মুহাম্মদ রুহুল আমীন নগরী:
বাংলার আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের পূর্বাঞ্চল তথা বৃহত্তর জৈন্তা প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী এক জনপদ। এখানে যুগে যুগে অসংখ্য জ্ঞানী-গুণী, পীর-আউলিয়া, বিশিষ্টজনের জন্ম হয়েছে। সুরমা-কুশিয়ারা বেষ্টিত এলাকায় ইসলামী শিক্ষাবিস্তারে পূর্ব সিলেটের অবদান সবচাইতে বেশি। ঐতিহ্যবাহী এ জনপদের অন্যতম গুণী ব্যক্তিত্ব ও হাদীস বিশারদ ছিলেন মাওলানা ফয়জুল বারী মহেষপুরী। তিনি সম্প্রতি মহান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলে গেছেন। শায়েখ মহেষপুরী সত্যিকার অর্থেই একজন ইনসানে কামেল (পরিপূর্ণ মানুষ) ছিলেন, আল্লাহর নৈকট্য হাসিলকারীদের প্রথম সারির অন্যতম একজন ছিলেন। পূর্ব গগনে উদিত সূর্যের মতোই আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী (র.) পরে তিনি পূর্ব সিলেটকে হাদীসের রৌশনিতে আলোকিত করেছিলেন। জীবনের শেষলগ্নে শাহ জালালে ছানী শায়খুল ইসলাম আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানী (র.)-এর ইলমী-আমলী দুর্গ হিসেবে পরিচিত সিলেটের নয়াসড়ক মসজিদ ও মাদরাসাকে কেন্দ্র করেই ছিল তাঁর কর্মব্যস্ততা। নয়াসড়ক জামে মসজিদের প্রায় দুই যুগের খতিব হিসেবে প্রতি শুক্রবার বয়ান করতেন। এছাড়া রমজান মাসে ইতেকাফও করতেন শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী (র.)-এর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যবাহী নয়াসড়ক মসজিদে। ফেৎনা-ফাসাদের বেড়াজাল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতেই সরে দাঁড়িয়েছিলেন দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীর প্রিয় কর্মস্থল দারুল উলুম কানাইঘাট থেকে। হাদীস শাস্ত্রের উজ্জ্বল এই নক্ষত্রের এ-গ্রহ ছেড়ে চলে যাওয়ায় সত্যিই বিশাল শূন্যতা বিরাজ করছে। বহুবিধ জ্ঞানের অধিকারী ‘আল্লামা’ ফয়জুল বারী মহেষপুরী (র.) রাজনীতির ময়দানে আকাবির আছলাফের (পূর্বসূরীদের) শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী কাফেলা জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে তাঁর মতো বহুদর্শী একজন খতিবের চলে যাওয়া আমাদের জন্য দুঃসংবাদই বটে।
তিনি ১০ জানুয়ারি ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের শুক্রবার বেলা পৌনে ২ টায় কানাইঘাট উপজেলাধীন মহেষপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। সিলেট নগরীর ঐতিহ্যবাহী নয়াসড়ক জামে মসজিদের খতিব ও নয়াসড়ক দারুল হাদীস টাইটেল মাদরাসার শায়খুল হাদীসের দায়িত্বও পালন করেছেন। পূর্বসিলেটের কওমী মাদ্রাসাসমূহের প্রাচীনতম শিক্ষাবোর্ড আযাদ দ্বীনী এদারার সভাপতি ছিলেন। আধ্যাত্মিক ময়দানে তিনি ফেদায়ে মিল্লাত হযরত আসআদ মাদানীর নিকট থেকে খেলাফত প্রাপ্ত হন। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ৭ মে সিলেট নয়াসড়ক মাদরাসা মার্কেটে আল-কলম গবেষণা পরিষদের পক্ষ থেকে তাঁর জীবনবৃত্তান্ত জানার জন্য দেখা করি। সেদিন দীর্ঘ আলাপচারিতায় সমকালীন অনেক বিষয়াদি তিনি আমাদেরকে বলেছিলেন। সেখান থেকেই আজকের এই লেখা।
