প্রিয়ম হাসান ::
‘কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোনো কমতি হবে না।’ (সহীহ মুসলিম: ২৬৭৪)।
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য নিবেদিত।
দরূদ ও সালাম অবতীর্ণ হোক সেই মহান নবী (সা.) এর ওপর যার পরে আর কোনো নবী
নেই। আরো নাজিল হোক তাঁর পরিবার বর্গ, সহচর বৃন্দ এবং তাঁর হেদায়াতের
অনুসারীদের ওপর।
অত:পর হে মুসলিম ভাই! এ কথা জেনে নিন যে,
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা সকল বান্দার ওপর ইসলামে প্রবেশ করা, উহা
আঁকড়ে ধরা এবং উহার পরিপন্থী বিষয় থেকে সতর্ক থাকা ফরজ করেছেন। আর নবী
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সে দিকে আহবান করার জন্যই
প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ এই মর্মে ঘোষণা দিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুসরণ করবে সে হেদায়াত প্রাপ্ত হবে
পক্ষান্তরে যে তাঁর থেকে বিমুখ হবে সে পথভ্রষ্ট হবে। তিনি বহু আয়াতে
মুরতাদ হওয়ার মাধ্যম, শির্ক ও কুফরীর সকল প্রকার হতে সতর্ক করেছেন।
বিদ্যানগণ মুরতাদের বিধি-বিধান অধ্যায়ে এই
মর্মে উল্লেখ করেছেন যে, একজন মুসলমান ব্যক্তির রক্ত ও ধন-সম্পদ হালালকারী
বিভিন্ন ইসলাম বিধ্বংসী কার্য কলাপ সম্পদনের মাধ্যমে মুরতাদ ও ইসলাম হতে
বহিস্কার হয়ে যায়।
ইসলাম বিধ্বংসী কাজ হলো সর্ব মোট ১০টি যা
শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ বিন সুলায়মান আত তামীমী (রহি.) ও অন্যান্য
বিদ্বানগণ উল্লেখ করেছেন। আমরা ওই সকল ইসলাম বিধ্বংসী কাজগুলো নিন্মে
সংক্ষিপ্ত ভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ আপনাদের জন্য উল্লেখ করছি। যাতে আপনি
উক্ত বিষয়গুলো থেকে সতর্ক থেকে অপরকে সতর্ক করতে পারেন।
ইসলাম বিধ্বংশী কাজগুলো নিন্মরূপ-
(১) আল্লাহর ইবাদতে শিরক করা। আল্লাহ বলেন,
إنَّ اللهَ لاَيَغْفِرُ أنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ ماَ دُوْنَ ذلكَ لِمَنْ يَشاَءُ
‘নিশ্চয় আল্লাহ তার সঙ্গে শিরক করাকে ক্ষমা করেন না। উহা ব্যতিরেকে উহার নিন্ম পর্যায়ের পাপ সবই তিনি যাকে ইচছা ক্ষমা করেন।’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ১১৬)।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,
إنَّهُ مَنْ يُشْرِكُ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظاَّلِمِيْنَ مِنْ أنْصَارِ
‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি শিরক করবে আল্লাহ তার ওপর জান্নাত হারাম করে দেবেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম, আর এই সমস্ত যালিমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী থাকবে না।’ (সূরা: মায়েদাহ, আয়াত: ৭২)।
জ্ঞাতব্য: এই শিরকের অন্তর্ভূক্ত হলো, মৃতকে আহবান করা, তাদের নিকট ফরিয়াদ করা, তাদের জন্য নযর-নেয়াজ মানা ও পশু জবেহ করা। যেমন কোনো ব্যক্তি জ্বিনের জন্য বা কোনো কবেরর জন্য জবেহ করল ইত্যাদি।
(২) নিজের ও আল্লাহর মধ্যে মধ্যস্থতা সাব্যস্ত করে তাদের ওপরেই ভরসা রাখা। এই ধরণের ব্যক্তি সর্ব সম্মতিক্রমে কাফের বলে গণ্য।
(৩) মুশরিককে মুশরিক বা কাফেরকে কাফের না বলা বা তাদের কুফরীতে সন্দেহ পোষণ করা কিংবা তাদের ধর্মকে সঠিক ভাবা।
(৪) এই বিশ্বাস করা যে অন্যের আদর্শ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের চাইতে অধিক পূর্ণাঙ্গ। কিংবা এই বিশ্বাস করা যে, অন্যের বিধান নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিধান অপেক্ষা অধিক উত্তম। (যেমন কেউ কেউ তাগুতের বিধানকে নবীর (সা.) বিধানের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে থাকে) সে ব্যক্তি কাফের বলে গণ্য হবে।
