পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও গেম কোনটি? প্রশ্নটির উত্তরে বেশিরভাগ মানুষের মনে একটি নামই আসবে, তা হল ‘পাবজি’ বা ’প্লেয়ার আননউন ব্যাটেল গ্রাউন্ড’। পাবজি’র কথা শুধু হার্ডকোর গেমারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে ভার্সিটি পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী পর্যন্ত প্রায় সবার আড্ডাতেই একবার হলেও পাবজির নাম আসে। পুরো বিশ্বজুড়ে পাবজি নতুন এক ক্রেজ তৈরি করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় প্রতিনিয়ত পাবজির কোনো না কোনো প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। আর এসকল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ইন্টেল, মাইক্রোসফট-এর মতো টেক জায়ান্টরা। কিন্তু পাবজি কী? কারা তৈরি করলো এই গেম? আর কিভাবেই বা এতো জনপ্রিয়তা পেল এটি?
পাবজি একটি ব্যাটেল রয়্যাল গেইম। গেইমিং দুনিয়ায় এরা একদমই নতুন। ব্যাটেল রয়াল কী এটা বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ৯০ এর দশকে। ৯০ এর দশকে জাপানে ‘ব্যাটেল রয়াল’ শিরোনামের একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিলো। সেই সিনেমায় ৪২জন ছাত্র-ছাত্রীকে একটি পরিত্যাক্ত দ্বীপে নির্বাসিত করা হয় এবং সেখানে একে অপরকে হত্যা করে যে টিকে থাকতে পারবে তাকে বিজয়ী ঘোষণা করে মুক্তি দেয়া হবে। পরবর্তীতে হলিউডে মুক্তি পেল ‘হাংগার গেইমস’ নামক একটি সিনেমা। এই সিনেমার গল্পও প্রায় একই ঘরানার ছিলো। তবে এই সিনেমা অনেক বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে। একই সাথে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন তুলে, তারা যদি একই রকম পরিস্থিতিতে পড়ে এবং টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে হয় তবে কী হবে। পাবজি এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। কারণ এই গেমে ১০০জন প্লেয়ারকে প্লেনে করে একটি পরিত্যাক্ত দ্বীপে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে একে অপরকে হত্যা করে টিকে থাকতে হয়। যে প্লেয়ার শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে সেই বিজয়ী।
গেমে রোমাঞ্চ আনার জন্য ম্যাপে যোগ করা হয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা, যোগ করা হয়েছে এয়ারস্ট্রাইক। পাবজির সবথেকে বড় সুবিধা হল এটি চাইলেই চারজন বা দুইজন বন্ধুর সাথে খেলা যায়, আবার একাও খেলা যায়। একই সাথে এই ভিডিওগেম বন্ধুদের বিরুদ্ধে খেলার সুবিধাও দিচ্ছে। গেমটির আরেকটি ফিচার হলো, গেম চলা অবস্থায় অন্যান্য প্লেয়ার-এর সাথে বা নিজের টিমমেটদের সাথে কথা বলার সুযোগ। কিন্তু কিভাবে তৈরি হয়েছিল এই গেম?
ব্রেন্ডন গ্রীন নামক একজন আইরিশ নাগরিককেই পাবজির জনক হিসেবে মান্য করা হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, ব্রেন্ডন গ্রীন কোনো গেম ডিজাইনার নয় বরং একজন ফটোগ্রাফার এবং ওয়েব ডেভেলপার। আইরিশ হলেও ব্রন্ডন তার ব্রাজিলিয়ান স্ত্রীকে নিয়ে ব্রাজিলেই বসবাস করতো। স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর ব্রেন্ডন নিজ দেশে ফিরে আসেন এবং নতুন কিছু করার তীব্র ইচ্ছা নিয়ে শুরু করেন নতুন জীবন। ’৯০-এর দশকে ’ব্যাটেল রয়াল’ দেখার পর থেকেই ব্রেন্ডন ব্যাটেল রয়াল গেম তৈরিতে ইচ্ছুক ছিলো। কিন্তু