প্রিয়ম হাসান::
পিতা-মাতা, নিকটাত্নীয়, এতীম-মিসকীন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির দাস-দাসী, দুর্বল শ্রেণীর মানুষ এবং জীবজন্তুর সঙ্গে আচার-আচরণ স্পর্কে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন,
وَاعْبُدُواْ
اللّهَ وَلاَ تُشْرِكُواْ بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي
الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالجَنبِ وَابْنِ
السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللّهَ لاَ يُحِبُّ مَن
كَانَ مُخْتَالاً فَخُورًا
‘আর উপাসনা করো আল্লাহর, শরীক কর না
তাঁর সঙ্গে অপর কাউকে। পিতা-মাতার সঙ্গে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং
নিকটাত্নীয়, এতীম-মিসকীন, প্রতিবেশী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর
প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক-গর্বিতজনকে। (সূরা:
আন-নিসা, আয়াত: ৩৬)
পিতা-মাতার সঙ্গে সৎ ব্যবহার অর্থ-তাদের
সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। তারা কিছু জানতে চাইলে কটু ও কর্কশ ভাষায়
উত্তর দিও না, তাদের প্রতি অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করো না। বরং তাদের সঙ্গে
এমন আচরণ করো, যেমন কর্মচারীগণ মালিকের সঙ্গে করে। আত্নীয়দের সঙ্গে
অর্থ-তাদের সঙ্গে সু-সম্পর্ক রক্ষা করে চলো। ইয়াতিমের সঙ্গে অর্থ- ইয়াতিমের
সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করো, তাদের গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। মিসকিনদের
সঙ্গে অর্থ-তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করো। নিকট প্রতিবেশীদের সঙ্গে
অর্থ-যার সঙ্গে আত্নীয়তার সম্পর্ক রয়েছে, এমন প্রতিবেশীর তোমাদের ওপর তিনটি
অধিকার রয়েছে: আত্নীয়তার, প্রতিবেশীর এবং ইসলামের।
দূরের প্রতিবেশীর সঙ্গে অর্থ-আত্নীয় নয় কিন্তু প্রতিবেশী। তার সঙ্গে উত্তম আচরণ করো, তোমার ওপর তারও অধিকার রয়েছে।
হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.)
বলেছেন, প্রতিবেশীর ব্যাপারে ওহীর মাধ্যমে আমাকে এত বেশি তাগিদ দেয়া হচ্ছিল
যে; আমার মনে হচ্ছিল, প্রতিবেশীকে আমার উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেয়া হবে।
(আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)
ভ্রমনের সাথীর ব্যাপারে হজরত ইবনে আব্বাস
(রা) বলেন, যে আমার সফরকালীন বন্ধু, তার দু‘টি হক রয়েছে: প্রতিবেশীর এবং
সাহচর্যের। মুসাফির অর্থ দুর্বল কোনো পথিক, যে আপন গন্তব্য পৌঁছা পর্যন্ত
তার মেহমাদারী করতে হবে। দাস-দাসী অর্থ-কর্মচারীবৃন্দ, তাদেরকে প্রয়োজনীয়
ভাল খাদ্য, বস্ত্র দিতে হবে। তাদের ক্রটি-বিচ্যুতিগুলো ক্ষমা সুন্দর
দৃষ্টিতে দেখতে হবে। দাম্ভিক ও গর্বিত অর্থ- হজরত ইবনে আব্বাস বলেন,
দাম্ভিক হচ্ছে যে নিজেকে বড় মনে করে অথচ আল্লাহর হক আদায় করে না। আর গর্বিত
হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে আর আল্লাহর দেয়া নিয়ামত লাভ করে আল্লাহর বান্দাদের
ওপর গৌরব প্রর্দশন করে।
হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.)