(৫) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনিত কোনো বস্তুকে ঘৃণার চোখে দেখা। এমতাবস্থায় সে কাফের বলে গণ্য হবে যদিও সে ওই বস্তুর ওপর বাহ্যিক ভাবে আমল করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
ذلكَ بِأنَّهُمْ كَرِهُوا ماَ أنْزَل اللهُ فَأحْبَطَ أعْماَلَهُمْ
‘ইহা এজন্যই যে, তারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিষয়কে ঘৃণা করেছে সুতরাং আল্লাহ তাদের আমল গুলোকে পণ্ড করে দিয়েছেন।; (সূরা: মুহাম্মাদ, আয়াত: ৯)।
(৬) দ্বীনের কোনো বিষয় নিয়ে বা তার পুরস্কার কিংবা শাস্তিকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
قُلْ أبِاللهِ وآياَتِهِ وَرَسُوْلِهِ كُنْتُمْ تستهزئون . لاَ تَعْتَذِرُوْا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إيْماَنِكُمْ
‘আপনি বলুন (হে রাসূল) তোমরা কী আল্লাহর সঙ্গে, স্বীয় আয়াত সমূহের সঙ্গে এবং রাসূলের সঙ্গে ঠাট্টা করছিলে? কোনো প্রকার ওজর-আপত্তির অবতারণা কর না। তোমরা ঈমান আনয়নের পর আবার কুফরী করেছ।’ (সূরা: তাওবাহ, আয়াত: ৬৫-৬৬)
(৭) জাদু-টোনা করা: জাদুর অন্যতম প্রকার হলো তন্ত্র-মন্ত্রের সাহায্যে দুজন মানুষের বন্ধন তৈরী করা বা তাদের মাঝে সম্পর্ক ছিন্ন করা। সুতরাং যে ব্যক্তি যাদু করবে বা তাতে রাজি হবে সে কাফের বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وماَ يُعَلِّماَنِ مِنْ أحَدٍ حَتىَّ يَقُوْلاَ إنَّماَ نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلاَ تَكْفُرْ
‘ওই দু’জন (হারূত- মারুত ফেরেস্তা) কাউকে জাদু শিক্ষা দিতেন না যতক্ষণ পর্যন্ত এই কথা না বলতেন-নিশ্চয় আমরা (তোমাদের জন্য) পরীক্ষা স্বরূপ। সুতরাং (আমাদের নিকট জাদু শিখে) কাফের হয়ো না।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১০২)।
(৮) মুশরিকদেরকে মুসলমানদের বিরূদ্ধে সাহায্য সহযোগিতা করা। আল্লাহ তায়ালার বাণী,
وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإنَّهُ مِنْهُمْ ، إنَّ اللهَ لاَ يَهْدِيْ الْقَوْمَ الظاَّلِمِيْنَ
‘তোমাদের মধ্য হতে যে ওদের (অর্থাৎ বিধর্মীদের) সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে সে তাদেরই দলভূক্ত বলে গণ্য হবে। নিশ্চয় আল্লাহ যালেমদেরকে হেদায়াত দান করেন না।’ (সূরা: মায়েদা, আয়াত: ৫১)।
(৯) এ বিশ্বাস করা যে, কারোর জন্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শরীয়তের বাইরে থাকার অবকাশ রয়েছে। যেমন (এক শ্রেণীর ভণ্ড সূফীর ধারণা অনুপাতে) অবকাশ ছিল খিযির (আ:) এর জন্য মূসার (আ:) শরীয়ত হতে বাইরে থাকার। এ বিশ্বাসেও সে কাফের হয়ে যাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الإسْلاَمِ دِيْناً فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوِ فِيْ الآخِرَةِ مِنَ الْخاَسِرِيْنَ
‘যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্ম অন্বেষণ করবে তার থেকে তা গ্রহন করা হবে না। এবং সে পরকালে ক্ষতি গ্রস্থদের দলভূক্ত হবে।’ (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ৮৫)।
(১০) সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহর দ্বীন হতে বিমুখ থাকা। সে ব্যাপারে জ্ঞানার্জন না করা, তদানুযায়ী আমল না করা, এই ধরণের মন-মানষিকতার ব্যক্তিও কাফের বলে পরিগণিত হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَمَنْ أظْلَمُ مِمَّنْ ذُكِّرَ بِآياَتِ رَبِّهِ ثُمَّ أعْرَضَ عَنْهاَ ، إناَّ مِنَ الْمُجْرِمِيْنَ مُنْتَقِمُوْنَ
