Wednesday, May 10

'সম্ভ্রম ভিক্ষা চেয়েছিলাম, কিন্তু রেহাই পাইনি'

'সম্ভ্রম ভিক্ষা চেয়েছিলাম, কিন্তু রেহাই পাইনি'

কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: 'অনেক চিৎকার করেছি। ওদের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছি। সাফাত ও নাঈমের হাত-পা ধরে ক্ষমা চেয়েছি। নিজেদের সম্ভ্রম ভিক্ষা চেয়েছি। কিন্তু রেহাই পাইনি। বরং তারা একটু পর পর ইয়াবা খেয়ে ধর্ষণ করেছে'

বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের শিকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এভাবেই কয়েকটি গণমাধ্যমকে ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দেন। ওই ছাত্রী ও তার এক বান্ধবী গত ২৮ মার্চ ধর্ষণের শিকার হন। এরপর ৬ মে তারা থানায় ধর্ষণের মামলা করেন।

মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, সাফাত আহমেদ (২৬) ও তার বন্ধু নাঈম আশরাফ (৩০) তাদের জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন।

সাক্ষাৎকারে ওই ছাত্রী বিস্তারিত তুলে ধরেছেন- কিভাবে ওই দুজনের সঙ্গে তাদের পরিচয়, কেনই বা তারা ওই হোটেলে গিয়েছিল জন্মদিনের পার্টিতে, ঘটনার পর এক মাস পর কেনো তারা পুলিশের কাছে গেলেন।

ঘটনার দিন যা হয়েছিল:
আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো রাজধানীর বনানীতে রেইনট্রি হোটেলে। ওই ছাত্রী দাবি করেন, আমরা প্রথমে যেতে চাইনি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। কিন্তু তার পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দেই।

'সাফাত বারবার ফোন করে বলেছিল আমরা দুই বান্ধবী তার জন্মদিনে না গেলে তিনি কেক কাটবেন না।'তাছাড়া সাদমান তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ায় তার অনুরোধও সে ফেলতে পারেনি।

ওই তরুণী বলেন, 'আমাদের বলা হয়েছে অনুষ্ঠানে অনেকে থাকবে। কিন্তু হোটেলে গিয়ে দেখি কয়েকজন ছাড়া কেউ নেই।'

আমরা তিন বান্ধবী ও এক চিকিৎসক বন্ধু সেখানে গিয়েছিলাম। ওখানে সাফাত, নাঈম আশরাফ, সাদমান সাকিফ এবং তাদের দুই বান্ধবীকে দেখতে পাই।

মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, পরিবেশ ভালো না লাগায় তারা তিন বান্ধবী ও তাদের চিকিৎসক বন্ধু চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে সাফাত-নাঈমরা তাদের গাড়ির চাবি, মোবাইল ফোন ও ঘড়ি কেড়ে নেয়। এরপর শুধু তাদের দুজনকে (ধর্ষিতা দুই ছাত্রী) নিচে একটি কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করে।

চিকিৎসক বন্ধুকেও হোটেলের আরেকটি রুমে আটকে রাখা হয়েছিল। তার সঙ্গে আমাদের আরেক বান্ধবীও ছিলো। আমাদের ধর্ষণের আগে ও পরে ওই বন্ধুকে ওরা প্রচণ্ড মারধর করে।

তরুণী জানান, ওই হোটেলে যাবার পরই সাফাত ও নাঈম বলে তারা তিন দিন ধরে একটানা ইয়াবা খাচ্ছে।

ধর্ষিত ওই তরুণী বলেন, 'আমরা অনেক চিৎকার করেছি। ওদের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছি। সাফাত ও নাঈমের হাত-পা ধরে ক্ষমা চেয়েছিলাম। নিজেদের সম্ভ্রম ভিক্ষা চেয়েছিলাম। কিন্তু রেহাই পাইনি।'

