Friday, April 12

রমজানে ওমরার বিশেষ ফযিলত ও বিধিবিধান

শহীদুল ইসলাম :

ওমরার পরিচয়: ওমরা শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জিয়ারত করা, সাক্ষাত করা। পরিভাষায় ওমরা বলা হয়, নির্দিষ্ট কিছু বিষয় মেনে বাইতুল্লাহ শরিফের জিয়ারত করা। (আল ফিকহুল হানাফি ফি ছাওবিহিল জাদিদ, খন্ড-২, পৃষ্ঠা-৪৭২)।

ওমরার ফযিলত:  নফল ইবাদত যত বেশি আদায় করা যায় ততই সওয়াব। ওমরার ক্ষেত্রেও একই কথা। যতবেশি ওমরা আদায় করা যাবে সওয়াব ততবেশি হবে। ওমরার ফযিলত প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) বলেন, ‘প্রথম ওমরা আদায়ের পর দ্বিতীয় ওমরা আদায় করার দ্বারা দুই ওমরার মাঝের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয় এবং যথাযথভাবে হজ আদায় করার প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত।’ (সহিহ বোখারি-১৭৭৩)। অবশ্য গুনাহ মাফের ব্যাপারে উলামায়ে কেরামের মত হচ্ছে এর দ্বারা শুধু সগিরা গুনাহ মাফ হবে আর কবিরা গুনাহ মাফের জন্য তওবা করা শর্ত।
রমজানে ওমরা করলে হজের সমান ছওয়াব: ওমরা আদায়ে বিশেষ ফযিলতের কথা আলোচনায় এসেছে। তবে অন্যান্য মাসের চেয়ে রমজানে ওমরা আদায় করলে ফযিলত আরো বেশি। হাদিসটি ইবনে আব্বাস (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি এক মহিলার। সে বাহনের অভাবে রাসূল (সা.) এর সঙ্গে হজ করতে পারেনি। রাসূল (সা.) হজ করতে না পারার কারণ সম্পর্কে জানতেন না। তাই তিনি ওই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমাদের সঙ্গে কেন হজ করলে না? মহিলা বাহনের অভাবের কথা জানালে রাসূল (সা.) বলেন, সামনে যখন রমজান আসবে তখন তুমি ওমরা করবে। কেননা, রমজানে ওমরা করলে হজ্জের সমান ছওয়াব হয়। (সহিহ বোখারি-১৭৮২)।
হজের আগে ওমরা করা কী নিষেধ? আমাদের সমাজে একটি ভুল ধারণার প্রচলন আছে। তা হচ্ছে, হজ করার আগে ওমরা করা যায় না। এই ভুল ধারণা হয়তো যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে। তাই এই ধারণা দূর করার জন্য ইমাম বোখারি (রাহ.) সহিহ বোখারিতে একটি অধ্যায়ই রচনা করেছেন। তিনি সেখানে হাদিস দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, হজের আগে ওমরা করা যায়। হজরত ইকরেমা ইবনে খালেদ (রহ.) ইবনে ওমর (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হজের আগে ওমরা করতে কী কোনো সমস্যা আছে? ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসূল (সা.) হজের আগে ওমরা করেছিলেন। তাই এতে কোনো সমস্যা নেই। (সহিহ বোখারি-১৭৭৪)।
ওমরায় যত কষ্ট তত সওয়াব: বিদায় হজ্জের সময় হজরত আয়শা (রা.) হজের মধ্যবর্তী সময়ে ঋতুবর্তী হয়ে যান। তখন তিনি তওয়াফ ব্যতিত বাকি সকল কার্যক্রম চালিয়ে যান। ঋতু থেকে পবিত্র হওয়ার পর তিনি তওয়াফ করেন এবং রাসূল (সা.)- কে বলেন, আপনারা হজ ও ওমরা করেছেন আর আমি শুধু হজ করব? একথা শুনে হজরত আয়শার ভাই আব্দুর রহমান (রা.)-কে রাসূল (সা.) নির্দেশ দিলেন তানঈম নামক স্থানে তাকে নিয়ে যেতে এবং সেখান থেকে নতুনভাবে ওমরার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে। এবং একথাও বললেন, তুমি সওয়াব পাবে তোমার খরচ বা কষ্ট অনুযায়ী। (সহিহ বোখারি-১৭৮৭)। অর্থাৎ অন্যদের তুলনায় তোমার কষ্ট বেশি হয়েছে বিধায় তুমি সওয়াবও বেশি পাবে।
ওমরা আদায়ের সময়: ইমাম মালেক (রাহ.) এর মতে এক বছরে একাধিক ওমরা করা মাকরুহ। অন্যদের মতে বছরে কয়েকবার ওমরা করতে কোনো অসুবিধা নেই। দ্বিতীয় মতের দলিল হচ্ছে, হজরত আয়শা (রা.) থেকে একমাসে দুইবার ওমরা করা প্রমাণীত আছে। এক ওমরার পর দ্বিতীয়বার ওমরা করার দ্বারা উভয় ওমরার মাঝের গুনাহ মাফ হওয়ার কথা হাদিসেই বলা হয়েছে আর দুই ওমরার মাঝে কোনো সময়ের শর্তও যুক্ত করা হয়নি। হজরত আলী (রা.) মাসে একবার ওমরা আদায় করতেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বছরে কয়েকবার ওমরা আদায় করতেন।
