Thursday, August 17

পর্যটক ডাকছে কানাইঘাটের ‘কাঁঠালবাড়ি'














এহসানুল হক জসীম:
সিলেটের কানাইঘাটে আরেক পর্যটন কেন্দ্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘কাঁঠালবাড়ি জলা-পাহাড়’। হাওরের মাঝখানে কানাইঘাটের এক নিভৃত পল্লী ‘কাঁঠালবাড়ি’। স্থানীয় পর্যটকদের নজর কেড়েছে বিচ্ছিন্ন এ পল্লী। গেল কয়েক দিন থেকে স্থানীয় ভ্রমণপিপাসুদের ভ্রমণে মুখর হয়ে উঠছে নিরব এ ভূ-খন্ড আর গাছবাড়ী ও হরিপুরের মাঝখানের হাওর। প্রতিদিনই হাওরের মাঝে নৌকা দেখা যাচ্ছে। গন্তব্য ‘কাঁঠালবাড়ি’। সাম্প্রতিক সময়ে আকর্ষণ সৃষ্টিকারী এ নুতন পর্যটন কেন্দ্র ‘কাঁঠালবাড়ি জলাপাহাড়’ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি পেলে এটা হবে বাংলাদেশের একমাত্র জলাপাহাড়। হয়ে উঠবে সিলেটের আরেক ব্যস্ততম পর্যটন কেন্দ্র। স্থানীয়দের কাছে ইতোমধ্যে পর্যটন কেন্দ্র হয়েই গেছে। কানাইঘাট উপজেলার ৯নং রাজাগঞ্জ ইউনিয়নে বিচ্ছিন্ন এ গ্রামটি অবস্থান। হরিপুর গ্যাসফিল্ড থেকে হাওর পথে দুরত্ব মাত্র ৪ কিলোমিটার। রাজাগঞ্জ বাজার বা গাছবাড়ী বাজার থেকে হাওর পথে দুরত্ব ৫/৬ কিলোমিটার। স্থানটি কানাইঘাট উপজেলার ভ্রমণপিপাসুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাজাগঞ্জ সাহিত্য সাংস্কৃতিক ফোরামের ‘রাজকুঁড়ি’ ম্যাগাজিন
প্রকাশের পর থেকে। এ ফোরামের বর্ষপূতি উপলক্ষে জুলাই মাসের ২০ তারিখ ‘রাজকুড়ি’ প্রকাশিত হয়। সেই ম্যাগাজিনে ‘কাঁঠালবাড়ি’ এর পর্যটন সম্ভাবনা নিয়ে একটি লেখা সবার নজর কাড়ে। লেখাটি এই লেখকের। এই লেখায় কাঁঠালবাড়ির একটি পূর্ণ বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কাঁঠালবাড়ি নিয়ে এটাই প্রথম প্রকাশিত কোনো লেখা। যদিও আরো ২/৩ বছর আগে এ নিয়ে লিখি। তবে ‘রাজকুঁড়ি’ ম্যাগাজিনের প্রকাশিত আর্টিকেল এ সংক্রান্ত প্রথম প্রকাশিত কোন আনুষ্ঠানিক লেখা। আর্টিকেলটি লিখতে উৎসাহ যুগিয়েছেন এবং যথারীতি চাপ দিযেছেন রাজাগঞ্জ সাহিত্য সাংস্কৃতিক ফোরামের সভাপতি সুলাইমান আল মাহমুদ ও সেক্রেটারী শাহজাহান সাহেদ। লেখাটি ‘রাজকুঁড়ি’ ম্যাগাজিনে প্রকাশের পর ‍এ ফোরামের উদ্যোগে গত ৪ আগস্ট কাঁঠালবাড়ির উদ্দেশ্যে নৌকা ভ্রমণের আয়োজন করা হয়। কানাইঘাট উপজেলার বেশ
কিছু তরুণ এতে অংশগ্রহণ করেন। কাঁঠালবাড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য এবং সেখানকার পর্যটন সম্ভাবনা দেখে মুগ্ধ হন। লিখেন ফেসবুকে এবং আরো বিভিন্ন মাধ্যমে। এরপর থেকে বিগত এই মাত্র কয়েকদিনে অনেকেই গেছেন সেখানে এবং যাচ্ছেন প্রতিদিন। বেড়ানোর জন্য খুবই উপভোগ্য একটি স্থান। যারা সেথায় গেছে ফিরে এসে তারা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কে সেখানকার নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের বিবরণ দিচ্ছেন। স্থানীয় ভ্রমণপিপাসুদের মতে, অপরুপ সৌন্দর্যের আধার ‘কাঁঠালবাড়ি জলা-পাহাড়’ পর্যটকদের নজর কাড়বেই। হাওরের মাঝখানে অনেকগুলো টিলার উপর ও টিলার আশপাশে পানির মধ্যে গাছ-পালায় ভরপুর ‘কাঁঠালবাড়ি জলা-পাহাড়’। মরুর মাঝে-মধ্যে খেজুর গাছ দেখা যায়। হাওরের মাঝেও গাছপালা বেষ্টিত গ্রামের অস্তিত্ব নতুন কিছু নয়। কিন্তু হাওরের মাঝে টিলা, টিলার মাঝে গাছ, পানিতে গাছ, চারিদিকে অথই পানির মাঝে অনেকগুলো টিলার উপর জনবসতি- সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃশ্য। বাংলাদেশের ভিন্ন এক গ্রাম। নয়নকাড়া প্যানারোমিক দৃশ্য। বর্ষাকালে চারদিকেই পানি। হাওরের মাঝখানের এই গ্রামের বাড়িগুলো টিলার উপর। একেকটা টিলায় একেকটা বাড়ি। বর্ষা মৌসুমে সে মনোরম দৃশ্য উপভোগ্য-ই বটে। কারণ, এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যেতে হয় নৌকায়। টিলা ছাড়া সবই ডুবে যায়। হাওরের মাঝখানে আবার টিলা, টিলার নানান জাতের গাছ, ফল গাছের সমাহার, কাঁঠাল গাছের আধিক্য-এমন গ্রাম সহজে খোঁজে পাওয়া যাবেনা আর কোথাও। এমন একটি গ্রামে নৌকা ভ্রমণের মজা-ই হবে আলাদা। হাওরের মাঝখান দিয়ে চলতে চলতে কাঠালবাড়ি গ্রামে পৌছার অনুভূতি-ই হবে আলাদা। এমন একটি স্থানে বর্ষাকাল কতটা সুন্দর আর উপভোগ্য হতে পারে নিজে গিয়ে পরখ করে নিন। বর্ষা বলতে প্রায় ৭/৮ মাস। শুষ্ক মৌসুমের ৩/৪ মাস ছাড়া বাকি সময়টা। পাহাড় সাধারণত: উঁচুভূমিতে হয়। সমতলভূমিতেও পাহাড় বা টিলা দেখা যায়। কিন্তু নিম্নভূমি বা হাওরে টিলা বা পাহাড়- এটা নতুন কিছু। হাওরের মাঝখানে পানিতে ভাসমান টিলার
সমাহার কাঁঠালবাড়ি ছাড়া এখন পর্যন্ত আর কোথাও দেখা যায়নি জানামতে। কাঁঠালবাড়ি অনন্য এদিক থেকে। ‘কাঁঠালবাড়ি জলা-পাহাড়’ বা ‘Kanthalbari Swamp Hill (কাঁঠালবাড়ি সোয়াম্প হিল)’ নামকরণ এই কারণে। Swamp অর্থ নিম্নভূমি যেখানে পানি থাকে (An area of low-lying, uncultivated ground where water collects; a bog or marsh)। সহজ কথায় Swamp অর্থ জলা। কাঁঠালবাড়িতে হাওর বা নিম্নভূমিতে অনেকগুলো টিলার সমষ্টি- এ কারণে এটা জলা-পাহাড়। এটা হবে বাংলাদেশের একমাত্র জলা-পাহাড়। রাতারগুলের জলাবন যেমন বাংলাদেশের একমাত্র জলাবন। হরিপুরের অদূরে হলেও এ জায়গাটি লাইটে আসেনি দুই ‍কারণে- আশপাশের জনবসতি হতে চারদিক থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন আর এখানকার জনবসতি গড়ে ওঠার বয়সও কম। ৯ নং রাজাগঞ্জ ‌ইউনিয়নের লুন্তির পাহাড় ও কুচিয়া নামে ২টি মৌজা নিয়ে কাঁঠালবাড়ী। ২০০ জনসংখ্যার এ গ্রামে রয়েছে প্রায় ৩০টির মত টিলা। ১৫-১৬টি টিলায় বাস করে প্রায় ২৬টি পরিবার। বেশির ভাগ টিলায় রয়েছে একটি করে পরিবার। কাঁঠালবাড়ির আয়তন প্রায় চার কিলোমিটার। রাজাগঞ্জ ‍ইউনিয়নের বীরদল এবং তালবাড়ী গ্রামের কিছু বাসিন্দা সেখানে গিয়ে বসতি স্থাপন করে গ্রামটির উৎপত্তি ঘটায় আজ থেকে ৫০/৬০ বছর আগে। বীরদল, তালবাড়ির লোকজনের জমি-জমা কাঁঠালবাড়ি থাকায় তাদেরকে সেখানে যেতে হতো। হাওরের মাঝখানের টিলায় ফল-মুল সহ অনেক গাছ-গাছালি থাকায় দেখা গেছে বীরদল, তালবাড়ির অনেক যৌথ পরিবারের এক বা দুই সদস্যকে সেখানে বাড়ি-ঘর বানিযে পাঠিযে দেওয়া হতো এই জমি-জমা ও ফল-ফসল