বলেন, তোমাদের পূর্বে এক যুবক জাঁকজমক পুর্ণ পোশাক পরিধান করে গর্ববোধ করত
এবং অহংকার করে চলাফেরা করত। মাটি তাকে গ্রাস করে ফেলল। কিয়ামত পর্যন্ত সে
মাটির তলে দাবতেই থাকবে।
রাসূল (সা.) তার ইন্তেকালের পূর্ব মুহূর্তেও
তাগিদ দিয়েছিলেন যে, নামাজ ও অধীনস্থদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। (আবু
দাউদ, ইবনে মাজাহ)
রাসূল (সা.) আরো বলেন, অধীনস্থদের সঙ্গে
সদ্ব্যব্যবহার সৌভাগ্যের উৎস আর তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার দুর্ভাগ্যের উৎস।
(মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ)
হজরত আবু মাসউদ (রা.) বলেন, আমি একজন
ভৃত্যকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছিলাম। এই সময় আমার পেছন দিকে একটা শব্দ শুনতে
পেলাম; জেনে রেখ, হে আবু মাসউদ, আল্লাহ তায়ালাই তোমাকে এই ভৃত্যের ওপর
কর্তৃত্ব দিয়েছেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আর কখনো দাস-দাসী ও
চাকর চাকরানীকে প্রহার করব না। আমি ওকে স্বাধীন করে দিলাম। রাসূল (সা.)
বললেন, এই কাজটি না করলে আগুন তোমাকে কিয়ামতের দিন জ্বালিয়ে ছাই করে
দিত। (মুসলিম)
দিত। (মুসলিম)
মুসলিম শরিফের আর এক বর্ণনায় হজরত ইবনে উমর
(রা.) বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি নিজ দাসকে প্রহার করবে কিংবা
তাকে চড় মারবে। এর কাফফারা হচ্ছে তাকে স্বাধীন করে দেয়া।
রাসূল (সা.) বলেছেন, যারা দুনিয়াতে মানুষকে নির্যাতন ও জুলুম করে আল্লাহ তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেবেন। জামে তিরমিযী ও আবু দাউদে আছে যে, রাসূলকে (সা.) জিজ্ঞাসা করা হলো, অধীনস্থদেরকে কতবার ক্ষমা করব, রাসূল (সা.) বললেন, ‘প্রতিদিন ৭০ বার।’
রাসূল (সা.) বলেছেন, যারা দুনিয়াতে মানুষকে নির্যাতন ও জুলুম করে আল্লাহ তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেবেন। জামে তিরমিযী ও আবু দাউদে আছে যে, রাসূলকে (সা.) জিজ্ঞাসা করা হলো, অধীনস্থদেরকে কতবার ক্ষমা করব, রাসূল (সা.) বললেন, ‘প্রতিদিন ৭০ বার।’
রাসূল (সা.) মিসওয়াক করা অবস্থায় তাঁর একজন
দাসকে ডালেন। সে অনেক দেরী করে এল। রাসূল (সা.) দাসকে হাতের মিসওয়াক দেখিয়ে
বললেন, কিয়ামতের দিন বদলা পাওয়ার ভয় না থাকলে তোমাকে মিসওয়াক দিয়ে
পিটাতাম। (মুসনাদে আহমাদ, তিবরানী)
এক হাদিসে আছে যে, এক মহিলা রাসূল (সা.)-কে
বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আমার এক দাসীকে ‘ব্যভিচারিণী বলে গাল দিয়েছি।
রাসূল (সা.) বললেন, তুমি কি ব্যভিচারের কোনো লক্ষণ তার মধ্যে দেখেছ? মহিলা
বলল, না রাসূল (সা.) বললেন, ‘সাবধান! এই মেয়েটি কিয়ামতের দিন তোমার কাছে
বদলা নেবে।’ মহিলা সঙ্গে সঙ্গে তার দাসীর কাছে গিয়ে একটি লাঠি দিয়ে বলল,
আমাকে প্রহার কর। দাসীটি তাতে সম্মত হলো না। তখন ওই মহিলা তাকে মুক্ত করে
দিল।
