কানাইঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী লোভাছড়া পাথর কোয়ারিতে প্রশাসনের কোন ধরনের অভিযান কাজে আসছে না। ইজারার শর্ত অমান্য করে প্রভাবশালী পাথর ব্যবসায়ীরা কোয়ারিতে পরিবেশবিরোধী তাণ্ডবলীলা চালিয়ে যাচ্ছে।
কোয়ারিতে পাথর উত্তোলনের কাজ শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ বারিউল করিম খানের নেতৃত্বে পর পর ৫ বার টাস্কফোর্সের অভিযান হয়েছে। তবে এসব অভিযান চললেও পাথর উত্তোলনে কোন ধরনের প্রভাব পড়েনি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে গভীর ও ঝুঁকিপূর্ণ গর্তগুলো বন্ধ অথবা এর সাথে জড়িত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় অভিযানগুলো আইওয়াশে পরিণত হয়েছে।
প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য বিকেল থেকে সারারাত প্রভাবশালীদের অসংখ্য ফেলুডার, স্কেবেটর দিয়ে কোয়ারিতে গভীর গর্ত করে মাটি খননের কাজ চলে আসছে। কিন্তু কারা এসব ফেলুডার, স্কেবেটরের মালিক তাদের চিহ্নিত করতে প্রশাসনের কোন ধরনের তৎপরতা নেই। অভিযানকালে অর্ধকোটি টাকার বেশি মূল্যের ফেলুডার ও এস্কেবেটরগুলি হাতুড়িপেটা করে দিয়ে গ্লাসসহ ইঞ্জিন বিকল করে দেওয়া হয়। কিন্তু বিনষ্ট করা হলেও মালিকদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোন আইনানুগ পদক্ষেপ। গত সোমবার নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে কোয়ারি এলাকায় টাস্কফোর্সের অভিযান চললেও ঝুঁকিপূর্ণ গর্ত থেকে পাথর উত্তোলন থেমে থাকেনি বলে জানা গেছে।
অভিযানকালে সাউদগ্রামের ফারুক আহমদের বাড়ীতে গিয়ে সেখানে রাখা ২টি ফেলুডার, স্কেবেটর ভাংচুর করে ১৫/১৬ লক্ষ টাকার ক্ষয়ক্ষতি সাধন করা হয় এবং ফারুক আহমদের কলেজ পড়ুয়া ছেলে বাশার আহমদকে আটক করে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ৪ লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় করেন নির্বাহী কর্মকর্তা বারিউল করিম খান। এ জরিমানা আদায় নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমান এক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, আমি সব সময় আইনশৃংখলা সভায় ইজারা শর্ত অমান্য করে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে যারা পাথর উত্তোলন করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন এবং যারা শর্ত মেনে পাথর উত্তোলন করছে তাদেরকে হয়রানী না করার জন্য সব সময় কথা বলে থাকি। কারণ, আমরা রাজনীতি করি মানুষের কল্যাণের জন্য। কিন্তু একজনের বাড়ীতে গিয়ে অচল অবস্থায় ফেলে রাখা ফেলুডার, স্কেবেটরের ক্ষতি সাধন ও তার ছেলেকে আটক করে ৪লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় করা কতটুকু যুক্তি সংঘত হয়েছে? অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করায় সাধুবাদ জানালেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব করায় এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
মঙ্গলবার কোয়ারি এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সাউদগ্রাম ও বড়গ্রাম এলাকায় কোয়ারির নিয়ন্ত্রণকারী প্রভাবশালী পাথর ব্যবসায়ীদের বাড়ীর আশপাশে ২৫/৩০টি স্কেবেটর ও ফেলুডার রাখা হয়েছে। অনেক ফেলুডার ও স্কেবেটর দিয়ে পাথরের গর্তের কাজও চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে জানিয়েছেন, কোয়ারিতে যা কিছু হচ্ছে প্রশাসনের জ্ঞাতসারেই হচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকে নিরাপদে সারা রাত এসব স্কেবেটর ফেলুডার দিয়ে পাথরের গর্তের কাজ চলে নিয়মিত মাশুহারা মাধ্যমে।
