হাবীবুল্লাহ সিরাজ::
হজরত রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রমজানের প্রতি রাত্রে আল্লাহ অসংখ্য অগণিত দোযখী বান্দাকে জান্নাত দান করেন’। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর এই একটি ঘোষণাই রমজানের মাহাত্ম্য ও বড়ত্ব প্রকাশের জন্য যথেষ্ট। তবুও রাসূল (সা.) আরো অগণিত হাদিসে রমজানের বিশেষ বিশেষ ফজিলতের কথা জানিয়েছেন। সেহরি; তাতেও রয়েছে রহমত বরকতের অসীম ভাণ্ডার। ইফতার; তাতেও।
ইফতার রোজার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। ইফতার দ্বারাই মূলত রোজাগুলো পূর্ণতা পায়। এই ইফতারের যত ফজিলত রয়েছে তন্মধ্য থেকে কয়েকটি তুলে ধরছি।ইফতার মুক্তির শুভ সংবাদ :
হাদিস শরিফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘রোজাদারের জন্য দু’টি আনন্দের সংবাদ রয়েছে। ইফতার হলো আল্লাহ পক্ষ থেকে মুক্তি সওগাত নিয়ে অবতীর্ণ হয়। ইফতারের মাহেদ্রক্ষণে আল্লাহ তায়ালা বহু জাহান্নামিকে জান্নাত দিয়ে দেন। কতজনকে তার কনো হিসেব নেই।
عَنْ جَابِرٍ رضی الله عنه قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ ﷲِ صلی الله علیه وآله وسلم: إِنَّ لِلّٰهِ عِنْدَ کُلِّ فِطْرٍ عُتَقَاءَ وَذَلِکَ فِي کُلِّ لَیْلَةٍ
হজরত জাবের রাযি. থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘প্রত্যেক ইফতারের সময় আল্লাহ বহু মানুষকে মুক্তি দেন। আর এই মুক্তির দেয়ার ধারাবাহিকতা প্রতিরাতেই চলতে থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজা : হাদিস নম্বর ১৬৪৩)।
দ্রুত ইফতার করা :
হজরত সাহল ইবনে সা’দ রাযি. থেকে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوْا الْفِطْرَ.
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মানুষ ততদিন কল্যাণের ওপর থাকবে, যতদিন তারা অবিলম্বে ইফতার করবে।” (বুখারী : হাদিস নম্বর ১৯৫৭)।
عَنْ أَبِي عَطِیَّةَ قَالَ: دَخَلْتُ أَنَا وَمَسْرُوْقٌ عَلَی عَائِشَةَ فَقُلْنَا: یَا أُمَّ الْمُؤْمِنِیْنَ، رَجُلَانِ مِنْ أَصْحَابِ مُحَمَّدٍ صلی الله علیه وآله وسلم أَحَدُهُمَا یُعَجِّلُ الْإِفْطَارَ وَیُعَجِّلُ الصَّلَاةَ وَالْآخَرُ یُؤَخِّرُ الْإِفْطَارَ وَیُؤَخِّرُ الصَّلَاةَ قَالَتْ: أَیُّهُمَا الَّذِي یُعَجِّلُ الْإِفْطَارَ وَیُعَجِّلُ الصَّلَاةَ؟ قَالَ: قُلْنَا: عَبْدُ ﷲِ یَعْنِي ابْنَ مَسْعُوْدٍ قَالَتْ کَذَلِکَ کَانَ یَصْنَعُ رَسُوْلُ ﷲِ صلی الله علیه وآله وسلم
হজরত আবু আতিয়্যাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমি ও মাসরুক হজরত আয়েশা রাযি. এর নিকট গিয়ে বললাম, হে উম্মুল মুমিনিন! হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথিদের মধ্যে দুজন এমন আছেন যাদের একজন অবিলম্বে ইফতার করেন এবং অবিলম্বে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন। আর অপরজন বিলম্ব করে ইফতার করেন এবং বিলম্বে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, দুজনের মধ্যে কে অবিলম্বে ইফতার করেন এবং অবিলম্বে মাগরিবের নামাজ আদায় করেন? আমি বললাম, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি.। তিনি বললেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই করতেন। (সহিহ মুসলিম : হাদিস নম্বর ১০৯৯) অন্য এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন,
