Monday, September 5

বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে চান হারিছ চৌধুরী কন্যা ব্যারিস্টার সামিরা


কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক ::

১৫ বছর পর বাবা-মেয়ের সাক্ষাৎ। শুধু একে অপরকে দেখতে পেয়েছেন। কথা হয়নি একটিও। কারণ বাবা হারিছ চৌধুরী তখন আইসিইউতে। বাবার সাক্ষাৎ পেলেও তার সঙ্গে কথা না বলার কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছেন হারিছ চৌধুরীর মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরী। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী গত বছরের ৩রা সেপ্টেম্বর ঢাকায় মারা যান। নানা অসহযোগিতার কারণে তাকে ঢাকার অদূরে সাভারে দাফন করতে হয়। এক এগারোর সময় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে অন্তরালে চলে যাওয়া হারিছ চৌধুরী দেশেই নিঃসঙ্গ সময় কাটিয়েছেন। বিদেশে থাকা স্বজনদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে কথা বলতেন টেলিফোনে। কিন্তু সামনাসামনি দেখা হয়নি গত বছর গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর হারিছ চৌধুরী নিজেই মেয়েকে দেশে আসার জন্য বলেছিলেন। বাবার ডাকে সাড়া  দিয়ে সামিরা দেশে আসলেও বাবাকে আর কথা বলার মতো অবস্থায় পাননি। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানে থাকা অবস্থায়ই তার মৃত্যু হয়। এরপর দাফন নিয়ে জটিলতায় পড়েন। বাবাকে নিজের জন্মস্থান কানাইঘাটে নিয়ে দাফন করতে সব চেষ্টাই করেছেন তিনি। কিন্তু কারও কোনো সহযোগিতা পাননি। পরে সাভারের একটি মাদ্রাসার কবরস্থানে দাফন করা হয়। এক সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের পরিচিত মুখ হারিছ চৌধুরীর মৃত্যু আর দাফন হয়েছিল অনেকটা অগোচরে। মানবজমিনে প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তার মৃত্যু ও দাফনের বিষয়ে প্রথম তথ্য প্রকাশিত হয়। মানবজমিনের সাড়া জাগানো ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর কেটে যায় হারিছ চৌধুরীকে নিয়ে সব ধূম্রজাল। হারিছ চৌধুরীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে গত শনিবার কানাইঘাটে একত্রিত হয়েছিলেন তার সব স্বজনরা। স্ত্রী, মেয়ে, ভাই, বোনসহ স্বজন ও দলীয় নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় দোয়া মাহফিল ও স্মরণসভা।


অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার ফাঁকে মানবজমিনের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন, হারিছ চৌধুরীর মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরী। বাবার নিঃসঙ্গ জীবন, তার অসুস্থতা, মৃত্যু, দাফন এবং তার স্মৃতি রক্ষার পরিকল্পনার বিষয় উঠে এসেছে আলাপচারিতায়। বাবার মৃত্যুর পর বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সামিরা সেই স্মৃতি মনে করে হন আপ্লুত, বাকরুদ্ধ। বলেন, বাবার মৃত্যু নিয়ে কিছুটা ধূম্রজাল ছিল। এজন্য উনার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়েছি। স্বজন এবং দলের লোকজনকেও আমরা দাওয়াত দিয়েছি।  ব্যারিস্টার সামিরা বলেন, আব্বু তো জাতীয় নেতা ছিলেন। আব্বুকে দলমত নির্বিশেষে সবাই ভালোবাসতেন। পরিবারের পক্ষ থেকে অনেকবার দোয়া করিয়েছি। কিন্তু মানুষজন জানতো না আগে। আগে নীরবে করতাম। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে একটু প্রচার হয়েছে। অনেকের মধ্যে ধূম্রজাল, ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। তাই এবার সবাইকে আমন্ত্রণ করেছি যাতে ধোঁয়াশাটা দূর হয়ে যায়। সকল প্রশ্ন যেন এখানেই শেষ হয়ে যাক।  সামিরা বলেন, বাবার ইচ্ছা ছিল দাদুর কবরের পাশে শায়িত হবেন। কিন্তু পারিনি। আসলে এটা আমাদের হাতে নেই। পরিবার থেকে কতোটা কি করা যায় পরিবার চিন্তা করছে। কবর স্থানান্তর করার কোনো চিন্তা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সম্ভব হলে অবশ্যই চাইবো দাদুর পাশে উনাকে শায়িত করার। কানাইঘাটে শায়িত করার।  ঢাকায় হারিছ চৌধুরীর পরিচয় গোপন করে থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, সময়টা কঠিন ছিল। মতি আঙ্কেল (মতিউর রহমান চৌধুরী) মানবজমিনে বিশদভাবে লিখেছেন। সারাংশ তিনি তুলে ধরেছেন। যেটা প্রকাশিত হয়ে গেছে। এর বাইরে আসলে যোগ করার কিছু নেই।  বাবার অসুস্থতার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি প্লেনে উঠার আগে আগেই আব্বুকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। আব্বুর সঙ্গে আমার ফোনে কথা হয়েছিল। যেহেতু খুবই গুরুতর অবস্থায় ছিল। তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ছিল। যেহেতু তিনি এক সময় ক্যান্সার আক্রান্ত ছিলেন, পরে অবশ্য সুস্থ হয়ে ওঠেন। তার ডায়াবেটিস ছিল না, হাইপার টেনশন ছিল। এ কারণে অবস্থা হঠাৎ করে তাড়াতাড়ি খারাপ হয়ে যায়। আব্বু অনেক স্ট্রং ছিল হাঁটাহাঁটি করতো। আমরা ভাবিও নাই হঠাৎ নাই হয়ে যাবে। আব্বুকে লাইফ সাপোর্টে এভার কেয়ারে রাখা হয়েছিল। ওই সময় আমার আব্বুর সঙ্গে কথা হয় নাই। আমার মতামত নেয়ার জন্য হাসপাতাল থেকে ফোন করে। আমি বিমানে উঠার আগে কোভিড টেস্ট করি, জব ছাড়লাম তখন আব্বুর সঙ্গে আমার কথা হয়। আসলে আব্বু ফোন দিয়ে বলেন, চলে আসো। আমি দীর্ঘদিন এই ফোনটার জন্য অনেক অপেক্ষা করছিলাম। এর আগে ১৫ বছরে দেখা হয় নাই। কথা হতো খুব কম। আমার ভাইয়ের সঙ্গে কথা হতো। চাইতেন না কোনো সমস্যায় ফেলতে। ওই সময় আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধব যারা সাহস করে এসেছিল তারা এসেছিল। আমি যথেষ্ট চেষ্টা করেছি। 


সামিরা বলেন, ৩রা সেপ্টেম্বর মাগরিবের পর আব্বু মারা যান। পরের দিন দাফন হয় আসরের পরে। সারারাত চেষ্টা করেছি এখানে (কানাইঘাট) আনার। হাসপাতালে গোসল করিয়ে আবার হাসপাতালে রাখি। আত্মীয় যাদের দেখছেন সবাই দেশের বাইরে ছিল। আব্বুর মতো একজন বড় মাপের মানুষ যিনি ১৫ বছর ধরে কোনো পিকচারে নেই। এমন করে ডিসিশন নিতে হবে এটার জন্য মানসিক অবস্থায় যে থাকবে........। আমার এমন কোনো স্বজন নেই যাকে নক করিনি। ওই সময়ের বাস্তবতাটা যারা চিন্তা করবে তারাই বুঝবে কি অবস্থা ফেস করেছি। সামিরা বলেন, হাসপাতাল থেকে নরমালি এম্বুলেন্সে করে সাভারে নিয়ে যাওয়া হয়। যখন আমাকে মানা করা হয় যে দাদু বাড়িতে আনা সম্ভব নয়। এরপর নানুকে ফোন করলাম তিনি বললেন দিয়ে দাও। আমার নানু বেঁচে আছেন। তখন আমি নানুর যেখানে কবরের জায়গা নেয়া ছিল বিরুলিয়াতে সেখানে বাবাকে দাফনের উদ্যোগ নেই। জানাজায় কয়েকশ’ জন কোরআনের হাফেজ এবং আমাদের কাছের আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধব অংশ নেন। আমার চাচাতো, খালাতো ভাই, মামাও ছিলেন। হারিছ চৌধুরী কেন দেশে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন এমন প্রশ্নে সামিরা বলেন, আব্বু দেশপ্রেমিক ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি দেশ ত্যাগ করতে চাননি।


