Thursday, July 27

রাজধানীতে জলাবদ্ধতার জন্য প্রশ্নবিদ্ধ ওয়াসা

রাজধানীতে জলাবদ্ধতার জন্য প্রশ্নবিদ্ধ ওয়াসা
কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ওয়াসা বলছে, ঘণ্টায় ১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলে সেই পানি নিষ্কাশনের মতো ড্রেনেজ ব্যবস্থা রয়েছে। তাহলে স্বাভাবিক বৃষ্টিতেই কেন রাজধানী পানিতে ভাসে- এ প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

২৮ বছর আগে রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব পেয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। এই দীর্ঘ সময়ে এ বিষয়ে সংস্থাটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীতে দেখা যাচ্ছে জলাবদ্ধতা।

সমস্যা সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা কার ব্যর্থতার কারণে হলো। এটা বলার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। যেসব খাল-জলাশয় ছিল, সেটা ভরাট করা হয়েছে। ওয়াসার দেখার দায়িত্ব ছিল; তারা দেখেনি। তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। তাদের উদাসীনতা ও ব্যর্থতায় খালগুলো দখল ও ভরাট হয়েছে। তারা কেউ কেউ খাল ভরাট করে উন্নয়নের কথা বলে। কিন্তু খাল ভরাট করে উন্নয়নের পর সেটা দেশের অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখল, আর আজ (গতকাল) সারাদিন যে ২ কোটি মানুষ বের হতে পারল না, সেই ক্ষতির মূল্য কত?

জানা গেছে, জলাবদ্ধতা নিরসন করতে হলে রাজধানীতে যে সংখ্যক খাল-জলাশয় থাকা প্রয়োজন, তা হারিয়ে গেছে। এক সময় ৪৩টি খাল ছিল। সেগুলোর মধ্যে ২০টি বিলুপ্ত। অবশিষ্টও কোনো সময় খনন করা হয় না। যে দুয়েকটির পাড় অল্প-স্বল্প বাঁধাই করা হয়েছে, সেগুলোও ময়লা-আবর্জনায় ডুবে থাকে। ফলে পানি প্রবাহের অবস্থা নেই। ওয়াসার উদাসীনতায় খালগুলো দখল হয়েছে; ভরাট হয়েছে। তার ওপর যেসব ড্রেন দিয়ে পানি জলাশয় বা খালে গিয়ে পড়বে, সেই ড্রেনেজ ব্যবস্থারও আধুনিকায়ন করা হয়নি। ফলে বৃষ্টির পানির আশ্রয়স্থল এখন রাজপথ।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসার উপদেষ্টা এবং ওয়াসার সাবেক উপব্যবস্থানা পরিচালক একেএম শহিদউদ্দিন বলেন, তাদের হিসাবে যে ব্যবস্থা আছে তাতে রাজধানীতে জলাবদ্ধতা হওয়ার কথা নয়। তবে এ সময়ে নদীর পানির লেভেল উঁচু হয়ে যায়। আবার অল্প সময়ের মধ্যে বেশি বৃষ্টি হয়। কিছু মানুষের অসচেতনতার কারণে ড্রেন বন্ধ হয়। বালু-ইট-সুরকি, ময়লা-আবর্জনা সবাই ড্রেনের মধ্যে ফেলে। তখন আর পানি নিষ্কাশন হতে পারে না। কিন্তু ঘণ্টায় ১৫ থেকে ২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলে সেটা নিষ্কাশনের ক্ষমতা ওয়াসার ড্রেনেজ লাইনের রয়েছে। তারপরও কেন এমনটা হলো- সেটা নিয়ে তারা গবেষণা করছেন।

রাজধানীর বৃষ্টির পানি উন্মুক্ত ড্রেন (সারফেস) দিয়ে মাটির নিচের পাইপ ড্রেন হয়ে খাল দিয়ে নদীতে চলে যাওয়ার কথা। এর মধ্যে উন্মুক্ত ড্রেনের অর্ধেকাংশের দেখভাল করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। বাকিটা ওয়াসা। এ ছাড়া অন্যান্য পাইপ ড্রেন ও স্যুয়ারেজ ড্রেন দেখার দায়িত্ব ওয়াসার। কিন্তু ওয়াসা বরাবরই অভিযোগ করে- সিটি করপোরেশনের সারফেস ড্রেনগুলো ময়লা-আবর্জনায় বন্ধ থাকে। যে কারণে পানি পাইপ ড্রেনে যেতে পারে না। একইভাবে উল্টো অভিযোগ করে সিটি করপোরেশন। তারা বলে, ওয়াসার পাইপ ড্রেনগুলো কখনও পরিষ্কার করা হয় না। এ জন্য পানি নামতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টের সাবেক সভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, জলাবদ্ধতা নিয়ে সিটি করপোরেশন ও ওয়াসা ব্লেম গেম (পারস্পরিক দোষারোপ) খেলছে। ওয়াসাকেও পুরো দায় দেওয়া যায় না। আর সিটি করপোরেশনকেও দেওয়া যায় না। এখানে যতদিন পর্যন্ত পুরো ড্রেনের দায়িত্ব মেয়রদের কাঁধে না যাবে ততদিন পর্যন্ত এ সমস্যা থাকবেই। এর সঙ্গে সাতটা মন্ত্রণালয় আছে। এখানে সমন্বয়হীনতারও ব্যাপার আছে।