أَحَبَّ عِبَادِي إِلَيَّ أَعْجَلُهُمْ فِطْرًا
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমার কাছে সবচে’ উত্তম হলো দ্রুত ইফতার করা।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : হাদিস নম্বর ১৬৭০)।
ইফতা দ্রুত করা শুধু ইবাদত নয়। মুসলমানদের জন্য জরুরিও। কেনন মুসলমানরা যতদিন দ্রুত ইফতারকরবে তারা সঠিকভাবে শক্তিশালী হয়ে কাফেরদের ওপর জয়ে হবে। আর যখন তারা এর ব্যতিক্রম করবে তখন তারাই পথ হারাবে।
لَا یَزالُ الدین ظَاھِراً مَا عَجَّلُ النَّاسُ الفِطرَ لِانَّ الیَھُودُ وَ النَّصَارَی یُؤَخِّرُونَ
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এই ধর্ম ততদিন শক্তিশালী থাকবে, যতদিন তারা দ্রুত ইফতার করবে। কেননা তারা বিলম্বে ইফতার করে।’ (সুনানে আবু দাউদ : হাদিস নম্বর ২৩৫০)।
ইফতার নিয়ে অপেক্ষা করা :
সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ আগে ইফতারি সামনে নিয়ে অপেক্ষা করাও সুন্নত। আর এর মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশের প্রতি মুমিন বান্দার নিখাঁদ আনুগত্যের এক পরম অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়, যা মহান আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয়। কারণ, ওই সময়ে রোজাদার থাকে সাংঘাতিক ক্ষুধার্ত। মারাত্মক ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাবার সামনে থাকার পরও না খেয়ে সময়ের জন্য অপেক্ষা থাকার মাধ্যমে বান্দা মহান আল্লাহর কর্তৃত্বের সামনে নিজের চরম অসহায়ত্বকে প্রকাশ করে এবং খোদানুগত্যের এক বলিষ্ঠ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এমন সময় আল্লাহ তার ফেরেস্তাদের ডেকে বলে- তারা ক্ষুধার্ত সামনে খাবার আছে তারপরও তারা খাচ্ছে না কেন? উত্তরে ফেরেস্তারা বলেন আপনার ভয়ে। তখন আল্লাহ বলেন, তোমরা সাক্ষী থেকো আমি তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতের হকদার বানিয়ে দিলাম। তাই ইফতারের আগ মুহূর্তে ইফতারি সামনে নিয়ে রোজাদার দোয়া করলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার সে দোয়া কবুল করেন। হজরত আবু হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তিন ব্যক্তির দোয়া কবুল না করে ফিরিয়ে দেয়া হয় না, ক. ন্যায়বিচারক শাসনকর্তার দোয়া; খ. ইফতারের আগে রোজাদারের দোয়া এবং গ. মাজলুমের (নির্যাতিত ব্যক্তির) দোয়া। (মুসনাদে আহমাদ : হাদিস নম্বর ৯৭৪২)।
খেজুর দিয়ে ইফতার করা :
রাসূলের (সা.) প্রতিদিনকার অভ্যেস ছিল খেজুর দিয়ে ইফতার করা। খেজুর না পেলে কি করতেন সেই কথাও বর্ণনা করতেছেন হযরত আনাস রাযি.।
کان رسولُ اللَّہُّ صلی اللَّہ علیہ و علی آلہ وسلم یُفطِرُ عَلَی رُطَباتٍ قبل ان یُصّلِّیَ فَان لَم تَکُن رُطَباتٍ فَعَلیَ تَمَرَاتٍ فَان لَم تَکُن حَسا حَسَوَاتٍ مِن مَاءٍ
হজরত আনাস বলেন, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাঁচা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। কাঁচা খেজুর না পাওয়া গেলে যে খেজুরই পাওয়া যেতো তা দিয়ে ইফতার করতেন। আর কিছুই না পাওয়া গেলে কয়েক ঢোক পানি পান করতেন। (সুনানে আবু দাউদ : হাদিস নম্বর ২৩৫৩)।