'ধর্ষণের সময়ও তারা দুজন পাশের বাথরুমে গিয়ে একটু পর পরই ইয়াবা খেয়ে আসছিল। এসেই আমাদের দুজনকে মারধর করছিল, কখনও গালি দিচ্ছিল।'

ধর্ষণের ঘটনা ফাঁস না করতেও হুমকি দিয়ে রাখেন তারা। তরুণীটি বলেন, ধর্ষণের ঘটনা ফাঁস করলে সাফাতের দেহরক্ষীর অস্ত্র দেখিয়ে তাদের মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। আমরা ওদের বলেছিলাম, ' আমাদের মেরে ফেল।'

'সাফাত বলছিল, তারা সোনার ব্যবসা করে। অনেক প্রভাবশালী। খুন করে ফেললেও তার কোনো সমস্যা হবে না।'

এভাবে সারারাত আমাদের উপর চলে বর্বর অত্যাচার। গাড়িচালক বিল্লালকে দিয়ে এসবের ভিডিও করা হয়।পরদিন সকালে হোটেলে একটি গাড়ি আসতে বলে। ওই গাড়িতে উঠে সাফাত ও নাঈম গুলশানের বাড়ির সামনে নেমে যায়।

এরপর দুই তরুণী তাদের চিকিৎসক বন্ধুকে টেলিফোন করে ডেকে এনে গুলশানের আরেকটি হোটেলে বসেন।তরুণীটি বলেন, 'আমার বান্ধবীটা যন্ত্রণায় হাঁটতে পারছিল না। আমরা দুজনই কাঁদছিলাম।'

মামলা দেরি যে কারণে:
ঘটনার একমাস পরে থানায় মামলা দায়ের করেন ধর্ষণের শিকার হওয়া তরুণী। এতো দেরির কারণ হিসেবে জানান, লোক লজ্জার ভয়ে আমরা বিষয়টি চেপে যেতে চেয়েছিলোম। কিন্তু তারা ধর্ষণের ভিডিওর ছবি ফেইসবুকে ছড়িয়ে দেবার হুমকি দিয়ে আমাদের সারাজীবন নিজেদের রক্ষিতা করে রাখতে চেয়েছিল। এটা মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না।

ভিডিও ফেইসবুকে ছড়িয়ে দেয়ার ক্রমাগত হুমকির মুখেই তিনি মামলার সিদ্ধান্ত নেন বলে জানান।

মামলার আগেও তারা ঘটনাটি মিটমাট করতে চেয়েছিলেন। এজন্য ঘটনার পর দুই ‘বড় ভাই’র মধ্যস্ততায় পিকাসো হোটেলে সাফাতদের সঙ্গে একটি বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠকে সাফাত, নাঈম ও সাদমান সাকিফ ছিলেন বলে জানান এই তরুণী।

আসামিদের সঙ্গে যেভাবে পরিচয়:
রেগমান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হোসেন জনির ছেলে সাদমান সাকিফের সঙ্গে ওই দুই তরুণীর পরিচয় দুই বছর আগে থেকে।

ওই তরুণী বলেন, 'তাকে বন্ধু হিসেবে অনেক বিশ্বাস করতাম। নিজের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা ভাগাভাগি করে নিতাম। ওইদিন জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও ওর জন্যই গিয়েছিলাম। অথচ আমাদের দুই বান্ধবীকে ওদের ধর্ষণ করার পূর্ব পরিকল্পনা ছিল জানলেও সাদমান আমাদের বুঝতেই দেয়নি।'

এই সাদমান সূত্রেই গত ৭ মার্চ গুলশানের একটি হোটেলে সাফাতের সঙ্গে তাদের পরিচয় বলে জানান ওই তরুণী।

'হোটেলে এক অনুষ্ঠানে সাদমান তার বড় ভাই বলে সাফাতকে পরিচয় করিয়ে দেয়। ওই অনুষ্ঠানে সাফাতের স্ত্রী (পরে ডিভোর্স হয়েছে) ফারিয়া মাহবুব পিয়াসাও ছিলেন।'