গত ১৬ জুলাই এ প্রসঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সমন্বয় সভায় ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান ড্রেনেজ তদারকির দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের হাতে ছেড়ে দিতে চাইলে মেয়র আনিসুল হক তা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে পঙ্গু সন্তানের সঙ্গে তুলনা করেন। পঙ্গু সন্তানকে সুস্থ করে দিলে নিতে রাজি আছেন বলে জানান।

এক পর্যায়ে এলজিআরডিমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন মেয়রদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে ড্রেনেজের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। বর্তমানে চলছে চিঠি চালাচালি।

এ প্রসঙ্গে মেয়র আনিসুল হক বলেন, রাজধানীর খাল রক্ষা ও জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের নয়। তারপরও তিনি মেয়র হওয়ার পরপরই উত্তর এলাকার খালগুলোর অবস্থা কী সে সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে ওয়াসাকে দিয়েছিলেন। ওয়াসা খালগুলো উদ্ধার ও দখলমুক্ত করতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, জলাবদ্ধতা হলে ওয়াসার লোকদের মাঠে পাওয়া যায় না। তাদের এ ব্যাপারে আন্তরিকতা কম। পরিকল্পনা করে রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব।

রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রধান সংস্থা ঢাকা ওয়াসা দীর্ঘদিন যাবৎ পঙ্গু। গত চার বছরে সংস্থাটি জলাবদ্ধতা নিরসনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য প্রতি মাসে ব্যয় হচ্ছে কোটি টাকারও বেশি।

ড্রেনেজ সার্কেলের প্রকল্প পরিচালক ক্য সা চিং জানান, ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে তাদের কোনো কাজ নেই। আগের প্রকল্পগুলো ২০১৪ সালে শেষ হওয়ার পর তিনটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। সেগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি।

জানা যায়, ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথের ব্যর্থতার কারণে ১৯৮৯ সালে ঢাকা ওয়াসার ওপর ন্যস্ত করা হয় ড্রেনেজ বিভাগ। ১৯৯১ সালে ঢাকা ওয়াসা 'ড্রেনেজ সার্কেল' নামে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য একটি পৃথক শাখা গঠন করে। সেগুনবাগিচায় ড্রেনেজ সার্কেলের বিশাল কার্যালয়। তারা ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে 'ঢাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প ১ ও ২'-এর কাজ ২০১৩ সালে শেষ করে। এর পর থেকে ওই শাখার কয়েকশ' জনবলের কাজ নেই। তারা বেলা করে অফিসে যান। দুপুর হতেই বাসার উদ্দেশে রওনা হন। অথচ এখানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রয়েছেন দু'জন। পাঁচজন নির্বাহী প্রকৌশলী ও ২০ জন সহকারী প্রকৌশলীসহ দুই শতাধিক জনবল বিদ্যমান।

জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে তিনটি প্রকল্প স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় ওয়াসা। সেগুলো পরিকল্পনা কমিশনে দু'বছর পড়ে আছে। এর মধ্যে আছে ৫০০ কোটি টাকায় রাজধানীর পাঁচটি খাল উদ্ধার প্রকল্প। মূলত চারটি খাল: হাজারীবাগ, মুগদা-বাসাবোর মান্ডা, মিরপুরের বাইশটেকি ও সাংবাদিক কলোনি খাল। খালগুলো উদ্ধার করে পাড় বাঁধাই করলে বৃষ্টির পানি নদীতে চলে যাবে। বেগুনবাড়ি খালটি হাতিরঝিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় প্রকল্প থেকে বেগুনবাড়ি খালটি বাদ দেওয়া হয়। নাম পাঁচ খাল উদ্ধার প্রকল্পই থেকে যায়।

আরেকটি ছিল ২৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে 'ঢাকা শহরের বিদ্যমান জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প'। এ প্রকল্পের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের কথা বলা হয়। তৃতীয়টি ছিল ২৪ কোটি টাকার আগারগাঁও এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প। ওই প্রকল্পও গত দুই বছর ধরে পরিকল্পনা কমিশনে পড়ে আছে। সূত্র: সমকাল।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়