Sunday, May 12

হেলেনারা ঝরে যাক, ইফতারী জিন্দাবাদ!

এহসানুল হক জসীমঃঃ
কী হল সিলেটের কানাইঘাটে, কী হল বৃহত্তর জৈন্তায়? নারকীয়-দানবীয় পৈশাচিক ঘটনা ঘটছে কেন একের পর এক? নিরাপদ জায়গা যেখানে নিজগৃহ, সেই গৃহ কেন রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে? মানুষ কেন জবাই হচ্ছে আপন বিছানায়? লাশ কেন ঝুলছে গৃহের কোণায়? নৃশংস কোন ঘটনার সংবাদ কখনো পড়তাম পত্রিকার পাতায়; সেই ঘটনা ঘটতো শহর-নগরের কোন চিপা গলিতে কিংবা কোন ফ্লাট বাসায়। শান্তিপূর্ণ নিরীহ গ্রামীন জীবনে সেই নৃশংসতা চলে গেল? কিয়ামত কি সমাগত প্রায়?

তিন অবুঝ কন্যা সন্তানের জননী চরিত্রহীন হুসনার পরকীয়ার বলি হয়েছেন ঐ তিন নিষ্পাপ বাচ্চার জনক কানাইঘাটের ফারুক আহমদ। যে গৃহে সন্তান তিনটি পয়দার সকল আনুষ্ঠানিকতা চলেছিল, সেই গৃহে পাষাণী তার বিছানাসঙ্গীদের নিয়ে স্বামীকে জবাই করে পানির ট্যাংকে লাশ পুরে ঢাকনায় আবৃত করে। আহারে! যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন একটি রিমোট ভিলেজেও তাহলে এমন পাষাণী আছে? সেথায়ও নির্মমতা হার মানাল? নাবালিকাগুলোর বাবা আজ কবরে, মা কারাগারে। ওদেরে দত্তক দেওয়ার ব্যবস্থা-ই সম্ভবত তাদের কলংক তিলক কিছুটা মোচনের একমাত্র সমাধান।

নৃশংস সেই ঘটনার এক সপ্তাহ না পেরোতেই এক স্ত্রীর লাশ ঝুললো, একই উপজেলার ভিন্ন একটি গ্রামে। গাছবাড়ী নয়াগ্রামে গৃহবধূ জেসমিন আক্তারের মৃত্যু আত্মহত্যা বলে শুরুতেই চালিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে- স্বামী ও তার পরিবারের লোকজনের নির্যাতনে পরিকল্পিত হত্যার পর আত্মহত্যার নাটক। পরের সূর্যোদয়ের পরই জৈন্তাপুরের ঘিলাতৈল গ্রাম থেকে ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয় আরেক গৃহবধূর, নববধূর। বাবার বাড়ি থেকে পাঠানো ইফতারি নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে গালমন্দ করায় নববধূ হেলেনা আত্মহত্যা করেন। সিলেট অঞ্চলের কু-প্রথা এই ইফতারী আজ মুত্যুর মুখে ঠেলে দিলো হেলেনাকে। তারপরও শ্বশুর বাড়ির লোকজন কি বলবে- ইফতারী জিন্দাবাদ!

বাবার বাড়ি থেকে ইফতারী পাঠানো- এটা সিলেট অঞ্চলের একটি প্রতিষ্ঠিত সামাজিক প্রথা। অন্যান্য অঞ্চলেও হয়তো আছে, কিন্তু সিলেট অঞ্চলের এই প্রথাটি বেশ ভয়ানক এবং মারাত্মক। বাপের বাড়ি থেকে সারাটি জীবন ইফতারী পাঠানোর প্রচলন রয়েছে, যতক্ষণ স্বামীর বাড়িতে ওই মহিলার দেহে প্রাণ আছে। নববধূর ক্ষেত্রে প্রথাটি তার সকল ভয়াবহতা নিয়ে হাজির হয়। বিয়ের পর প্রথম বছর ইফতারী মেয়ের জামাইর বাড়িতে পাঠাতে হয় অনেক বেশি পরিমাণে। মেয়ের বাবার সাধ্য থাকুক কিংবা না-ই থাকুক; বিয়ের বছরের প্রথম রমজানে বেশ ভালো বাজেট রাখতে হয়। রমজানের প্রথম দিন এক দফা পাঠাতে হয়, ১৫ রমজানের দিকে তথা মাঝামাঝিতে আরেক দফা, শেষ দিকে আরেক দফা কিংবা ঈদের দিন। মেয়ে বিয়ে দিয়ে যে পিতা রিক্ত হয়ে গেলেন, কয়েক দিন কিংবা কয়েক মাস পর সেই মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের পিতা কেমন পাঠাবে তার মেয়ের স্বামীর বাড়ি বিশাল ইফতারী; এবং তিনবার।

পিতা-মাতা বহু কষ্টে যে ইফতারী পাঠান, সেটার জন্যও নববধূকে স্বামীর বাড়িতে যে কত কটূ কথা শুনতে হয় আর মানসিক যন্ত্রণা সইতে হয়; ভোক্তভোগীরাই জানে। 'কম হয়ে গেছে', 'অমুকের বাড়ি থেকে কত কিছু পাঠিয়েছে', 'তুমি ফকিরনির মাইয়্যা' ইত্যাদি নানা কথা। রবী ঠাকুরের হৈমন্তি গল্পে পণের জন্য হৈমন্তিকে মানসিক যন্ত্রণা সইতে সইতে একটা পর্যায়ে তাকে চলে যেতে হয় না ফেরার দেশে, এবং অকালে। সিলেট অঞ্চলের নববধুদের এবং বধূদের অনেকেই তাদের শ্বশুরবাড়িতে রমজানের ইফতারী এবং জৈষ্ঠ্য মাসের আম-কাঁঠালের নাইওরীর জন্য কি তার চাইতে কম মানসিক যন্ত্রণা সইতে হয়। শ্বশুর বাড়ির পরিবারের লোকজন তো শুধু কথা শুনায় না; এ ঘর ও ঘর এবং প্রতিবেশিরা নানা কথা কহিয়া যায়; যদি তারা ইফতারী ও আম-কাঁঠালের নাইওরীর ভাগ না পায়।

চার মাস আগে বিয়ে হওয়া হেলেনার বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়িতে ইফতারি পাঠানো হয় শুক্রবার। সেই ইফতারি নিয়ে শ্বশুর বাড়ির লোকজনের গালমন্দ শুনতে হয় হেলেনাকে। এরই জের ধরে শনিবার বিকেলে নিজ ঘরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন হেলেনা। কল্পনা করুন তো, বাপের বাড়ির ইফতারী আসার পরও হেলেনাকে কত কথা শুনতে হয়, মানসিক যন্ত্রণা সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে। আত্মহত্যা যদি মহাপাপ হয়; তাহলে যাদের প্ররোচনায় এবং যে ইফতারীকে কেন্দ্র করে হেলনা ঝুলে সিলিং ফ্যানে; সেই ইফতারী প্রথা তাহলে কতটা জঘন্য। আমরা কি তাহলে বলবো যে, হেলেনারা ঝরে গেলেও ঝরে যাক, তবুও ইফতারী প্রথা জিন্দাবাদ!

কানাইঘাট নিউজ ডটকম/১২মে ২০১৯ ইং

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়