Friday, May 12

মহিমান্বিত রাত শবে বরাত

মহিমান্বিত রাত শবে বরাত

 শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী:
হিজরী চান্দ্র বর্ষের অষ্টম মাস হলো ‘শাবান’। এই মাসটি বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলতপূর্ণ। হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এই মাসেই কিবলা পরিবর্তন হয়; অর্থাৎ পূর্ব কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাস (ফিলস্তিনস্থ মসজিদুল আকসা) এর পরিবর্তে কাবা শরীফ কিবলা হিসেবে ঘোষিত ও নির্ধারিত হয় এই মাসে।
প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি দুরূদ পাঠের নির্দেশনা সম্বলিত অসাধারণ আয়াতটি এই মাসেই অবতীর্ণ হয়। যাতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতাগণ তাঁর জন্য রহমত কামনা করেন; হে বিশ্বাসী মুমিনগণ! তোমরাও তাঁর প্রতি দুরূদ পাঠ ও শুভ কামনা করো এবং শান্তি কামনা করে সালাম পেশ করো যথাযথভাবে।’ (সূরা আহযাব, আয়াত : ৫৬)। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই মাসে সবচেয়ে বেশি নফল ইবাদাত, নফল রোজা পালন ও নফল নামাজ আদায় করতেন।
এই শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত পনের তারিখের রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। শবে বরাত কথাটি ফারসী থেকে এসেছে। শব মানে রাত বা রজনী আর বারাত মানে মুক্তি; সুতরাং শবে বরাত অর্থ হলো মুক্তির রাত। ‘শবে বরাত’ এর আরবী হলো ‘লাইলাতুল বারাআত তথা মুক্তির রজনী।
হাদীস শরীফে যাকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য দিবসের রজনী বলা হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ ও পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসী উর্দূ বাংলা ও হিন্দীসহ নানা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এটি ‘শবে বরাত’ নামেই সমধিক পরিচিত।
এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে এসেছে- ‘হা-মীম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয় আমি তা নাযিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয় আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি। এ হলো আপনার প্রভুর দয়া, নিশ্চয় তিনি সব শোনেন ও সব জানেন। তিনি নভোমন্ডল ভূমন্ডল ও এ উভয়ের মাঝে যা আছে সে সবের রব। যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাস কর, তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তিনি জীবন ও মৃত্যু দেন, তিনিই তোমাদের পরওয়ারদিগার আর তোমাদের পূর্ব পুরুষদেরও। তবুও তারা সংশয়ে রঙ্গ করে। তবে অপেক্ষা কর সে দিনের, যেদিন আকাশ সুষ্পষ্টভাবে ধূম্রাচ্ছন্ন হবে। (সূরা দুখান, আয়াত : ১-১০)।
মুফাসসিরীনগণ বলেন, এখানে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসের পূর্ণিমা রাতকেই বুঝানো হয়েছে। (তাফসীরে মাযহারী, রূহুল মাআনী ও রূহুল বায়ান)। প্রখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন মুফতী মুহাম্মাদ শফী (রহ.) বলেন, হযরত ইকরিমাহ (রা.) প্রমূখ কয়েকজন তফসীরবিদ থেকে বর্ণিত আছে, সূরা দুখান এর দ্বিতীয় আয়াতে বরকতের রাত্রি বলে শবে বরাত অর্থাৎ শাবান মাসের পনের তারিখের রাত্রি বোঝানো হয়েছে। (তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন)।
শবে বরাতের ফজিলত
শবে বরাত সম্পর্কে হাদীস শরীফে আছে, হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে মাখলুকাতের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস : ৫৬৬৫)।
হযরত আওফ ইবনে মালেক (রা.) থেকে, ইবনে খুজাইমা হযরত আবু বকর (রা.) থেকে ও আবু মূসা আশআরী (রা.) থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন। (ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৩৯০; সহীহ ইবনে খুজাইমা, কিতাবুত তাওহীদ, পৃষ্ঠা: ১৩৬)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা এ রাতে বিদ্বেষ পোষণকারী ও নিরপরাধ মানুষকে হত্যাকারী ছাড়া বাকী সব বান্দাহকে ক্ষমা করে দেন। (মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল, চতুর্থ খন্ড, পৃষ্ঠা: ১৭৬)।
হযরত উসমান ইবনুল আস (রা.) থেকে বর্ণিত, এ রাতে আল্লাহ তাআলা মুশরিক ও ব্যভিচারিণী ছাড়া সকলের চাওয়া পূরণ করে থাকেন। (শুআবুল ঈমান, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা : ৩৮৩)।