ইসলামের পূর্বে আরবরা হজের মাসগুলোতে ওমরা আদায় করাকে অপছন্দ করত। রাসূল (সা.) হজের মাসে ওমরা আদায়ের অনুমতি দিয়েছেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য ওমরাকে হজের মধ্যে দাখেল করে দেয়া হয়েছে।
হানাফি মাজহাব মতে জিলহজ মাসের পাঁচদিন ওমরা আদায় করা মাকরূহে তাহরিমী। সেই পাঁচদিন হচ্ছে- জিলহজ মাসের নয়, দশ, এগার, বার ও তের তারিখ । তবে কেউ এই দিনগুলোতে ওমরা আদায় করলে আদায় হয়ে যাবে, কিন্তু গুনাহগার হবে। (কামুসুল ফিকহ, খন্ড-৪, পৃষ্ঠা-৪১৪)।
ওমরার ফরজ ও ওয়াজিব সমূহ: ওমরা শরিয়তের সহজ একটি আমল। ওমরার ফরজ আমল দুটি আর ওয়াজিবও দুটি। ফরজ দুটি হচ্ছে- (ক) ইহরাম বাঁধা (খ) তওয়াফ করা। ওয়াজিব দুটি হচ্ছে- (ক) সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে দৌঁড়ানো, যাকে আরবিতে বলা হয় ‘সাঈ’ করা। (খ) মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছোট করা। (আল ফিকহুল হানাফি ফি ছাওবিহিল জাদিদ, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৪৬৮)।
ইহরাম বাঁধার পদ্ধতি: ইহরাম বাঁধার পূর্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ থেকে ফারেগ হওয়া। যেমন- হাত পায়ের নখ কাটা, নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করা ইত্যাদি। ফকিহগণ এগুলোকে মোস্তাহাব বলেছেন। এরপর সম্ভব হলে গোসল করবে, অন্যথায় ওজু করে নিবে। এই সময়ের গোসল মূলত পরিষ্কার- পরিচ্ছন্নতার জন্য। এ কারণে, ঋতুবর্তী মহিলাদের জন্যও ইহরামের পূর্বে গোসল করে নেয়া মোস্তাহাব। গোসলের পর ইহরামের কাপড় পরিধান করবে এবং সম্ভব হলে সুগন্ধি ব্যবহার করবে। অতঃপর ইহরামের সুন্নাত হিসেবে দুই রাকাত নামাজ আদায় করবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে নামাজ যেন শরিয়তের নিষিদ্ধ বা মাকরুহ সময়ে না হয়। নামাজের পর তওবা, ইস্তেগফার পড়ে আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা চাইবে। এরপর দৃঢ়তার সঙ্গে হজ বা ওমরার নিয়ত করবে। নিয়ত মুখে বলা উত্তম। আরবিতে বলার দ্বারা বিশেষ কোনো ফায়দা নেই। বলবে, হে আল্লাহ! আমি হজ বা ওমরার নিয়ত করেছি। অতএব আপনি আমার জন্য এটাকে সহজ করে দিন এবং আমার এই আমলকে কবুল করে নিন। এরপর তালবিয়া পড়া শুরু করার দ্বারা সে হজ বা ওমরার ইহরাম বাঁধা সম্পন্ন করবে।
ওমরা করা ওয়াজিব নাকী সুন্নত? ওমরা একটি ফযিলতপূর্ণ কাজ। কিন্তু ওমরা করার হুকুম কী, ওয়াজিব নাকি সুন্নত? আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনে হজের সঙ্গে সঙ্গে ওমরা আদায়েরও নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন সূরা বাকারাতে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা আল্লাহ তায়ালার জন্য হজ ও ওমরা পরিপূর্ণ কর।’ (সূরা বাকারা-১৯৭)। শরিয়তের মূলনীতি হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার আমল বা নির্দেশবাচক শব্দ দ্বারা ওয়াজিব সাব্যস্ত হয়। তাই কোনো কোনো ফকিহের মত হচ্ছে, ওমরা করা ওয়াজিব। তবে তিরমিজি শরিফের এক বর্ণনায় এসেছে, হজরত জাবের (রা.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো ওমরা আদায় করা কী ওয়াজিব? তখন উত্তরে তিনি বলেন, না বরং ওমরা করা উত্তম। (সুনানে তিরমিজি-৯৩১)। ইমাম তিরমিজির মতে এই হাদিসটি সহিহ এবং হাসান, যা দলিলের জন্য উপযুক্ত। তাই কোনো কোনো ফকিহের মত হচ্ছে, ওমরা করা সুন্নত। হানাফি মাজহাবের মতও হচ্ছে ওমরা করা সুন্নত।
রাসূল (সা.) কতবার ওমরা করেছিলেন? ওমরার আলোচনায় প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে রাসূল (সা.) কতবার ওমরা করেছিলেন। এ জন্য হাদিস ও সীরাতের গ্রন্থসমূহে রাসূল (সা.) এর ওমরা নিয়ে পৃথকভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ইমাম বোখারি (রাহ.) এ ব্যাপারে সহিহ বোখারিতে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন। তিনি এই অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন ‘রাসূল (সা.) কতবার ওমরা করেছিলেন?’