দেখাশুনা, আহরণ ও উপভোগ করার জন্য। খুব আগের বসতি না হওয়ায় এই গ্রাম বিষয়ে অজানা অনেকের। অন্যদিকে, গ্রামটি এতটাই বিচ্ছিন্ন যে, সেখানে মুল জনপদের মানুষজনের সাধাণত: যাতায়াত নেই। এই যাতায়াত না থাকায় সে গ্রামের সৌন্দর্য্য ব্যাপারে অনেকেরই জানা ছিলোনা। টিলার উপর নির্মিত বাড়িগুলোর মধ্যে আবহমান বাংলার প্রায় হারিয়ে যাওয়া গ্রামগুলোর একটা প্রতিচ্ছবি রয়েছে। বর্ষায় এক টিলা থেকে আরেক টিলার মাঝখানের পানিতে সারি সারি হাঁসের সাঁতারের দৃশ্য- সে যে এক ভিন্ন অনুভূতি। আবার পানিবেষ্টিত টিলাগুলোর মধ্যে মহিষ আর মহিষ। টিলার মধ্যে নানান জাতের গাছ। আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারাসহ নানা ফলের গাছ। কাঁঠাল গাছের আধিক্য বেশি বলে নামকরণ কাঁঠালবাড়ি। এক একটা টিলা যেন একেকটা রাজ্য। টিলা ছাড়াও স্বচ্ছ পানির মাঝে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, হিজল গাছ, শাপলা ফুল, কাঞ্চন ফুলের গাছ যেন রাতারগুল আর মায়াবনের প্রতিচ্ছবি। কাঞ্চন ফুল এখানকার বাইরে বাংলাদেশের অন্য কোথাও দেখা যায় না। এটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের একটা ফুল। টিলাগুলোর গঠনপ্রকৃতিও এমন যে, এর উপর দাঁড়িয়ে যখন পুরো হাওর উপভোগ করবেন, মনে হবে যেন বঙ্গোপসাগর দর্শন করছেন। আর নিজে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কক্সবাজার সৈকতে। সেখানকার গাছগুলো এমন যে, কোনো গাছের অর্ধেক, আবার কোনো গাছের আরো বেশি
ডুবে আছে পানিতে। স্বচ্ছ পানির নিচে ডুবে থাকা গাছগুলোর ভিন্ন রূপ বড়ই উপভোগ্য। ঘন গাছ-পালার কারণে অন্ধকার অন্ধকার পরিবেশ পুরো কাঁঠালবাড়ি জুড়ে। মাঝে-মাঝে গাছের ডালপালা যেন আটকে দিচ্ছে পথ। হাত সরিয়ে পথ চলতে হবে। পানির নিচের জগতও অপূর্ব। নানা প্রজাতির মাছের আধার। কাঁঠালাবড়ি যেন একটা স্বয়ংসম্পুর্ণ রাজ্য। কারণ, গাছ-গাছালি আছে, ফল-ফলাদি আছে, শাক-সবজি আছে, হাওরে জমিতে ধান আছে, মাছ আছে। জীবন ধারণের সবই যেন এই এক জায়গায়। কীভাবে যাবেন: সিলেট শহর থেকে সিলেট-তামাবিল রোডের হরিপুর থেকে নৌকায় পূর্ব দিকে প্রায় ৪ কিলোমিটার পাড়ি দিলেই কাঁঠালবাড়ি। অন্যদিকে, সিলেট-কানাইঘাট গাজী বোরহান উদ্দিন রোডে গেলে রাজাগঞ্জ বাজার, তালবাড়ি, ঝিংগাবাড়ি বা গাছবাড়ির কোনো একটা জায়গা থেকে পশ্চিম দিকে যে হাওর দেখা যায়, সে হাওরের মাঝখানে কাঁঠালবাড়ি হাওর দ্বীপ। বোরহানউদ্দিন রোড থেকে ৫/৬ কিলোমিটার দুরে। যে রাস্তায়ই যান, সিলেট শহর থেকে দুরত্ব ২০/২৫ কিলোমিটারের বেশি। নিজস্ব উদ্যোগে নৌকার ব্যবস্থা করতে হবে। অবশ্য পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনায় চলে আসলে তখন হরিপুর, নারাইনপুর, গাছবাড়ি, তালবাড়ি, রাজাগঞ্জ থেকে নিয়মিত নৌকা চলাচলের ব্যবস্থা হযে যাবে। 
এহসানুল হক জসীম,সাংবাদিক ও পিএইচডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 
মোবাইল: 01713810606 
ইমেইল: ehsan.jasim@yahoo.com

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়