এমন একটি হাদিস হজরত সালমান ইবনে আমের রাযি. থেকেও বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন ইফতার করে, তার উচিত খেজুর দিয়ে ইফতার করা। তবে সে যদি খেজুর না পায়, তাহলে সে যেন পানি দিয়ে ইফতার করে। কারণ পানি পাক-পবিত্র। (মুসনাদে ইবনে আবি শাইবা : হাদিস নম্বর ৮৪৭, মুসনাদে আহমাদ : হাদিস নম্বর ১৬২২৫)।
ইফতার করানো :
রোজার অন্যতম অনুষঙ্গ ইফতার। এই অনুষঙ্গ ইফতার আরো প্রাণবন্ত হয় যখন অন্যকে ইফতার করানো হয়। অন্যকে ইফতার করানোর মধ্যে বহু ফজিলত রয়েছে। অন্যকে ইফতার করালে একটি রোজার সমপরিমাণ সওয়াব পাওয়া যায়। বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ زَیْدِ بْنِ خَالِدٍ الْجُهَنِيِّ قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ ﷲِ صلی الله علیه وآله وسلم: مَنْ فَطَّرَ صَائِمًا کَانَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِهِ غَیْرَ أَنَّهُ لَا یَنْقُصُ مِنْ أَجْرِ الصَّائِمِ شَیْئًا
হজরত যায়েদ ইবনে খালিদ জুহানি বর্ণনা করেন; রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রোজাদারকে ইফতার কারালো তার ভাগ্যে একটি রোজার সমপরিমাণ সওয়াব লেখা হবে। অথচ যাকে ইফতার করালো তার সওয়াবের কোনো কমতি হবে না।’ (সুনানে তিরমিযি : হাদিস নম্বর ৮০৭)।
ফজিলত বর্ণনার পরে ইফতারের দোয়াটি তুলে ধরছি। ইফতারের দোয়াটা আমাদের অবশ্যই জানতে হবে। ইফতারের প্রসিদ্ধ দোয়া-
اللهم لك صمت وبك أمنت وعليك توكلت وعلي رزقك افطرتُ
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার জন্যই রোজা রাখছি, আপনার প্রতিই ঈমান আনছি, আপনার ওপরও ভরসা করি এবং আপনার রিজিক দ্বারাই ইফতার করছি।
তবে এই দোয়াটি রাসূল (সা.) অন্যভাবেও পড়তেন-
اللهم لك صمت وعلي رزقك افطرتُ
উপরোল্লিখিত ইফতারে যে বিশাল ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। এর সবগুলোই কিন্তু আমরা আদায় করতে পারি। কিছু কিছু ফজিলত আছে শুধু নিয়তের দ্বারা আদায় হয়ে যাবে। আর কিছু ফজিলত আছে এমনিতেই হয়ে যাবে। যেমন দ্রত ইফতার করা। সচারাচার এগুলো আমরা করে থাকি এখন শুধুমাত্র নিয়তের প্রয়োজন। আর খেজুর দিয়ে ইফতারের যে কথা বলা হয়েছে- সাধারণত আমরা তো খেজুর দিয়েই ইফতার করি। শুধুমাত্র এই নিয়ত করবো যে, রাসূল খেজুর দিয়ে ইফতার করছেন আমিও খেজুর দিয়ে ইফতার করছি। আর অন্যকে ইফতার করানোর যে কথা বলা হয়েছে তাও সহজ। ইফতার করাতে আহামরির কোনো কিছু লাগে না। এই প্রসঙ্গে একটি হাদিস বলতে চাই, অন্যকে ইফতার করানোর ফজিলত শুনে এক সাহাবি বলে উঠলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের অনেকের সমর্থ নেই অন্যকে পেটভরে ইফতার করানোর। তখন রাসূল (সা.) বললেন পেটভরে কেন খাওয়াতে হবে। একগ্লাস পানি দিয়ে হলেও এই ফজিলত তোমরা পাবে।
সুতরাং আসুন রমজানকে কার্যকর ও নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ রমজান বানাতে হাদিস বর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ করি। আল্লাহ আমাদের সবাই সুস্থতার সঙ্গে রমজানগুলো আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়