হাদিস ও সীরাতের কিতাব থেকে জানা যায়, রাসূল (সা.) মোট চারবার ওমরা করেছিলেন। সহিহ বোখারিতে হজরত মুজাহিদ (রা.) এর সূত্রে এ মর্মে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হজরত উরওয়া (রহ.) ইবনে ওমর (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, রাসূল (সা.) কতবার ওমরা আদায় করেছিলেন? তিনি চারবারের কথা বললেন এবং এ কথাও বললেন, কোনো একটি ওমরা রাসূল (সা.) রজব মাসে আদায় করেছিলেন। চারবার হচ্ছে যথা-
প্রথম: হুদাইবিয়ার সন্ধির সময়। মদিনায় আসার পর ষষ্ঠ হিজরির ঘটনা। রাসূল (সা.) স্বপ্নে দেখেন সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে তিনি বাইতুল্লায় হজ আদায় করছেন। জাগ্রত হওয়ার পর তাই তিনি ওমরা আদায়ে সিদ্ধান্ত নিলেন। সাহাবায়ে কেরামের বিশাল এক জামাত নিয়ে ওমরা আদায়ের উদ্দেশ্যে হুদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে, মক্কার মুশরিক সম্প্রদায় দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। এবং এখানেই ঐতিহাসিক হুদাইবিয়া সন্ধি হয়। সন্ধির শর্ত মোতাবেক রাসূল (সা.) ওমরা সম্পন্ন না করেই ফিরে আসেন। তাই রাসূল (সা.) এর প্রথম ওমরা অসম্পন্ন ছিলো।
দ্বিতীয়: হুদাইবিয়া সন্ধির কারণে প্রথমবার ওমরা করতে না পারায় নবী করিম (সা.) সপ্তম হিজরিতে ওই ওমরার কাযা আদায় করেন। আল কোরআনে বর্ণিত ‘আর তোমরা আল্লাহ তায়ালার জন্য হজ ও ওমরা পরিপূর্ণ কর।’ এর মর্ম রাসূল (সা.) আমলের দ্বারা দেখিয়েছেন। অর্থাৎ ওমরা শুরু করার পর কোনো কারণে যদি তা সম্পন্ন করা সম্ভব না হয় তাহলে পরবর্তীতে তা পূর্ণ করতে হবে, যাকে শরয়ি পরিভাষায় ‘কাযা করা’ বলা হয়। অনেক ভাই মনে করেন নামাজ কাযা হয়ে গেলে তা আদায় করতে হয় না। কিন্তু রাসূল (সা.) আমাদের দেখালেন যে, আদায়যোগ্য কোনো কাজ কাযা হয়ে গেলে পরবর্তীতে তা আবার আদায় করতে হয়।
তৃতীয়: মক্কা বিজয়ের পর হুনাইনের যুদ্ধ সংগঠিত হয় । তাতে রাসূল (সা.) উপস্থিত ছিলেন। সেখান থেকে ফিরে আসার সময় ‘জির্আরানা’ নামক স্থান থেকে ইহরাম বেঁধে ওমরা আদায় করেন। এই ওমরা আদায় করেছিলেন অষ্টম হিজরিতে।
চতুর্থ: দশম হিজরিতে নবী করিম (সা.) বিদায় হজ করেন। ওই হজে নবী করিম (সা.) ‘কিরান হজ’ করেছিলেন। ‘কিরান হজ’ বলা হয় হজ ও ওমরা একসঙ্গে আদায় করাকে।
হজের ন্যায় ওমরাও মুসলমানদের বড় একটি ইবাদত। সারা বিশ্বের লক্ষ্য লক্ষ্য মুসলমান প্রতি বছর ওমরা আদায় করে। কিন্তু বর্তমানে হজ ও ওমরার মতো গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো আদায় করার ক্ষেত্রেও মানুষ যুলুমের শিকার হচ্ছে। বাইতুল্লাহ শরিফে গিয়ে ছবি তোলা, সেলফি ও ভিডিও লাইভ দেখানোর মতো গর্হিত কাজে আমরা লিপ্ত হয়ে যাই। হজ ও ওমরা আল্লাহর জন্য করা, লোক দেখানোর জন্য নয়। তাহলেই আমার হজ ও ওমরা আখেরাতে মুক্তির উসিলা হবে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়