‘ওই ব্যক্তি অপেক্ষা কে বেশি যালিম (অত্যাচারী) হতে পারে, যাকে উপদেশ দেয়া হয়েছে স্বীয় প্রতিপালকের আয়াত সমূহ দ্বারা অত:পর সে উহা হতে বিমুখ হয়েছে? নিশ্চয় আমি অপরাধীদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ কারী।’ (সূরা: সাজদাহ, আয়াত: ২২)।
কোনো লোক এ সকল বিষয়ে লিপ্ত হলে সে কাফের
বলে বিবেচিত হবে। চাই সে মজা করার জন্য এ সকল কাজ করুক বা গুরুত্ব সহকারে
করুক, সেচ্ছায় করুক বা ভয়ে করুক। অবশ্য কাউকে যদি বাধ্য করা হয় তবে তার
ব্যাপার আলাদ। এ সমস্ত ইসলাম বিধ্বংশ বিষয় অত্যন্ত মারাত্মক। তার পরও তা
ব্যাপকভাবে এসব সংগঠিত হয়ে থাকে।
সুতরাং মুসলিম ব্যক্তির ওপর অপরিহার্য
কর্তব্য হলো এ সকল বিষয় থেকে সতর্ক থাকা। আমরা আল্লাহর নিকট তার ক্রোধ
অবধারিত বিষয়গুলো হতে এবং তাঁর যন্ত্রনা দায়ক শাস্তি হতে আশ্রয়
প্রার্থনা করছি। সৃষ্টির সেরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
ওপর, তাঁর পরিবারের ওপর, সাহাবীগণের ওপর আল্লাহ রহমত ও শান্তির ধারা
অবতীর্ণ হোক।
উল্লেখিত চতুর্থ প্রকার ইসলাম বিধ্বংশী
বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত হবে ওই ব্যক্তি যে বিশ্বাস করে যে, মানুষ যে সমস্ত
সংবিধান রচনা করেছে উহা ইসলামী সংবিধানের চেয়েও উত্তম, অথবা উহার সম
পর্যায়ের অথবা এই বিশ্বাস করে যে, ওই সমস্ত মানব রচিত বিধানের নিকট
ফায়সালা তলব করা জায়েয, যদিও শরীয়তের বিধানকেই সে উত্তম মনে করে- এধরণের
সকল বিশ্বাসই চতুর্থ প্রকার ইসলাম বিধ্বংশী বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত।
অনুরূপভাবে যদি কেউ বিশ্বাস করে যে ইসলামের
বিধি-বিধান এই বিংশ শতাব্দীতে বাস্তবায়ন যোগ্য নয়। অথবা এই বিশ্বাস করে
যে, ইহাই মূলত: মুসলিমদের পশ্চাদ মুখী হওয়ার কারণ। অথবা উহাকে সে স্বীয়
প্রতি পালকের সঙ্গে সম্পর্ক করার মধ্যেই সীমিত রাখে, জীবনের অন্যান্য
বিষয়ের কোনো কর্তৃত্ব নেই বলে ধারণা করে। অর্থাৎ বলে যে শরীয়ত ব্যক্তিগত
জিনিস, সমাজ, রাষ্ট বা জীবনের অন্য ক্ষেত্রে শরীয়তের প্রয়োজন নাই তাহলে
সেও চতুর্থ প্রকার ইসলাম বিধ্বংশকারী আমল সম্পাদনকারী কাফেরদের দলভূক্ত
হবে।
অনুরূপ ভাবে চতুর্থ প্রকারে শামিল হবে ওই
ব্যক্তির কথা যে এমনটি ধারণা করে যে, চোরের হাত কাটা, বিবাহিত ব্যাভিচারীকে
পাথর মেরে হত্যা করা ইত্যাদী আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা আধুনিক যুগের
জন্য উপযোগী নয়।
অনুরূপ ভাবে চতুর্থ প্রকারের অন্তর্ভূক্ত ওই
ব্যক্তির কথা, যে বিশ্বাস করে যে বৈষয়িক বিষয় সমূহ এবং দণ্ডবিধি
ইত্যাদির ব্যাপারে শরিয়ত ব্যতীত অন্য বিধান দিয়ে ফায়সালা করা জায়েয।
যদিও সে এই বিশ্বাস না রাখে যে উহা শরীয়তের বিধান অপেক্ষা উত্তম। (তবুও সে
কাফের বলেই গণ্য হবে) কারণ সে এর মাধ্যমে এমন বিষয়কে হালাল করেছে যা
আল্লাহ হারাম করেছেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হারাম কৃত বিধানকে হালাল করবে
যার হারাম হওয়া দ্বীন ইসলামে সর্বজন বিদিত। যেমন: ব্যাভিচার করা, মদ্যপান
করা, সূদী কারবার করা, আল্লাহর শরীয়ত ব্যতীত অন্য বিধান দ্বারা ফায়সালা
করা ইত্যাদী বিষয়কে যে হালাল মনে করবে সে মুসলমানদের সর্ব সম্মতিক্রমে
কাফের বলে গণ্য হবে।
আমরা আল্লাহর সমীপে এই কামনা করি, তিনি যেন
সকলকে তাঁর সন্তুষ্টি মূলক কাজের তাওফীক দেন এবং আমাদেরকে এবং সমস্ত
মুসলিমদেরকে সঠিক পথের হেদায়াত দান করেন। নিশ্চয় তিনি সর্ব শ্রোতা ও
নিকটবর্তী। আল্লাহ তায়ালা নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম,
তাঁর পরিবার বর্গ ও সাহাবীদের উপর রহমত ও শান্তির ধারা অবতীর্ণ করুন।
আল্লাহুম্মা আমীন।
খবর বিভাগঃ
ইসলাম
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়