Thursday, August 8

কোরবানি সুন্নত নাকী ওয়াজিব?

শহীদুল ইসলাম  ::

দ্বীন ইসলামে কোরবানির বিধান হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু হয়ে প্রত্যেক যুগেই বিদ্যমান ছিল। পবিত্র আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেক জাতির জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছি কোরবানি, যেন তারা আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক প্রদত্ত নিয়ামত পশু জবেহের সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।’ (সূরা হজ, আয়াত: ৩৪)। 

আয়াতে কোরবানি বোঝানোর জন্য শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ‘মানসাক’। অধিকাংশ মুফাস্সিরের মত হচ্ছে ‘মানসাক’ মানে হচ্ছে কোরবানি। হজরত আদম (আ.) এর দুই সন্তান হাবিল ও কাবিল এবং নূহ (আ.) ও হজরত ইব্রাহিম (আ.) প্রমুখ থেকে কোরবানির বিধান প্রমাণীত। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, কোরবানির ধারা দুনিয়ার শুরু থেকেই চলে এসেছে।

আমাদের নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর আনিত শরীয়তেও সে ধারা অব্যাহত আছে। তবে শরয়ী মর্যাদাগত দিক থেকে কোরবানির বিধান কতটুকু গুরুত্ব বহন করে সে বিষয়ে পরবর্তী ফকিহগণের মাঝে সামান্য মতানৈক্য দেখা যায়। মর্যাদাগত দিক থেকে ইখতেলাফ হলেও কোরবানি করার ব্যাপারে সকলে একমত। নিম্নে ফকিহগণের মাঝে কোরবানির বিধানগত গুরুত্বের স্তরের বিবরণ তুলে ধরা হলো।
মালেকি মাজহাবে কোরবানির বিধান:
ইমাম মালেক (রাহ.) এর মত হচ্ছে কোরবানি করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। যার কোরবানি করার সামর্থ্য আছে, সে কোরবানি না করা অপছন্দনীয় বিষয়। নিম্নে মালেকি মাজহাবের ফিকহের কিতাব থেকে উদ্বৃতি দেয়া হলো। মালেকি মাজহাবের প্রসিদ্ধ ফিকহ গ্রন্থ ‘আল মুদাওয়ানাতুল কুবরা’ তে ইমাম মালেক (রাহ.) এর কথা নকল করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি পছন্দ করি না, যার কোরবানি করার সামর্থ্য আছে সে কোরবানি না করা।’ (পৃষ্ঠা-৭০, পৃষ্ঠা-৩) ইমাম মালেক (রাহ.) সুন্নত বলার দলিল হচ্ছে নবী করিম (সা.) এর একটি হাদিস। যেখানে বলা হয়েছে, যাদের কোরবানি করার ইচ্ছা আছে জিলহজ মাস শুরুর হওয়ার পর তারা যেন নিজেদের নখ, চুল ইত্যাদি না কাটে। (সহীহ মুসলিম)। উল্লিখিত হাদিসে কোরবানি করতে বাধ্য করা হয়নি বরং ঐচ্ছিক রাখা হয়েছে। যদি কোরবানি ওয়াজিব হতো তাহলে ঐচ্ছিক রাখা হতো না।
শাফী মাজহাবে কোরবানি:
ইমাম শাফী (রাহ.) এর মত ইমাম মালেক (রাহ.) এর মতোই অর্থাৎ কোরবানি করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। সক্ষম ব্যক্তির ছেড়ে দেয়া অনুচিত। ইমাম শাফী (রাহ.) এর কিতাব ‘আল উম্মু’ তে বলা হয়েছে, ‘কোরবানি করা সুন্নত, ছেড়ে দেয়া পছন্দনীয় বিষয় নয়।’ (কিতাবুল উম্ম, খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-২৫৫)। তাদের সুন্নত বলার আরেকটি দাবি হচ্ছে বাইহাকি শরীফের এক বর্ণনা। সেখানে এসেছে হজরত আবু বকর ও উমর (রা.) ওয়াজিব হয়ে যাওয়ার ভয়ে এক দুই বছর কোরবানি করেননি। যদি কোরবানি পূর্ব থেকে ওয়াজিব হতো তাহলে তারা কোরবানিকে ছাড়তেন না। যুক্তি দিয়েও কোরবানি ওয়াজিব হওয়াকে রদ করা হয়। বলা হয় কোরবানি হচ্ছে পশু জবেহ করা। আমরা দেখি আকিকার জন্য পশু জবেহ করা হয়। আকিকার বিধানগত স্তর হচ্ছে মুস্তাহাব। অতএব কুরবানিও মুস্তাহাব হবে।
হাম্বলি মাজহাবে কোরবানির বিধান:
