স্বাধীন বাংলা ভূখন্ডের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত সিলেট জেলার অন্তর্গত খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের
পাদদেশে জীবন বৈচিত্রে ভরপুর প্রাকৃতিক বৃক্ষরাজী, সবুজ পাহাড় বেষ্টিত অপরূপ দৃশ্য, প্রায়
তিন লক্ষ মানুষের আবাসভূমি, শস্য-শ্যামল চিত্তাকর্ষক পরিবেশ নিয়ে কানাইঘাট উপজেলা । ১৭
টি পরগনা নিয়ে গঠিত প্রাচীন জৈন্তা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এই জনপদ। ষোড়শ শতাব্দীতে সিলেট
আটটি মহলে বিভক্ত ছিল । তন্মধ্যে জৈন্তা ছিল অন্যতম। তখন জৈন্তা রাজ্যের রাজধানী ছিল
নিজপাঠ। ১৭৬৫ ইং সালে দেওয়ানী লাভের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জৈন্তা রাজাকে সিলেটের
ভূমি থেকে বিতাড়িত করে। ১৮২৪ সালে বার্মাদের দ্বারা (আসাম) বিজিত হওয়ার পর জৈন্তা রাজ্য
স্বাধীনতা হারায়। কিছু দিন পর ইংরেজরা বর্মিদের বিতাড়ন করে এবং ১৮২৫ সালে এ রাজ্যের
স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। ১৮৩৫ সালে জৈন্তা বিজিত হওয়ায় পূর্ব পর্যন্ত সিলেটের সীমারেখার
অন্তর্গত কানাইঘাট ও গোয়াইনঘাট তহশীলের ৫২টি পরগণা সিলেটের সীমানার মধ্যে অবস্থিত ছিল
না । ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত কানাইঘাট আসাম সীমার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ বছর
দেশ বিভাগ হলে কানাইঘাটসহ সিলেট গণভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানভুক্ত হয়। ১৮৩৫ সালে জৈন্তা
বিজয়ের পরে এ সীমানাভুক্ত স্থানকেই সিলেট নামে অভিহিত করা হয়। সিলেটের চুনাপাথর ও
বেতের ব্যবসার সুবিধার কারণে কোম্পানি ১৮৩৫ সালে জৈন্তা রাজ্যকে বাংলা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত
করে । স্বাধীন জৈন্তা রাজ্যের তৎকালীন রাজা রাজেন্দ্র সিং ও কর্নেল লিস্টারের মধ্যে ১৮৩৫
সালের ১৪ মার্চ এক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সমগ্র জৈন্তা রাজ্যকে আনুষ্ঠানিকভাবে বৃটিশ
সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয় । এতে জৈন্তা রাজ্যের অন্তর্গত কানাইঘাট এলাকা বৃটিশ সাম্রাজ্যের
অধীনে চলে যায় । আধুনকি থানা সমূহের বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত হয় কর্নওয়ালিসের সময় ১৭৯৩
খ্রিস্টাব্দের ২২ মে। ১০ বর্গ ক্রোশ এলাকা নিয়ে এক একটি থানা সংগঠনের দায়িত্ব ম্যাজিস্ট্রেটদের
উপর ন্যাস্ত ছিল । ১৭৯০ সালের ২৬ নভেম্বর বড় বড় শহর, বাজার ও গঞ্জকে থানায় রূপান্তরিত
করা হয় । তদানীন্তন প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করার সুবিধার্থে বৃটিশ সরকার ১৮৪১ সালে
মূলাগুলের ঝরনাঝরা টিলায় থানা সদর স্থাপন করে । ১৮৭২ সালে মূলাগুল হতে থানা সদর
বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত করা হয় । ১৯৩২ সালে প্রশাসনিক থানা সৃষ্টি করা হয় । ১৯৫৯ সালে
৯টি ইউনিয়ন নিয়ে কানাইঘাট থানার পথ চলা শরু হয় । ১৯৮০ সালে থানা উপজেলায় উন্নীত
করা হয় । ২০০৫ সালে কানাইঘাট সদরকে পৌরসভার ঘোষনা করে এর কার্যক্রম শুরু হয় । ৯টি
ইউনিয়নে ৪১২.২৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তন নিয়ে কানাইঘাট উপজেলা । সম্প্রতি প্রশাসনিক
বিকেন্দ্রীয়করণের তাকিদে জকিগঞ্জ থেকে দু’টি, বিয়ানীবাজার থেকে দু’টি ও কানাইঘাট উপজেলা
থেকে ৭,৮ ও ৯ নং ইউনিয়ন নিয়ে চারখাই নামে নতুন থানা গঠনের প্রস্তাবে গাছবাড়ির এই তিন