সেদিনই সাফাত তার ফোন নম্বর দুই তরুণীর মোবাইলে সেইভ করে দেয়ার পাশাপাশি ফেইসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান।

অভিযুক্তদের পরিচয়:
এঘটনায় গত ১ মে রাজধানীর বনানী থানায় মামলা দায়ের করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই দুই ছাত্রী।

মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা হল- সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, সাদমান সাকিফ, তাদের গাড়ি চালক বিল্লাল ও সাফাতের দেহরক্ষী (নাম অজ্ঞাত)।

মামলার এক নম্বর আসামি সাফাত আহমেদের বাবার নাম দিলদার আহমেদ সেলিম। তিনি দেশের শীর্ষ স্থানীয় স্বর্ণালঙ্কার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আপন জুয়েলার্সের মালিক।

দুই নম্বর আসামি নাঈম আশরাফ একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যুক্ত। তিনি রাজধানীর মিরপুর এলাকায় থাকেন বলে জানা গেছে।

মামলার তিন নম্বর আসামি সাদমান সাকিফের বাবার নাম মোহাম্মদ হোসেন ওরফে জনি। তিনি রাজধানীর তেজগাঁও লিংক রোডে অবস্থিত রেহনাম রেগনাম সেন্টারের মালিক। তার মাধ্যমেই ধর্ষিতাদের সঙ্গে মূল অভিযুক্তদের পরিচয় হয়।

মামলার অপর আসামি সাদমানের গাড়িচালক বিল্লাল। সে ঘটনার দিন ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে।

অপর আসামি তাদের দেহরক্ষী। তার নাম জানা যায়নি। তার সঙ্গে থাকা অস্ত্র দিয়ে দুই তরুণীকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়।

পুলিশের টালবাহানা:
এঘটনায় শুরু থেকেই অভিযুক্তদের পক্ষ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে।

ধর্ষণের শিকার হওয়া তরুণীটি দুই দিন থানায় ঘুরেছেন মামলা দায়েরের জন্য। কিন্তু পুলিশের অসহযোগিতার কারণে দুইদিন পরে মামলা নিয়েছে বনানী থানা পুলিশ।

মামলা দায়েরের পর ওই তরুণীকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে থানায় আটকে রাখা হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এরপরে পাঁচ দিন হয়ে গেলেও কোনো আসামিকে ধরতে পারেনি পুলিশ।

গতকাল মঙ্গলবার অভিযুক্তদের গুলশানের বাসায় অভিযানের নামে নাটক করা হয়। তারা বাসা থেকে পালিয়ে গেলে পুলিশ তাদের ধরতে যায়।

জানা গেছে, আসামিরা সিলেটে গ্রামের বাড়িতে পালিয়ে রয়েছে। এদিকে বনানী থানার ওসি ৫দিন টালবাহানা করে ছুটিতে গেছেন। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে ৫দিনের ছুটি নিয়েছেন ওসি ফরমান আলী।

অভিযুক্তদের মন্তব্য:
আসামিরা 'পালিয়ে' থাকায় তাদের কোনো বক্তব্য সংবাদকর্মীরা পাচ্ছে না।

তবে প্রধান আসামি সাফাতের বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের দাবি, তার ছেলের আগের স্ত্রী ষড়যন্ত্র করে তার ছেলেকে ফাঁসিয়েছে।আর ঘটনার দিন যদি কোনো যৌন সংসর্গের ঘটনা ঘটেও তা উভয় পক্ষের সম্মতিতে ঘটেছে।

তবে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন ধর্ষণের অভিযোগকারী তরুণী। এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সাফাতের সাবেক স্ত্রী পিয়াসও। তিনি জানান, ধর্ষণের শিকার দুই তরুণী তার পূর্ব পরিচিত হওয়ায় তাদের সঙ্গে মামলা দায়েরের সময় থানায় গিয়েছিল।

সূত্র:যুগান্তর

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়