মাওলানা ইসমাঈল ইসলাম:
শব শব্দটি ফারসি, যার অর্থÑ রাত। বরাত শব্দটি আরবি, যার অর্থÑ মুক্তি। শবেবরাত অর্থÑ মুক্তির রাত। হাদিসের ভাষ্য মোতাবেক এ রাতে আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে অগণিত ঈমানদারকে ক্ষমা করে জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তির ফয়সালা দেয়া হয়; তাই এ রাতকে শবেবরাত বলা হয়।
আমাদের সমাজে শবেবরাত বলতে যে রাতটিকে বোঝানো হয় তার ফজিলত নির্ভরযোগ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। একে হাদিস শরিফে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ তথা শাবানের পঞ্চদশ রাত বলা হয়েছে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি, চারটি রাত এমন রয়েছে, যেগুলোতে আল্লাহপাক সবার নেকির দরজা খুলে দেন। তন্মধ্যে একটি হলো, শাবানের ১৫ তারিখের রাত।’ (গুনিয়াতুত তালেবিন : ৩৬২)।
আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহপাক অর্ধশাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি (বিশেষভাবে) দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (ইবনে মাজাহ : ১/৪৪৫)। সুতরাং কেউ যদি সারা রাত নফল নামাজ পড়ে; কিন্তু তার অন্তরকে শিরক ও বিদ্বেষ পোষণ করা থেকে মুক্ত না করে তাহলে সে ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত হবে না।
আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন শাবানের ১৫ তারিখের রাত আসে তখন তোমরা রাতে ইবাদত করো এবং দিনে রোজা রাখ। কেননা আল্লাহপাক এ রাতে সূর্যাস্তের পরই বান্দার প্রতি বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেন এবং সাধারণ ঘোষণা হয় যে, কে আছ ক্ষমাপ্রার্থী! আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কে আছ রিজিকপ্রার্থী! আমি তাকে রিজিক দেব। কে আছ বিপদগ্রস্ত! আমি তাকে বিপদ থেকে মুক্তি দেব। এভাবে পূর্ণ রাত ঘোষণা হতে থাকে এমনকি সকাল হয়ে যায়।’ (ইবনে মাজাহ : ১/২৫৩)। এ ধরনের ঘোষণা যদিও প্রতি রাতেই হয়ে থাকে, তবে তা রাতের এক-তৃতীয়াংশের পর। আর এ রাতে সূর্যাস্তের পরই শুরু হয়ে যায়।
এ রাতের ফজিলত সম্পর্কে আরও কিছু বর্ণনা বিদ্যমান রয়েছে। তাই এ রাতে একাকী ইবাদতের গুরুত্ব প্রমাণিত হয়। আল্লামা শারম্বুলালি লিখেছেন, ‘এ রাতে ইবাদতের উদ্দেশ্য হলো, রাতের বড় একটি অংশ নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার এবং দরুদ শরিফ ইত্যাদির মধ্যে অতিবাহিত করা। তবে অধিকাংশ ফকিহের ঐকমত্যে, এ রাতে মসজিদের মধ্যে গুরুত্বের সঙ্গে সমষ্টিগতভাবে একত্রিত হয়ে ইবাদত করা মাকরুহ। হিজাজ এবং মদিনার ফকিহরা তো বেদাতই বলে থাকেন।’ (মারাকিল ফালাহ : ২১৯)। এজন্য ঘরে নফল ইবাদত করা অতি উত্তম। (তিরমিজি : ১/১০২, ফাতাওয়া আলমগিরি : ১/৭৭)।
শবেবরাতের পরদিন রোজা রাখার ব্যাপারে হাদিসের সূত্র দুর্বল হলেও একাধিক বর্ণনা পাওয়া যায়। সব বর্ণনা সম্মিলিতভাবে আমলযোগ্য হয়ে যায়। কাজেই ওই দিন রোজা রাখলে আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে ১৩, ১৪ ও ১৫ শাবান তিন দিনই রোজা রাখলে আইয়ামে বিজের রোজা হিসেবে আর কোনো প্রশ্ন থাকে না।
যদি কোনো বাদশাহ নিজের সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়, আজ তোমরা প্যারেড (কুচকাওয়াজ) কর। নিজেদের যোগ্যতা প্রদর্শন কর। তোমাদের অনেক পুরস্কার দেয়া হবে। সেনাবাহিনী শুনল এবং প্রস্তুত হয়ে গেল। প্যারেড করার জন্য নয়; বরং আতশবাজি করার জন্য। তাহলে বাদশাহ তাদের এ আচরণে রাগান্বিত হবেন না? পুরস্কারের পরিবর্তে তাদের তিরস্কার করা হবে না? অবশ্যই করা হবে। তেমনিভাবে এ রাতে যারা আতশবাজি করবে তাদের ওপরও আল্লহ রাগান্বিত হবেন। তাদের ওপর আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো আল্লাহর লানত অবতীর্ণ হবে। এদিন সবচেয়ে গর্হিত কাজ আতশবাজি। আতশবাজি করার কতিপয় ক্ষতি : ১. সম্পদের অপচয়। ২. অন্যকে কষ্ট দেয়া। ৩. বরকতময় রাতের উপহাস করা। ৪. নিজেকে বা প্রতিবেশীকে ধ্বংসের সম্মুখীন করা। কেননা অনেক এমন ঘটনা ঘটেছে যে, আতশবাজিকারীর হাত উড়ে গেছে। শবেবরাতে হালুয়া-রুটি পাকানোর শরিয়তে কোনো প্রমাণ নেই। এজন্য তা নাজায়েজ। যদি শুধু রসম হিসেবে হয়, সওয়াবের আকিদাহ না থাকে, তবুও তা থেকে বিরত থাকতে হবে। এ হিসেবে হালুয়া-রুটি গ্রহণ করা থেকেও বিরত থাকতে হবে। (আহসানুল ফাতাওয়া : ১/৩৮৫)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া আম্বরশাহ আল ইসলামিয়া
কারওয়ান বাজার, ঢাকা
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়