অসুস্থ হওয়ার আগে আব্বু কোথায় ছিলেন আমি জানতাম না। পরিবারের থেকে তিনি দেশকে বেশি প্রায়োরিটি দিয়েছেন। নিজেকে পুরোপুরি আল্লাহর রাস্তায় সপে দিয়েছেন। তিনি সহজ সরল ছিলেন।  নাম গোপনের বিষয়ে তিনি বলেন, যে নামটার কথা এসেছে এটাতো শুধু অফিসিয়ালের জন্য। এটা ব্যবহার করেননি। এই নামে পাসপোর্ট হয়েছে কিন্তু ব্যবহার করেননি। যেটা মতি আঙ্কেল ইনভেস্টিগেট করে বের করেছেন। আমি জানি না আব্বু নিজে করেছেন নাকি অন্যকে দিয়ে করিয়েছেন। দেশেই ছিলেন সবার মাঝখান দিয়ে চলাফেরা করেছেন। দেশেই ছিলেন, বাজার করতেন। ইমামতি করতেন। শুনেছি ইমামের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। ইমাম সাহেব যখন ছুটিতে চলে যেতেন তখন ইমামতি করতেন বাবা। সবাই তাকে ভালোবাসতেন। মাহমুদুর রহমান কিংবা হারিছ চৌধুরী এই নামটি ম্যাটার করেনি তিনি একজন ব্রাইট ম্যান।  বাবার শেষ সময়ের স্মৃতিচারণ করে সামিরা বলেন, আমি তো ফ্ল্যাটে ছিলাম (পান্থপথের যে ফ্ল্যাটে হারিছ চৌধুরী থাকতেন)। ফ্ল্যাটের কলটা ঠিক করালাম যে মিস্ত্রি আসলো আব্বুর মারা যাওয়ার কথা শুনে ওখানেই দাঁড়িয়ে কাঁদলেন। আব্বু যাওয়ার পর পর ওখানে কিছুদিন ছিলাম।


দেশে এসে আমার থাকার জায়গা ছিল না। এ ছাড়াও আব্বুর স্মৃতি ছিল। আমার স্বামী আসা পর্যন্ত ওখানে ছিলাম।  সামিরা বলেন, আব্বুর ডায়েরিগুলো খুঁজেছি। এখনো পাইনি। একটা লেখা পেয়েছি। বালিশের নিচে পেয়েছি দাদা-দাদি, আম্মু, আমার, ভাইয়ের, তার ভাইয়ের ছবি। ছবি ও দাদার লেখা চিঠি নিয়ে ঘুমাতেন। শেষের দিনগুলো দাদা-দাদুকে খুব মিস করতেন। সামিরা তানজিন চৌধুরী বলেন, আমি চিন্তা করছি আব্বুর নামে একটা ফাউন্ডেশন করার। যেটির কাজ চলছে। আব্বুর অনেক চেরিটেবল অ্যাফেয়ার্স ছিল। এগুলোকে আমরা ফাউন্ডেশনের অধীনে এনে চালাতে চাই। এসবের মাধ্যমে আব্বুর নাম বেঁচে থাকবে। আমাকে আব্বু বলে গেছেন, এতিমখানাটা আব্বুর অনেক আদরের। আব্বু বলেছেন এটার দায়িত্ব তোমার। আমার এতিমগুলো যেন বেঁচে থাকে। তিনি বলেন, আমি আশা করি আব্বুর স্মৃতি রক্ষায় আমাদের চেষ্টায় সবাই পাশে থাকবেন।

সৌজন্যে :: দৈনিক মানবজমিন



শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়