কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক:
দুর্ঘটনাকবলিত শিশুকে কোলে নিয়ে পুলিশ কনস্টেবলের কান্নার ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। ফেসবুকজুড়ে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ব্যবহারকারীদের প্রশংসায় ভাসছেন কনস্টেবল শের আলী।
পুলিশ কনস্টেবল শের আলী চট্টগ্রাম নগর পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিটের উত্তর-দক্ষিণ বিভাগের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটে কর্মরত আছেন। তার কনস্টেবল নম্বর ২৫৪৬।
ফেসবুকে ছবিটি দেখে শের আলীকে ফোন করে অভিনন্দন জানান নগর পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিটের উপ কমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) পরিতোষ ঘোষ।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, শের আলী পুলিশ ডিপার্টমেন্টের মাথা উঁচু করেছেন। তিনি পুলিশ বাহিনীর গর্ব। মানুষ হতে হলে কী ধরনের মানবিকতাবোধ থাকতে হয়, তিনি সেটা সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। শের আলীর জন্য মানবতার জয় হয়েছে।
কনস্টেবল শের আলী তিনদিনের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার রশিদনগর ইউনিয়নের পানিরছড়া গ্রামে গিয়েছিলেন। মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) তিনি কর্মস্থলে যোগ দেবেন বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন।
রোববার (১১ ডিসেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের রামু উপজেলার পানিরছড়া এলাকায় শের আলীর বাড়ির কাছাকাছি এলাকায় বাস উল্টে নিহত হন চারজন। একই দুর্ঘটনায় আহত হন কমপক্ষে ২৩ জন।
শের আলী যখন উদ্ধারে ব্যস্ত তখন অনেকে সেলফি তুলছিলেন
শের আলী টেলিফোনে বাংলানিউজকে জানান, দুর্ঘটনার খবর শুনে তিনি দ্রুত ঘটনাস্থলে যান। সেখানে গিয়ে তিনি বাসের ভেতরে আটকে পড়া যাত্রীদের আর্তনাদ শুনেন। তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজনকে উদ্ধারে হাত লাগাতে বলেন। কেউ কেউ এগিয়ে এলেন। কেউ তার কথাকে পাত্তা দিলেন না।
‘আমি গ্রামের ৪-৫ জন নিয়ে উদ্ধার কাজে নেমে পড়ি। তখন অনেককে দেখি মোবাইলে সেলফি তুলছে। আমি একটি করাত দিয়ে বাসের কিছু অংশ কেটে একটি মৃতদেহ এবং ৪ জনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করি। তারপর সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী টিম এসে রেকার দিয়ে বাসটাকে একটু আলগা করল। আমি এক মহিলাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ভেতর থেকে টেনে বের করলাম। ’ বলেন শের আলী।
‘মেয়ের চেহারাটা ভেসে উঠল, চোখে পানি এসে গেল’
শের আলী জানান, বাসটি আলগা হওয়ার পর ছোট্ট একটি প্রবেশপথ দিয়ে তিনি বাসের ভেতরে ঢুকে যান। ভেতর থেকে কয়েকজনকে ওই প্রবেশপথ দিয়ে তিনি ঠেলে দেন আর বাইরে থাকা জনতা তাদের টেনে বের করেন। এক পর্যায়ে শের আলী দেখলেন, একটি ছোট মেয়ে হাত-পা নাড়ছে। তার চোখ থেকে মাথার উপরের অংশ বাসের ছাদের সঙ্গে লাগোয়া ব্যাগ রাখার রেকের নিচে চাপা পড়ে আছে। তিনি রেকটি আস্তে আস্তে বাঁকা করলেন। মেয়েটিকে আস্তে আস্তে বের করলেন।
‘মেয়েটি ক্লান্ত হয়ে আমার বুকে লুটিয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে বলতে লাগল, আব্বু আমি পানি খাব। আমারও পাঁচ বছরের মেয়ে আছে। জান্নাতুল আদম শের এ মীম। মেয়ের চেহারাটা মনে পড়ে গেল আর আমার চোখে পানি এসে গেল। তাকে বুকে নিয়ে আমি বাস থেকে বের হয়ে হাসপাতালের দিকে দৌঁড়াতে থাকলাম। ’ বলেন শের আলী।
শের আলীর উদ্ধার করা সেই মেয়ে উম্মে হাবিবা (৫) এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। তবে সে এখন আশংকামুক্ত বলে শুনেছেন শের আলী।
এদিকে শিশুকে কোলে নিয়ে শের আলীর কান্নাজড়িত ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারাও বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে এবং ছবিটি আপলোড করে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করছেন।
শের আলীর সেই ছবিসহ শাহীন রাকিব নামে এক নারীর পোস্ট ফেসবুকে শেয়ার করেছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।
সেই পোস্টে লেখা হয়েছে, আপনারা কি ভাবছেন শিশুটিকে কোলে নিয়ে যে লোক কান্নাকাটি করছে আর রাস্তায় দিয়ে দৌড়াচ্ছেন সেই শিশুটি তার ? না বন্ধুরা এই শিশুটিকে এই লোক চেনেই না। এই লোকটির নাম শের আলী। সে একজন পুলিশ। যে পুলিশ শব্দটা শুনলেই আপনার আমার চোখ কুঁচকে উঠে এই শের আলী সেই পুলিশের একজন সদস্য। শের আলী শিখিয়ে দিল মানবতা কাকে বলে ?...
