Thursday, January 13

একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বিদায়

বীর মুক্তিযোদ্ধা ফয়জুর রহমান
সারওয়ার কবির::

ফয়জুর রহমান ১৯৪২ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার দক্ষিণ বাণীগ্রাম ইউনিয়নের ধলিবিল দক্ষিণ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাজী আব্দুল খালিক ও মাতার নাম রুপিয়া বেগম। বড়দেশ নয়াগ্রাম মক্তবেই তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ছোটদেশ জুনিয়র স্কুল, কানাইঘাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম শ্রেণি, বারহাল এহিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এবং পরবর্তীতে কানাইঘাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৫৯ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইকম এবং ১৯৬৪ সালে হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজ থেকে বিকম পাশ করেন তিনি। এসময় তিনি হবিগঞ্জ বৃন্দাবন কলেজ হোস্টেল জিএস ও নির্বাচিত হন। ফয়জুর রহমান, ছাত্রজীবনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, চাকুরী জীবনের প্রথম দিকে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত ছিলেন। ১৯৬৫/৬৬ সালে তিনি ছোটদেশ জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। 

 

লেখকের সাথে আলাপচারিতায় প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা ফয়জুর রহমান

১৯৬৭ /৬৮ সালে সিলেট এবং ঢাকা শহরে কাপড়ের ব্যবসা করনে। ১৯৬৯, ১৯৭০ সালে একজন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। সিলেটের ইসমত চৌধুরী, এনাম চৌধুরী, নুরুল হুসেন চঞ্চল, শাহ মুদব্বির আলী, লুতফুর রহমান, শাহ আজিজদের নেতৃত্বে সিলেটে বাংলাদেশের মুক্তির পক্ষে বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি জড়িয়ে পড়েন। 

 

১৯৭০ সালের নির্বাচনে কানাইঘাট-বিয়ানীবাজার -জকিগঞ্জের এমএনএ মরহুম হাবিবুর রহমান তোতা উকিলের পক্ষে কাজ করেন তিনি। তার নির্বাচনকালীন সময়ে কানাইঘাট-জকিগঞ্জের সর্বত্র তিনি তার সাথে ঘুরেছেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসের দিকে তিনি ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তার পিতা  আব্দুল খালিক তখন শয্যাশায়ী ছিলেন,  ফয়জুর রহমান তার অসুস্থ পিতাকে জানিয়েই মুক্তিযুদ্ধে যান।যুদ্ধে যাওয়ার ২ মাস পর তিনি তার পিতাকে হারান। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য, বাড়ি থেকে একা রওয়ানা দেন। ওইদিন জাফলং এ রাত্রিযাপন করেন। পরদিন জাফলং অতিক্রম করে ডাউকিতে গিয়ে পৌছান। ভারতের মেঘালয়ের ডাউকি নামক স্থানে হাবিবুর রহমান তোতা উকিলের নেতৃত্বে কাজ শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন শরনার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং ক্যাম্পগুলো থেকে যুবক ছেলেদের যাচাই -বাছাই করে মুক্তিযুদ্ধের টেনিং ক্যাম্পে পাঠানোই ছিলো তার অন্যতম কাজ। একজন রিক্রুটিং এজেন্ট হিসেবে তিনি সেখানে কাজ করেন। শরনার্থী ক্যাম্পে কার কি লাগবে, ওষুধ, খাবার, বস্ত্র সংগ্রহ করে শরণার্থী ক্যাম্পে পৌছে দেওয়াসহ একজন সংগঠকের ভূমিকা রাখেন তিনি। অসুস্থ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিতসার ব্যবস্থা করা সহ নানাকাজে তিনি ছিলেন এগিয়ে। অফিসিয়াল যোগাযোগ তার মাধ্যমেই হতো। লিয়াজো মেইনটেইন, ইন্ডিয়ান অফিসিয়াল কাজ, শরনার্থী ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন এর কাছে তথ্যসহ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা জমা দিতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ৫নং সেক্টরে ক্যাপ্টন রাও এর নেতৃত্বে কাজ করেন। ৫ ডিসেম্বর জাফলং হয়ে বাংলাদেশের দিকে রওয়ানা দিয়ে দরবস্ত এসে পৌছান তিনি। ১১/১২ ডিসেম্বর ক্যাম্প বসান দরবস্ত বাজারের পাশে। জৈন্তা, গোয়াইনঘাট, চতুল, দরবস্ত অঞ্চলের দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যাস্ত করেন দেওয়ান ফরিদ গাজী এমপি। তখনকার সময়ে তার সাথে ছিলেন আরও ৪ জন। প্রায় ২ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা দরবস্ত বাজারে তখন ক্যাম্পে ছিলেন। তখন পাক বাহিনি দরবস্ত থেকে বিভিন্ন ব্রীজ ভেঙ্গে সিলেটের দিকে রওয়ানা দেয়। সেসময় ভারতীয় সেনাবাহিনী জাফলং হয়ে বাংলাদেশ প্রবেশ করতে চাইলে নদীর উপর দিয়ে গাড়ি পারাপারের ব্যবস্থা সহ কোন অঞ্চলে কিভাবে যাবেন, কিভাবে অপারেশন করবেন সেগুলোও দেখিয়ে দেন ফয়জুর রহমান। জাফলং এ পাকিস্তান আর্মি এম্ব্যুস করলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন মারা যান। একসময় তারা শুনেন, বাংলাদেশ সীমান্তে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ করবে। তখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কাস্টম অফিস পাকিস্তানীরা দখলে নিয়ে নেয়। পরের দিন রাত ১১.০০ টার পর পাকিস্তানীদের উপর ভারতীয় সেনাবাহিনী আক্রমণ চালালে তারা চলে যায়। এতে হতাহত হন অনেকে। জনাব ফয়জুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের প্রথম ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হলে তিনি দক্ষিণ বানীগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। 

 

যুক্তরাজ্যস্থ কানাইঘাটবাসীর প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন কানাইঘাট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ইউকে'র প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৭ সালে তাকে কানাইঘাট ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ইউকের পক্ষ থেকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। 

ফয়জুর রহমান ১২ জানুয়ারি রাতে লন্ডনে তার নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেন।(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। পরদিন ১৩ জানুয়ারি জানাজার নামাজ শেষে তাকে লন্ডনের হেইনল্ট কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। এই ক্ষনজন্মা মানুষের বিদায় দিনে শোক শ্রদ্ধা 

 

সারওয়ার কবির ,সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী


শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়