার ধারাবাহিকতা চমৎকার এবং কিশোর পাঠকদের জন্য সহজে বোধগম্য।

লেখক জৈন্তার রাজ পরিবার ও রাজাদের শাসনকালকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজিয়েছেন। তুলে ধরেছেন সেই সময়ের কানাইঘাটকে। তুলে ধরেছেন জৈন্তার প্রথম মুসলমান ফতেহ খাঁর জীবনের একটি মূল্যবান অধ্যায়কে। তুলে ধরেছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম পূণ্যস্থান কানাইঘাট উপজেলার ফালজুর বামজঙ্গা কালীবাড়ির ইতিহাস ঐতিহ্যকে।

রাজার আমলের কানাইঘাট হতে ব্রিটিশ শাসনের কানাইঘাট সহ জৈন্তা রাজ্যের পদার্পনের ইতিহাসকেও লেখক অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় তুলে ধরেছেন। ব্রিটিশ আমলে কানাইঘাট নামকরণ, কানাইঘাট থানা স্থাপন, ব্রিটিশ বিরোধী ১৯২২ সালের কানাইঘাটের লড়াইয়ের ইতিহাসের সারমর্মকে কিশোর পাঠকদের কাছে সহজবোধ্য ভাষায় লেখক তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন ১৯২২ সালের লড়াইয়ে আত্মত্যাগকারী কানাইঘাটের বীর শহীদদের নাম।

অতঃপর পাকিস্তান আমলের কানাইঘাট ও মুক্তিযুদ্ধের কানাইঘাটকেও লেখক সাবলীল ও সহজবোধ্য ভাষায় তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন স্বাধীনতা পরবর্তী কানাইঘাট হতে অদ্যবধি পর্যন্ত কানাইঘাটের সংসদ সদস্যদের নাম। তুলে ধরেছেন কানাইঘাটের সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের ইতিহাসকেও Ñযা কিশোর পাঠকদের জন্য সহজবোধ্য ও প্রয়োজনীয়।

লেখক সরওয়ার ফারুকী একজন প্রতিভাবান কলমসৈনিক। ‘কিশোর কানাইঘাট’ রচনায় লেখক সরওয়ার ফারুকী শতভাগ আন্তরিকতা, পরিশ্রম ও দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেনÑ এটা অনস্বীকার্য।

কানাইঘাটে একসময় কলম সৈনিক হাতেগুনা ছিলো যারা ছিলেন, তারা সকলেই আমাদের শ্রদ্ধেয় ও গুরুজন। বর্তমানে কানাইঘাটে প্রায় অর্ধশতাধিক শব্দকারিগর রয়েছেন। যারা প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু মৌলিক সৃষ্টি করেই চলেছে। কিশোর কানাইঘাট- এর ছোট্ট একটি পাতায় তাদের নাম তুলে ধরলে পূর্ণতা পেত বলে মনে হচ্ছে। কারণ, কিশোর কানাইঘাট আজকের দিনের গ্রন্থ হলেও আগামী দিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক দলিল। বই প্রকাশ করেছে দোআঁশ। পাওয়া যাবে সিলেটের স্থানীয় লাইব্রেরিগুলোতে।



শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়