বিনম্র শ্রদ্ধা আর অপার ভালবাসা শের আলী । স্যালুট আপনাকে । ’
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) মুহাম্মদ রেজাউল মাসুদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পাষাণ পৃথিবী, স্বার্থের জন্য ছুটছি সবাই। আজব দুনিয়া! প্রতিদিন হিংসা বিদ্বেষ বাড়ছে মায়া মমতা কমছে। চারিদিকে যেন রক্তের হলিখেলা। বাড়ছে শত্রুতা। স্বার্থের কাছে সবাই এক প্রকার অন্ধ! ব্যতিক্রমও যে নেই তা নয়, যেমন শের আলী। অন্যের জন্য কাঁদলেন, আর কাঁদালেন বুঝিয়ে দিলেন মানুষ মানুষের জন্য। …..রক্তাক্ত শিশুটিকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে সর্ব শক্তি দিয়ে দৌঁড়ানো শুরু করেন শের আলী! দৌঁড়ানোর সাথে সাথে অপরিচিত এই শিশুটির জন্য চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন। তার কান্নায় শোকে স্তব্ধ গোটা পরিবেশ সবাই অবাক। শিশুটির কষ্ট ও যন্ত্রণা দেখেই অঝোরে কেঁদেছেন তিনি যেন আপন কেউ। ওই সময় শের আলীর কান্না দেখে উপস্থিত জনতাও চোখের পানি আটকাতে পারেননি। শের আলীর চরিত্রই আসল চরিত্র। এটাই হচ্ছে মানবতা। মানবিকতা ও উত্তম চরিত্রের উদাহরণ। সমাজে এই মানুষ গুলি হারিয়ে যাচ্ছে। তাকে মুল্যায়ন না করলে হয়তো অকৃতজ্ঞই থেকে যাবো আমরা। আসুন আমরা বদলাই, তাহলে বদলাবে সমাজ, বদলে যাবে প্রিয় দেশ। ’
বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসিন ফেসবুকে ছবিটি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘গর্বিত আমরা তোমার জন্য...’
গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ও বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর সাবেক সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু ফেসবুকে ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘আপনিই শের আলী। আপনিই বাংলাদেশ। আপনিই মানবতার প্রতিমূর্তি। শের আলী, আপনাকে সালাম। ’
জেষ্ঠ্য সাংবাদিক এজাজ মাহমুদ কনস্টেবল শের আলীকে ‘মানবতার বীর’ উল্লেখ করে ফেসবুকে লিখেন, ‘শের আলী। পুলিশ সদস্য। সিএমপির গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত। ছুটি কাটতে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে মানবতার এক নতুন ইতিহাস গড়লেন তিনি। ৬ বছেরর এক শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে কেঁদে কাঁদালেন পুরো দেশকে। স্যালুট শের আলীকে। আপনার কাছে আবার শিখলাম মানবতা। ’
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ কমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) পরিতোষ ঘোষ বাংলানিউজকে বলেন, কনস্টেবল শের আলী কর্মস্থলে যোগ দেয়ার পর তাকে সিএমপি এবং ডিবি’র পক্ষ থেকে পুরস্কৃত করা হবে।
সূত্র:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
খবর বিভাগঃ
সারাদেশ
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়