কোরবানির বিধানগত স্তর বর্ণনা করতে হাম্বলি মাজহাবের প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আল মুগনি’ তে লেখা হয়েছে, ‘অধিকাংশ আলেমগণের মত হচ্ছে কোরবানি করা সুন্নত, ওয়াজিব নয়। (খন্ড-১৩, পৃষ্ঠা-১২২)। তবে ইমাম আহমদ (রাহ.) থেকে একটি বর্ণনা পাওয়া যায় যে, ইয়াতিম যদি সামর্থ্যবান হয় তাহলে তার পক্ষ থেকে তার অভিভাবককে কোরবানি করতে হবে। এর দ্বারা কোরবানি ওয়াজিব হওয়াই বুঝা যায়। তবে হাম্বলি মাজহাবের কোনো কোনো আলেম ইমাম আহমদের এই মতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈদের দিন খাবারে বিলাসিতা করা। এর দ্বারা ওয়াজিব বোঝানো কখনো উদ্দেশ্য নয়। (মুগনি লিইবনে কুদামা, খন্ড-১৩, পৃষ্ঠা-১২২)।
উল্লিখিত তিন মাজহাবেরই কোরবানির ব্যাপারে মত হচ্ছে তা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। ওয়াজিব নয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে হানাফি মাজহাব মতে, ফরজ ও সুন্নতের মাঝে শরয়ী বিধানের একটি স্তর রয়েছে, যাকে ওয়াজিব বলা হয়। কিন্তু অন্যান্য মাজহাবে এই স্তরটি নেই। তাই যারা কোরবানিকে সুন্নত বলেছেন, তাদের উদ্দেশ্য কখনো এটা নয় যে, স্বাভাবিক কোনো সুন্নতের মতোই কোরবানি করাও একটা সুন্নত। বরং অন্যান্য সুন্নতের তুলনায় এর গুরুত্ব অনেক বেশি। গুরুত্বের দিক থেকে হানাফি মাজহাব মতে যার পর্যায় হচ্ছে ওয়াজিবের।
হানাফি মাজহাব মতে কোরবানির বিধান:
হানাফি মাজহাবের ইমামগণের মাঝে কোরবানির বিধান নিয়ে দুটি মত পাওয়া যায়। ইমাম মুহাম্মাদ ও আবু ইউসুফ (রাহ.) এর মতে কোরবানি করা সুন্নত। ইমাম আবু হানিফা (রাহ.) এর মতে কোরবানি করা ওয়াজিব। ইমাম আবু হানিফা (রাহ.) এর দলিল হচ্ছে কোরআন, সুন্নাহ।
কোরআন থেকে আবু হানিফা (রাহ.) এর দলিল-
ইমাম আবু হানিফা (রাহ.) স্বীয় মাজহাবের সমর্থনে কোরআনের আয়াত দ্বারা দলিল পেশ করেছেন। সূরা কাউসারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপনি রবের উদ্দেশে নামাজ পড়ুন তারপর জবেহ করুন।’ এখানে নামাজ দ্বারা ঈদের নামাজ এবং জবেহ দ্বারা কোরবানির পশু জবেহ উদ্দেশ্য। যেমন ‘আল মুগনি লিইবনে কুদামা’ নামক কিতাবে বলা হয়েছে ‘কোরবানি কোরআন, সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা প্রমাণীত।’ তারপর তিনি কোরআন থেকে দলিল পেশ করেন সূরা কাউসারের এই আয়াত দ্বারা। (খন্ড-১৩, পৃষ্ঠা-১২২)  তাফসিরের বহু কিতাবে বলা হয়েছে সূরা কাউসারের ‘নহর’ দ্বারা কোরবানির পশু জবেহ করাই উদ্দেশ্য। যেমন তাফসিরে কাবিরে ফখরুদ্দীন রাজি (রাহ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখেন ‘নহর শব্দের ব্যাখ্যায় দুটি মত আছে। প্রথম মতটি অধিকাংশ মুফাসসিরের। তা হচ্ছে পশু জবেহ করা।’ (খন্ড-১৬, পৃষ্ঠা-৩৫৪)। 
ইমাম আবু বকর আল জাস্সাসও এরূপ মত দিয়েছেন। সবচেয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন ইবনে কাসির (রাহ.)। তিনি উক্ত আয়াতের বিভিন্ন ব্যাখ্যা লেখার পর বলেন ‘এই সকল ব্যাখ্যা হচ্ছে একেবারেই দূরবর্তী। বিশুদ্ধ মত হচ্ছে প্রথমটি যে, নহর দ্বারা উদ্দেশ্য কোরবানির পশু জবেহ করা। আয়াতের বাক্য বিন্যাসের দিকে লক্ষ করেই নবী করিম (সা.) প্রথম ঈদের নামাজ আদায় করতেন। তারপর কোরবানির পশু জবেহ করতেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খন্ড-৮, পৃষ্ঠা-৪৭৩)।