বড় কোনো গেম ডেভলপার কোম্পানি ব্যাটেল রয়াল গেম তৈরিতে ইচ্ছুক ছিলো না। তারা বরং নির্দষ্ট স্টোরিলাইনের উচ্চ গ্রাফিক্স ফার্স্ট পার্সন শ্যুটিং গেম তৈরি করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করত। কোন উপায় না পেয়ে ব্রান্ডন ‘আর্মারড এসাল্ট’ এবং ’ডিএমজি’ গেম-এর মড তৈরি করলেন। রাতারাতিই ব্যান্ডনের তৈরি মডগুলো গেমারদের মধ্যে সাড়া ফেলল। ফলে ব্রান্ডন বড় বড় গেম ডেভলপার কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে অফার পেতে শুরু করল। কিন্তু ব্রান্ডনের মন বসে নি।
অবশেষে ২০১৫সালের শেষভাগে ব্রান্ডন দক্ষিন কোরিয় গেম ডেভলপার কম্পানি ’ব্লুহোল’ থেকে একটি ব্যাটেল রয়্যাল গেম তৈরির অফার পায়। সাথে সাথেই ব্রান্ডন সিউলে চলে যায়। ব্লুহোল ব্রান্ডনকে তাদের নতুন ব্যাটেল রয়্যাল গেম-এর ক্রিয়েটিভ ডিজাইনার হিসেবে নিয়োগ দেয়। ব্লুহোলের লক্ষ্য ছিলো খুব সাধারণ ডিজাইনের একটি গেম তৈরি করা, যা খুব কম দামে প্লেয়ারদেরকে সরবারহ করা যাবে। একই সাথে ব্লুহোল এই গেইম তৈরির জন্য মাত্র ১বছর সময় ধার্য করেছিলো। ২০১৬ সালের প্রথমভাগে পাবজি তৈরির কাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের মার্চে এই গেম পুরোপুরি তৈরি হয়ে যায় এবং বিশ্ববাজারে আনা হয়। কিন্তু কিভাবে এতটা জনপ্রিয়তা পেল এই গেম?
অন্যান্য হাই গ্রাফিক্স গেম গুলোর তুলনায় পাবজিকে একটি সাধারণ গেম বললেই চলে! রিলিজ পাবার পর পাবজিতে মাত্র একটি ম্যাপ ছিলো। তাছাড়াও এই গেমে অনেক বাগ ছিল, গ্রাফিক্সও তেমন ভালো ছিলো না। কিন্তু রিলিজ-এর মাত্র ৩ দিনের মাথায়ই পাবজি প্রায় ১১ মিলিয়ন ডলার আয় করেন এবং ৪ মাসের মাথায় স্ট্রীমে প্রায় ১০ মিলিয়ন গেমার পাবজি খেলা শুরু করে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পাবজি অন্যতম পপুলার গেল ‘ডটা টু’ এবং ’সি এস গো’কে পিছনে ফেলে শীর্ষ উঠে যায়।
পাবজির এই সাফল্যের নেপথ্যে প্রধান কারণ হলো, এই গেম প্লেয়ারদের নিজের মতো করে খেলার স্বধীনতা দিয়েছিলো, যা অন্যান্য ওপেন ওয়ার্ল্ড গেমগুলো দিতে পারেনি। তাছাড়া এটিই ছিলো প্রথম ব্যাটেল রয়াল গেম। এ কারণে খুব তাড়াতাড়ি পাবজি সাফল্য লাভ করে।
পাবজির জনপ্রিয়তার অরেকটি কারণ ছিলো, এর স্বল্প মূল্য। গেমটির মূল্য মাত্র ২৫ ডলার, যা অন্যান্য গেমগুলোর তুলনায় অনেক কম। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের প্রথমভাগে পাবজি করপোরেশন পাবজিকে স্মার্টফোনে ফ্রী রিলিজ করে। যা পাবজিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। বর্তমানে প্রায় ৯২টি দেশে পাবজির মোবাইল ভার্শনেই প্রায় ১০০ মিলিয়ন প্লেয়ার রয়েছে! তাছাড়াও ২০১৭সালের শেষ ভাগে পাবজি এক্সবক্স এবং প্লে স্টেশনে প্রকাশ পায়। সব মিলিয়ে সারাবিশ্বে পাবজির ২০০ মিলিয়ন প্লেয়ার রয়েছে যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। কিন্তু অনেক চাইনিজ কোম্পানিই পাবজির ক্লোন তৈরি করার চেষ্টা করেছে। কিছু কিছু সফলও হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম ফোর্টনাইট। ব্রান্ডন গ্রীন পাবজির কপি ফোর্ট নাইট ও অন্যান্য গেমকে বরং স্বাগতই জানিয়েছে। কারণ পাবজি বিশ্বব্যাপি নতুন যে ক্রেজ শুরু করেছে তা খুব তাড়াতাড়ি ফুরোবর নয়!
খবর বিভাগঃ
তথ্য প্রযুক্তি
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়