ইউনিয়নের সর্বস্তরের জনগন ফোসকে উঠে । গাছবাড়ী থানা চাই, এ স্লোগান এলাকার লক্ষাধিক
মানুষের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবী । একটা থানাকে কেন্দ্র করে নানা সুযোগ-সুবিধার সূত্রপাত হয় ।
থানা নিকটে থাকলে জি ডি করা, পুলিশ ভেরীফিকেশন, প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র, প্রশাসনিক
সুবিধা, পুলিশ সহায়তা সহজলব্ধ হয় তাছাড়া থানা থাকলে মদ, জুয়া,গান-বাজনা, দ্বন্দ্ব-মারামারি,
চুরি-ডাকাতি ও অনৈসলামিক কাজ গুলো বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণে থাকে । যুগের প্রেক্ষাপটে গাছবাড়ীতে
একটা থানা বা পুলিশ ফাঁড়ি অতীব জরুরী । কিন্তু চারখাইয়ে থানা স্থাপনের নকশার কথা শুনে
গাছবাড়ির এই তিন ইউনিয়নের মানুষ সহ পুরা কানাইঘাটবাসী প্রতিবাদী হয়ে উঠে । সুরমা নদীর
ডান ও বাম তীরবর্তী এ দুই এলাকায় জনগণের স্নায়ুও মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের রয়েছে দীর্ঘ দিনের
ইতিহাস । “মগলি ভূত , খাতার থলে হুত , জৈন্তাপুরী ভূত” এ জাতীয় ব্যাঙ্গাত্মক কথাগুলো যেন
উত্তরাধিকারী সূত্রে পাওয়া। নদী পথে যাতায়াত কালে, গদার বাজার নৌকা ঘাটে গাছবাড়ীর এক
ব্যক্তির লাশ আটকিয়ে টাকা উদ্ধারের ঘটনা-বিবেক বান মানুষের অন্তরে ক্ষতের সৃষ্টি করে ।
গাছবাড়ী এলাকার এক সম্মানিত জনপ্রতিনিধির সাথে দুর্ব্যবহার ও মনুষ্যত্বহীন আচরণের কারণে
তাদের কাছ থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে গাছবাড়ী টু হরিপুর রাস্তায় রোডম্যাপ করেন। দু’ এলাকায়
কৃষ্টি-কালচার, মন-মস্তিষ্ক, দেমাগ-মেজাদ এত ভিন্ন যে একে অপরের সাথে বৈবাহিক সর্ম্পক
স্থাপনকে অপরাধ মনে করে । এমন পরিস্থিতিতে বৃহত্তর গাছবাড়ী কখনো চারখাই থানা মেনে
নিবে না । তবে গাছবাড়ীতে কোথায় থানা স্থাপন করা হবে?!এক ইউনিয়নে স্থাপন করলে আন্য
দুই ইউনিয়নের জনগন কি জিদ দমন করতে পারবে?! হ্যাঁ যদি ভবিষৎতের প্রজন্মের কথা চিন্তা
করে, এলাকার উন্নয়নে, জনগনের কল্যাণে লকালিজমের হঠকারিতা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও
সামাজিক অনৈক্য সুরমার সুনির্মল জলরাশি দ্বারা ধৌত করে এক প্লাটকর্মে-দাড়াতে পারলে,
নেতৃস্থানীয় নেতৃবৃন্দ এ ত্যাগ স্বীকার করতে পারলে এলাকার মানুষের ভাগ্যন্নোয়নের শুভ সংকেত
। তাই ব্যক্তিগত , সামাজিক,রাজনৈতিক,দলীয় আঞ্চলিকতার সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে
এলাকার স্বার্থে দল, মত, পথ, র্ধম , বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ব হলে গাছববাড়ীতে থানা গঠন
করতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হবে । কারণ মানুষের জন্য থানা , জনগনের সেবায় পুলিশ । গাছবাড়ী
সমাজ কল্যাণ যুব সমিতির নেতৃত্বে, তিন ইউনিয়নের সম্মানিত তিন চেয়ারম্যান , এলাকার
মুরব্বিগণ , রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ , বিআরটিসি চেয়ারম্যান জনাব এহসানে এলাহী খোকন সাহেব,
সাবেক এম পি জনাব অধ্যক্ষ মাও ফরীদ উদ্দীন চৌধুরী সাহেব, বর্তমান এম পি জনাব হাফিজ
আহমদ মজুমদার সাহেব জোরালো ভূমিকা রাখলে পিছিয়ে পড়া আমাদের গাছবাড়ীতে থানা সহ
আধুনিক নগরায়নে সকল সুযোগ-সুবিধার সোতধারা শুরু হবে ।
অন্যথায় আমরা কানাইঘাট উপজেলার অন্তর্ভুক্ত আছি থাকবো, থানা চাই না , চারখাই যেতে চাই
না ।
লেখক: এম. ফিল. গবেষক, আরবী বিভাগ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল।
খবর বিভাগঃ
মতামত
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়