হযরত আবূ সালাবা (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন অর্ধ শাবানের রাত আসে তখন আল্লাহ তাআলা মাখলূকাতের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান; মুমিনদিগকে ক্ষমা করে দেন, কাফিরদের ফিরে আসার সুযোগ দেন এবং হিংসুকদের হিংসা পরিত্যাগ ছাড়া ক্ষমা করেন না। (কিতাবুস সুন্নাহ, শুআবুল ঈমান, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২)।
হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) বলেন, একবার রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে, আমার ধারণা হলো তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন; আমি তখন উঠে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলী নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলী নড়লো; তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়িশা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে?
আমি উত্তরে বললাম ইয়া রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিলো আপনি মৃত্যু বরণ করেছেন কি না? নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম আল্লাহ ও আল্লাহর রসূলই ভালো জানেন। তখন নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত; এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। (শুআবুল ঈমান, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২)।
হাদীস শরীফে বর্ণিত শবে বরাতের বিখ্যাত আরো একটি ঘটনা বিভিন্ন কিতাবে বহু সূত্রে হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রাতে জান্নাতুল বাকীতে এসে মৃতদের জন্য দোয়া ও ইস্তিগফার করতেন।
হযরত আয়িশা (রা.) থেকে আরো বর্ণিত, নবীজী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেছেন, এ রাতে বনী কালবের ভেড়া বকরীর পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশী সংখ্যক গুণাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস : ৭৩৯)।
শবে বরাতের করণীয় আমল সম্পর্কে হাদীস শরীফে আছে, হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, চৌদ্দ শাবান দিবাগত রাত যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদাত বন্দিগীতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখ; কেননা এ দিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং আহ্বান করেন: কোন ক্ষমা প্রার্থী আছো কি?
আমি ক্ষমা করবো; কোন রিযিক প্রার্থী আছো কি? আমি রিযিক দেবো; আছো কি কোন বিপদগ্রস্ত? আমি উদ্ধার করবো। এভাবে ভোর পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে আহ্বান করতে থাকেন। (ইবনে মাজাহ, হাদীস: ১৩৮৪)। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ফকীহ হাফিয ইবনে রজব (র.) বলেন, এ দিনের রোজা আইয়ামে বীয অর্থাৎ চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোযার অন্তর্ভুক্ত। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা: ১৫১)।
শবে বরাতে করণীয় আমলসমূহ
(১) নফল রোযা রাখা; (২) নফল নামায [ক] আউওয়াবীন [খ] তাহজ্জুদ [গ] ছলাতুত তাসবীহ [ঘ] অন্যান্য নফল ও (ঙ) তাওবার নামায ইত্যাদি পড়া (কিরাঅত ও রুকু সিজদা দীর্ঘ করা); (৩) কুরআন শরীফ [ক] সূরা দুখান ও [খ] অন্যান্য ফযীলতের সূরাসমূহ তিলাওয়াত করা; (৪) দুরূদ শরীফ বেশি বেশি পড়া; (৫) ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা; (৬) দোয়া কালাম, তাসবীহ তাহলীল, যিকির আযকার ইত্যাদি করা; (৭) কবর যিয়ারত করা; (৮) নিজের জন্য, পিতা মাতার জন্য, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব ও সকল মুমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করা।
শবে বরাতে বর্জনীয় বিষয়সমূহ
(১) আতশবাজী, পটকা ফুটানো, (২) ইবাদাত বন্দিগী বাদ দিয়ে খামাখা ঘোরাঘুরী করা, (৩) অযাচিত আনন্দ উল্লাস করা, (৪) বেহুদা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ করা, (৫) অন্য কারো ইবাদাতের বা ঘুমের বিঘ্ন ঘটানো, (৭) হালুয়া রুটি বা খানা দানার পিছনে বেশি সময় নষ্ট করে ইবাদাত থেকে গাফিল থাকা।    
মুফতী মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী : যুগ্ম-মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়