নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর সিলেটের সীমান্তবর্তী লোভাছড়া এখন যেনো গর্তপুরে পরিণত হয়েছে। পাথরখেকোরা লোভাছড়াকে ছিন্নভিন্ন করেছে। ফেলোডার, এক্সকাভেটর, বোমামেশিনসহ নানা যন্ত্রদানবের তাণ্ডবে সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। ছোট-বড় অসংখ্য গভীর গর্ত এলাকার ভূ-প্রকৃতিকে বিপদজনক করে তুলেছে। ধুলোয় ধূসর এখন গোটা এলাকা। প্রশাসনের দায়সারা অভিযানে এ তান্ডবলীলা বন্ধ হচ্ছে না।
স্থানীয়রা জানান- প্রভাবশালী পাথরখেকো সিন্ডিকেট ও ইজারাদাররা বেআইনিভাবে গভীর গর্ত তৈরি করে দিনে রাতে পাথর উত্তোলন করছে। লোভাছড়া পাথর মহালসহ আশেপাশের এলাকায় ইজারার শর্ত না মেনে অবৈধভাবে ফেলোডার, এক্সকাভেটর, সেইভ মেশিনসহ নানা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে শত শত গভীর গর্ত তৈরি করে প্রতিনিয়ত পাথর উত্তোলন করছে। কোয়ারি এলাকায় রাতদিন যন্ত্রদানবের বিকট শব্দ এলাকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। এলাকার কয়েকটি গ্রামের বাড়িঘর এখন ধুলাবালিতে একাকার। এরপরও এব্যাপারে নেওয়া হচ্ছে না কঠোর কোন পদক্ষেপ।
সরেজমিনে দেখা যায়, লোভাছড়া এলাকা এখন অনেকটা ধংসস্তুপে পরিনত হয়েছে। সরকারি খাস খতিয়ানের জমি গিলে খাচ্ছে পাথরখেকোরা। ইজারাদারের লোকজন এবং কোয়ারির নিয়ন্ত্রণকারী মূলাগুল পাথর ব্যবসায়ী সমিতি, নয়া বাজার আদর্শ লোভাছড়া পাথর ব্যবসায়ী সমিতি ও চিন্তার বাজার পাথর ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ পেশীশক্তি ব্যবহার করে নির্বিচারে পাথর তুলছেন।
কোয়ারির ইজারা বহির্ভূত এলাকা থেকেও প্রতিদিন লক্ষাধিক ঘনফুট পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে করে সরকার লাখ লাখ টাকা রাজস্ব আয় থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। ইজারাদারের মনোনীত লোকজন সেখান থেকে প্রতি ফুট পাথরে ৪-৫ টাকা করে চাঁদা আদায় করছে।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ী ও স্থানীয় লোকজন জানান, পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলার উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রশাসন এবং বিভিন্ন মহলের নাম ভাঙ্গিয়ে কোয়ারির পাথরের প্রতিটি গর্ত থেকে ১-২ লাখ টাকা করে পাথর ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ তাদের মনোনীত ৩টি গ্রুপের মাধ্যমে আদায় করেছেন। আবার প্রশাসনকে ম্যানেজ করার নামেও পাথর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সবসময় টাকা আদায় করা হচ্ছে।
কোয়ারি এলাকায় গর্ত তৈরি করে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীরা নিজেদের স্বার্থে এই চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন। এর মাধ্যমে বিনা বাধায় তারা পরিবেশ ধ্বংস করছেন। কোয়ারির হাজার একর জমিতে বিপদজনক গর্ত তৈরি করে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন হচ্ছে। পাথরখেকো চক্রের নির্বিচার থাবায় সীমান্ত পিলারও হুমকির মুখে।
এছাড়া এলাকার ফসলি জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার, বসতভিটাও ধংসের মুখে। গত একযুগে মুলাগুল বাজারের অধিকাংশ জায়গা ও নয়াবাজার জামে মসজিদের জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। লোভা নদীর উভয়পাশে ১শ’ থেকে ১৫০ ফুট গভীর গর্ত তৈরি করে পাথর উত্তোলনের কারণে নদীর গতিপথও পরিবর্তন হচ্ছে, ভাঙ্গছে উভয়পাড়।
এভাবে পাথর উত্তোলন অব্যাহত থাকলে যেকোন সময় আবারও বড় ধরণের প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে বলে এলাকার লোকজন আশঙ্কা করছেন। গত চার মাসে কোয়ারিতে মাটিচাপায় ৭ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তারা জানান- বিশেষ করে রাতের অন্ধকারে জেনারেটরের সাহায্যে সাউদগ্রাম, ভাল্লুকমারা ও কান্দলা এলাকায় ইজারা সীমানার বাইরে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পাথর উত্তোলন চলছে। মেছার চর এলাকায় গভীর গর্ত করে পাথর উত্তোলনের কারণে বৈদ্যুতিক খুঁটি মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে।
সূত্র জানায়, সাউদগ্রাম এলাকার বিএনপি নেতা হাজী বিলাল আহমদ, মুলাগুল পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও বিএনপি নেতা গিয়াস উদ্দিন, উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা তমিজ উদ্দিন মেম্বার, হাজী কামাল উদ্দিন, নাজিম উদ্দিন, মুলাগুল পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন ও তার ছোট ভাই শাহাব উদ্দিনের কালিজুরি এলাকায়ও পাথরের গর্ত রয়েছে।
ভাল্লুকমারা চরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নয়াবাজার আদর্শ লোভাছড়া পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন, উপজেলা যুবদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক ও নয়াবাজার আদর্শ লোভাছড়া পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম, ইউনিয়ন বিএনপি নেতা ছয়ফুল আলম, যুবলীগ নেতা আব্দুল কাইয়ূম, শেবুল আহমদ, বাজেখেল এলাকায় সমসু উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর একাধিক পাথরের গর্ত রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, এদের রাজনৈতিক পরিচয় ভিন্ন হলেও পাথর লুটে সবাই এক।
সূত্র জানায়, কোয়ারির ইজারাদার মস্তাক আহমদ পলাশের নির্দেশনায় প্রতি গর্ত থেকে ১ লাখ টাকা করে চাঁদা উত্তোলনের জন্য তমিজ উদ্দিন মেম্বার, হাজী বিলাল, নাজিম উদ্দিন ও ফখরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা টাকা উত্তোলনের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা পাথর ব্যবসা করি, আমাদের নামে অনেকে অনেক কথা বলে, বাস্তবে তার প্রমাণ নেই।’
লোভাছড়ায় প্রকৃতিবিনাশি কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া সুলতানা বলেন, ‘লোভাছড়া পাথর কোয়ারি এলাকায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের সাথে জড়িত ৩০-৩৫ জনের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি তালিকা দুই সপ্তাহ আগে সিলেট পরিবেশ অধিদপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে। এছাড়াও কোয়ারি এলাকায় উপজেলা প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
খবর বিভাগঃ
প্রতিদিনের কানাইঘাট
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়