Monday, January 16

চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনাপ্রবাহ

চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনাপ্রবাহ
কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: তিন বছর আগে নারায়ণগঞ্জে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনাটি আলোড়ন তুলেছিল সারাদেশে। অপহৃত সাতজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। অপহৃত ব্যক্তিদের প্রথমে চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে  অচেতন করা হয়। তারপর মুখে পলিথিন পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে আসামিরা। সর্বশেষ নদীতে ফেলার সময় লাশগুলোর পেট চিরে দেয়া হয়। জড়িত র‍্যাব সদস্যদের জবানবন্দিতেই উঠে এসেছে ঘটনার নৃশংসতার এই বিবরণ।

হত্যাকাণ্ডের পর উত্তেজিত জনতা সন্দেহভাজন কয়েকজনের বাড়িঘর ও দপ্তর জ্বালিয়ে দেয়। পরে বেরিয়ে আসে যে এই হত‌্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরই কেউ কেউ। যা তখন দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।

হত‌্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি কাউন্সিলর নুর হোসেনের পালিয়ে যাওয়া নিয়েও সমালোচনা ওঠে। নুর হোসেন পরে ভারতে ধরা পড়েন, ফিরিয়ে আনা হয় তাকে।

হত্যাকাণ্ডে নিহতদের স্বজনদের করা দুই মামলায় ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ৩৮টি শুনানির পর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক এ বছরের ১৬ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার দিন ঠিক করেন। সারাদেশকে নাড়িয়ে দেয়া এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাপ্রবাহ:

শীতলক্ষ‌্যায় ভেসে ওঠে হাত পা-বাঁধা লাশ

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে মামলায় হাজিরা দিতে যান সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম। গাড়িতে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়াম এলাকা থেকে অপহৃত হন তারা পাঁচজন। একই সময়ে অপহৃত হন আরেক গাড়িতে থাকা আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক। পরদিন নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনসহ ছয়জনকে আসামি করে ফতুল্লা থানায় অপহরণের মামলা করেন। যেটি পরে হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।

অপহরণের ঘটনায় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার; ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ সব এসআইকে অন্য জেলায় বদলি করা হয়। ৩০ এপ্রিল বিকালে শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া শান্তির নগর এলাকা থেকে নজরুল, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমের হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করা হয়। পরদিন একই জায়গায় মেলে নজরুলের আরেক বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটনের লাশ।

সব লাশের পেট ছিল কাটা। প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দুটি করে বস্তায় বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এরপর উত্তেজিত জনতা ১ মে সকালে কাউন্সিলর নূর হোসেনের কার্যালয়; রাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হাজি মো. ইয়াসিনের বাড়ি  ভাংচুর করে ও সংলগ্ন কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ৭ মে চন্দনের জামাতা বিজয় কুমার পাল অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে ফতুল্লা থানায় আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

৪ মে নজরুলের শ্বশুর অভিযোগ করেন, র‌্যাবের তিন কর্মকর্তা লেফটেন‌্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, লেফটেন‌্যান্ট কমান্ডার এম এম রানা ও মেজর আরিফ হোসেন ছয় কোটি টাকার বিনিময়ে এ সাতজনকে অপহরণের পর খুন করেন।

সেনা কর্মকর্তা তারেক সাঈদ ত্রাণ ও দুর্যোগ ব‌্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা। তিনি র‌্যাব-১১ এর অধিনায়ক ছিলেন। নৌবাহিনীর কর্মকর্তা রানা ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আরিফও র‌্যাব-১১ তে ছিলেন।

১১ মে নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন, সদস‌্য মাহবুবুর রহমান ইসমাইল ও চন্দনের জামাতা বিজয় কুমার পালের রিট আবেদনে হাইকোর্ট তিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়। পরদিন পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তারে সহযোগিতা চেয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ১৫ মে পুলিশকে চিঠি দিয়ে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিওর (সিআরপিসি) অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলে। ওইদিন রাতেই মিলিটারি পুলিশের সহায়তায় ঢাকা সেনানিবাসের বাসভবন থেকে তারেক সাঈদ ও মেজর আরিফ হোসেনকে গ্রেপ্তার করে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ।

পরদিন রাতে নৌ-বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা এম এম রানাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশের কাছে তুলে দেন।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর এই তিন কর্মকর্তাকেই বাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়।

মামলার প্রধান আসামী কাউন্সিলর নুর হোসেনকে ওই বছরের ১৪ জুন গভীর রাতে কলকাতার দমদম বিমানবন্দর সংলগ্ন বাগুইআটি থানা পুলিশ আটক করে।

২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে তাকে বাংলাদেশের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৪ নভেম্বর তাকে নারায়ণগঞ্জ আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাকে জেল হাজতে পাঠান।

কারাগারে ২৩, পলাতক ১২

হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৫ জনকে আসামি ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠন করে পুলিশ। এদের মধ্যে ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যার ১৭ জন র‌্যাব সদস্য। পলাতক ১২ জনের মধ্যেও র‌্যাবের ৮ জন রয়েছেন।

কারাগারে আছেন নুর হোসেন, তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন, মাসুদ রানা, হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন,  ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মো: শিহাব উদ্দিন, এসআই পুর্নেন্দ বালা, কর্পোরাল রুহুল আমিন, এএসআই বজলুর রহমান, নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, আবুল বাশার, হাবিলদার নাসির উদ্দিন, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, সৈনিক নুরুজ্জামান, কনস্টেবল বাবুল হাসান, সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর ও নূর হোসেনের সহযোগী মোর্তুজা জামান চার্চিল।

ধরা পড়েননি কর্পোরাল মো. মোখলেছুর রহমান, সৈনিক আব্দুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম, সার্জেন্ট এনামুল কবীর, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান, নুর হোসেনের সহযোগী সেলিম, সানাউল্লাহ ছানা, ম্যানেজার শাহজাহান, ম্যানেজার জামাল উদ্দিন।

গ্রেপ্তার আসামিদের ২১ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলায় ১২৭ জনকে সাক্ষী করা হলেও আদালত ১০৬ জনের সাক্ষ্য নেন। অভিযোগপত্র নেওয়ার পর জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালতে ৩৮টি শুনানির পর ১৬ জানুয়ারি রায় ঘোষণার দিন ধার্য হয়।

নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ওই মামলায় আজ রায় দিয়েছেন আদালত। রায়ে সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাসহ ২৬ আসামির ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে। বাকি নয় জনকে সাত থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আজ সোমবার নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন এ রায় ঘোষণা করেন। সূত্র: বিডিনিউজ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়