তাফসিরের এ সকল কিতাবের উদ্বৃতি দ্বারা প্রমাণ হলো নহর দ্বারা কোরবানির পশু জবেহ করা উদ্দেশ্য। এবং আয়াতে ব্যবহৃত শব্দ হচ্ছে নির্দেশবাচক। ফিকহের মূলনীতি হচ্ছে কোনো বিষয় করার জন্য নির্দেশবাচক শব্দ ব্যবহার করা হলে তা বাস্তবায়ন করা বান্দার ওপর ওয়াজিব। সেই মূলনীতির আলোকেই ইমাম আবু হানিফা (রাহ.) এর মত হচ্ছে কোরবানি করা সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব। তাছাড়া তিনি মতের সমর্থনে কয়েকটি হাদিস পেশ করেছেন। যেমন এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোনো লোক কোরবানি না করলে সে যেন আমার ঈদগাহের নিকটেও না আসে। (মুসতাদরেকে হাকীম) ইমাম হাকীম (রাহ.) উক্ত হাদিসের সনদকে সহীহ বলেছেন এবং রিজাল শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমাম আল্লামা জাহাবী (রাহ.) তার মতকে সমর্থন করেছেন। 
ইমাম আবু হানিফা (রাহ.) বলেন, কোরবানি করা যদি ঐচ্ছিক কোনো বিষয় হত তাহলে রাসূল (সা.) কোরবানি ত্যাগকারীকে এত কঠিন কথা বলতেন না। মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সা.) নামাজের আগে পশু জবেহকারীকে পুনরায় কোরবানি দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। এবং এরকম অর্থের আরো কয়েকটি হাদিস সেখানে বর্ণিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আবু হানিফা (রাহ.) এর যুক্তি হচ্ছে কোরবানি ওয়াজিব না হলে পুনরায় কোরবানি করার নির্দেশ দিতেন না। এর দ্বারাই প্রমাণীত হয় কোরবানি করা ওয়াজিব। তাছাড়া কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার পর রাসূল (সা.) কখনো কোরবানি করেননি এমন হয় নাই। যদি বিরত থাকার সুযোগ থাকতো তাহলে বিরত থাকা জায়েজ তা বুঝানোর জন্য হলেও নবী করীম (সা.) দু, একবার কোরবানি থেকে বিরত থাকতেন। তাই বিশুদ্ধ মত হচ্ছে কোরবানি ঐচ্ছিক বা সুন্নত পর্যায়ের কোনো বিষয় নয়। বরং কোরবানি করা সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব।
একটি ভুল নিরসন:
(এক) একটি উটে দশজন শরিক হতে পারবে, এমন একটি প্রচারণা কিছু ভাই করে যাচ্ছেন। এটি নতুন কোনো বিষয় নয়। তাবেয়ীদের যুগেই এই বিষয়ের সমাধান হয়ে গেছে। ইমাম তিরমিজী (আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের সর্ব্বোচ্চ মাকাম নসিব করুন) পক্ষ-বিপক্ষের হাদিস এনে বিষয়টিকে সমাধান করে গেছেন। এখানে মূলত দশজন শরীক হওয়ার হাদিসের ব্যাপারে মত হচ্ছে, হাদিসটি ‘গরিব’ পর্যায়ের, যা তারচেয়ে তুলনামূলক শক্তিশালী হাদিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়েছে।
ওই হাদিসটি হচ্ছে, উট ও গরুতে সাতজনের বেশি কেউ শরীক হতে পারবে না। ইমাম তিরমিজী এই হাদিসের উদ্বৃতি দেয়ার পর বলেন, ‘সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীদের মত হচ্ছে এই হাদিস অনুযায়ীই আমল করতে হবে। সুফিয়ান ছাওরী, আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক, শাফী ও আহমদ প্রমুখের মতও এমনটাই। তবে ইসহাক ইবনে রাহওয়াই বলেন, একটা উট দশজনের জন্য যথেষ্ট। তিনি স্বপক্ষে ইবনে আব্বাসের হাদিস দ্বারা দলিল পেশ করেন।’ (সুনানে তিরমিজী -১৫০১)। ইবনে আব্বাসের হাদিসটি তুলনামূলক দুর্বল যা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। তাই বর্তমানে একটি উট, গরু বা মহিষে দশজন শরিক হওয়ার কোনোভাবেই বৈধ হবে না।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে অনেকে বলে থাকেন, একটি পশু এক পরিবারের জন্য যথেষ্ঠ। পরিবারের সদস্য, যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব যতই হোক না কেন। অধিকাংশ ফকিহগণের মত হচ্ছে একটি গরু, উট বা মহিষ সর্বোচ্চ সাতজনের জন্য যথেষ্ঠ। এর অধিক ব্যক্তির জন্য যথেষ্ঠ হবে না। চাই তারা একই পরিবারের সদস্য হোক বা ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের। এই বিষয়ের আলোচনা পরবর্তী কোনো লেখায় হবে। ইনশাআল্লাহ!

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়