তারপর মহিলা রাসূল (সা.)-এর কাছে এসে দাসীকে মুক্ত করার কথা বললেন। তখন রাসূল (সা.) বললেন, আশা করা যায় ‘তোমার গুনাহ ক্ষমা করা হবে।’(হাকেম)
তারপর মহিলা রাসূল (সা.)-এর কাছে এসে দাসীকে মুক্ত করার কথা বললেন। তখন রাসূল (সা.) বললেন, আশা করা যায় ‘তোমার গুনাহ ক্ষমা করা হবে।’(হাকেম)
রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি অধীনস্থদেরকে
মিথ্যা দোষরোপ করবে, কিয়ামতের দিন এই অপবাদের জন্য তাকে বেত্রাঘাতের শাস্তি
ভোগ করতে হবে। (বুখারী, মুসলিম)
রাসূল (সা.) বললেন, দাস-দাসীদের প্রয়োজনীয়
খাদ্যবস্ত্র দিতে হবে এবং তার ক্ষমতার অতিরিক্ত দায়িত্ব তার ওপর চাপানো
যাবে না। নিতান্তই যদি দায়িত্ব দিতে হয় তবে নিজেও উক্ত কাজে অংশ নিতে হবে।
আল্লাহর সৃষ্টিকে কষ্ট দিও না। তিনি তোমাদেরকে তাদের মালিক বানিয়েছে। তিনি
যদি ইচ্ছা করতেন তবে তাদেরকে তোমাদের মালিক বানাতে পারতেন। (মুসলিম)
দাস-দাসীদের, পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের,
ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের তথা কোনো আপনজনদের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ ঘটানো জঘন্য
কবীরা গুনাহ। রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি পিতা-মাতা ও সন্তানের মধ্যে
সম্পর্কচ্ছেদ ঘটাবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে তার আপনজনদের কাছ থেকে দূরে
সরিয়ে রাখবেন। (তিরমিযী)
রাসূল (সা.) আরো বলেছেন, নিজের অধীনস্থ মানুষ বা পশুকে ক্ষুধার কষ্ট দেয়ার মত বড় গুনাহ আর হতে পারে না। (মুসলিম)
রাসূল (সা.) বলেছেন, একটি বিড়ালকে বেঁধে
রেখে অনাহারে মেরে ফেরার কারণে এক মহিলা আজাব ভোগ করবে। বলাবাহুল্য যে, এ
কথা সকল প্রাণীর বেলায়ই প্রযোজ্য।
রাসূল (সা.) কোনো জীবজন্তুকে তার স্বাভাবিক
কাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করতে এবং তার ক্ষমতার অতিরিক্ত কাজে
খাটাতে নিষেধ করেছেন। কোনো জন্তু জবাই করতে হলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই
করতে হবে কারণ যাতে জন্তুটি কষ্ট না পায়। যে জন্তুকে হত্যা করতে হবে তাকে
বন্দী না রেখে প্রথম সুযোগেই হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছেন। সাঁপ, বিচ্ছু,
ইঁদুর, পাগলা কুকুর, প্রভৃতি কষ্টদায়ক জন্তুকে পুড়িয়ে হত্যা করতে কঠোরভাবে
নিষেধ করা হয়েছে। জীবজন্তুকে নিছক চিত্তবিনোদন বা সখের বশে এবং কোনো
উপকারিতা ছাড়া হত্যা করতে নিষেধ করেছেন।
দাস-দাসীকে মুক্তি দেয়া খুবই সওয়াবের কাজ।
রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার দাস-দাসীকে মুক্তি দেবে, আল্লাহ তাকে
জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্তি দেবেন। (বুখারী, মুসলিম)
মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা সব মুসলিম উম্মাহকে সৎ আচরণের তাওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।
খবর বিভাগঃ
ইসলাম
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়