সচেতন মহল জানান, কোয়ারিতে অভিযান শুধুমাত্র স্কেবেটর, ফেলুডার ও পাথরের গর্তে পানি সেচের কিছু মেশিন বিনষ্টের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। ইউএনও অভিযান সমাপ্ত করে ফেরার পরই শুরু হয়ে যায় পাথর উত্তোলনের তাণ্ডবলীলা। ঝুঁকিপূর্ণ গর্ত থেকে শুরু হয় পাথর উত্তোলন।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন- শুধুমাত্র কোয়ারিতে অভিযান পরিচালনা করে ধ্বংসলীলা থামানো সম্ভব নয়। যারা বেআইনী ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিশাল বিশাল গভীর গর্ত তৈরী করে পাথর উত্তোলন করছে সেইসব পাথরের গর্ত একেবারে বন্ধ করে সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড স্থাপন এবং তাদের বিরুদ্ধে সাথে সাথে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহন করা হলে অনেকাংশে কোয়ারিতে বেআইনী কার্যক্রম বন্ধ হবে। তা না হলে নামমাত্র অভিযান করে কোয়ারি এলাকার ধ্বংসলীলা, বেপরোয়া চাঁদাবাজি বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
জানা গেছে- অদ্যাবধি যে সকল পাথর ব্যবসায়ী ইজারার শর্ত লঙ্ঘন করে পাথর উত্তোলন করে যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট অফিস অথবা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন ধরনের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। যে কারণে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ লীলাভূমি লোভাছড়া এলাকা বর্তমানে ধ্বংসের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। যে কোন সময় পুরো এলাকায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। লোভা নদীর দু’পাড় এবং নদীর পানি প্রবাহের পথ বন্ধ করে এবং ফসলী জমি থেকে ইচ্ছামতো ব্যবসায়ীরা ধ্বংসলীলা চালিয়ে পাথর উত্তোলন করে যাচ্ছে।
সম্প্রতি খনিজ সম্পদ বোরোর কর্মকর্তারা কোয়ারি এলাকা পরিদর্শন করে ধ্বংসলীলা দেখে হতবাক হন। কোয়ারি এলাকায় পাথর উত্তোলনের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থাকলেও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট অফিসের কোন কর্মকর্তা অদ্যাবধি কোয়ারির সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে সরেজমিনে আসেনি। এ নিয়ে জনমনে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া রয়েছে।
লোভাছড়া পাথর মহালের ইজারাদার মস্তাক আহমদ পলাশ কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনের শুরু থেকে ইজারার শর্ত মেনে পাথর উত্তোলনের জন্য কঠোর তৎপর থাকলেও তার কথা অনেকে মানছে না। ইজারাদারের মনোনীত লোকজন কোয়ারি এলাকার পাথরের গর্তগুলো সার্ভে করে যে সকল ব্যবসায়ী ইজারার শর্ত অমান্য করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাথর উত্তোলন করছে তাদের তালিকা খনিজ সম্পদ বোরো সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করার পরও এখনও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে প্রভাবশালী পাথর ব্যবসায়ী কোয়ারিতে তাদের রামরাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন কোয়ারিতে প্রশাসনের নামে লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি করা হচ্ছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বারিউল করিম খান বলেন, কোয়ারিতে বেআইনীভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। আমরা কয়েকবার কোয়ারিতে অভিযান করে কয়েক কোটি টাকার পাথর উত্তোলনের বেআইনী মেশিনারী যন্ত্রপাতি ধ্বংস ও অনেক ঝুঁকিপূর্ণ গর্ত থেকে পাথর উত্তোলন না করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। লোভা নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখতে অনেক গর্তের বাঁধ কেটে পানি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। কোয়ারি এলাকার পরিবেশ বজায় রাখতে পাথর ব্যবসায়ীসহ তিনি সকল মহলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
কোয়ারির ইজারাদার মস্তাক আহমদ পলাশ বলেন, ‘ইজারার শর্ত অমান্য করে যারা পাথর উত্তোলন করে যাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমি বার বার কর্তৃপক্ষের কাছে বলে আসছি। সম্প্রতি কোয়ারি এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ গর্ত থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধে এবং প্রাণহানী এড়াতে মাইকিং করা হয়েছে।’
খবর বিভাগঃ
প্রতিদিনের কানাইঘাট
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়