শায়খুল হাদীস আল্লামা ফয়জুল বারী মহেষপুরী ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলাধীন মহেষপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মুহাম্মদ আসআদ একজন সৎ ব্যবসায়ী ও ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। মাতা মাহমুদা বেগম ছিলেন একজন পর্দানশীন দ্বীনদার মহিলা। শিক্ষাজীবনে তিনি স্থানীয় বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধ্যয়নের পর কানাইঘাট দারুল উলূমে ভর্তি হন। অতঃপর উমরগঞ্জ ইমদাদুল উলূম মাদরাসায় ৪ বছর লেখাপড়া করে চলেযান গাছবাড়ি। তিনি গাছবাড়ি আলিয়া মাদরাসায় বুখারী ও তিরমিযি শরিফ পড়েন। ১৯৪০-৫০ এর কোনো এক সময় গাছবাড়ি জামিউল উলূম কামিল মাদরাসা থেকে ফাযিল উত্তীর্ণ হন। ১৯৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দে সিলেটে সরকারী আলিয়া মাদরাসা থেকে প্রথমবিভাগে তাকমিল ফিল হাদীস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কৃতিত্ব অর্জন করেন। তাঁর উস্তাদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেনÑপ্রিন্সিপাল মাওলানা মোহাম্মদ হাসান, মাওলানা ফৈয়াজ আলী, মাওলানা আব্দুল ওয়াহিদ শায়খে রাজারগাও প্রমুখ। এছাড়া তাঁর জীবন গঠনে যে-সকল উস্তাদের বিশেষ ভূমিকা ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম, আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী, মাওলানা আব্দুর রব কাসেমী, মাওলানা শায়খ আব্দুস সামাদ, মাওলানা মছদ্দর আলী, মাওলানা আবু সাঈদ (র.) প্রমুখ। যশোর সিদ্দিকীয়া সিনিয়র মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে শায়খে মহিষপুরীর কর্মজীবনের সূচনা। সেখানে ২ বছর শিক্ষকতার পর তাঁর শিক্ষক আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী (র.)-এর নির্দেশে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে চলে আসেন দারুল হাদীস কানাইঘাট মাদরাসায়। প্রথমে শিক্ষক, পরে পর্যায়ক্রমে নাজিমে তালিমাত (শিক্ষা সচিব), শায়খুল হাদীস (বোখারি শরিফের শিক্ষক), ও মুহতামিম এর গুরুদায়িত্ব পালন করেন। তিনি তাঁর দায়িত্বকালীন সময়ে দারুল উলুম কানাইঘাটকে বৃহত্তর সিলেটের শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়তে বিরামহীন পরিশ্রম করেছেন। তিনি দারুল উলুম কানাইঘাটের ৪র্থ মুহতামিম; তাঁর সময় ছিল ১৯৮৮-২০০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। মুহতামিম হওয়ার পূর্বে তিনি ৭ বছর নাজিমে তালিমাত ছিলেন। প্রায় ১৯ বছর শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত কানাইঘাট ইসলামিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়ে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে দাওরায়ে হাদীস খোলা হয়। মাদরাসার প্রথম মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস ছিলেন (দায়িত্বকাল ১৯৫৩Ñ১৯৭০) মাওলানা মুশাহিদ বায়মপুরী, দ্বিতীয় মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস ছিলেন মাওলানা মুজাম্মিল (দায়িত্বকাল-১৯৭১-৭২), তৃতীয় মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস ছিলেন মাওলানা শহরুল্লাহ চটির হুজুর ( দায়িত্বকাল-১৯৭৩-১৯৮৭)। দীর্ঘ প্রায় অর্ধশতাব্দীকালের প্রিয় এই কর্মক্ষেত্র ছেড়ে ইন্তেকালের ক’বছর আগে (২০০৬ খ্রিস্টাব্দে) তিনি কর্মজীবনের এই ঠিকানা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আল্লাহর প্রিয় এই বান্দা মৃত্যুর ক’দিন পূর্বে কাফনের ব্যবস্থার জন্য নগদ কিছু টাকা নিজ সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে কোন জায়গায় তাকে সমাহিত করা হবে এ সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়ে যান। এছাড়া কর্মজীবনে দারুল উলূম থেকে ১৯ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা হারে মাসিক যে বেতন তিনি নিয়েছিলেন এই টাকা ফেরত দিতে তিনি মৃত্যুর আগে নিজ সম্পদ মাদরাসায় দান করে গেছেন। জানা গেছে, প্রায় ৪০ লক্ষ টাকার জমি মাদরাসার নামে ওয়াকফ করে দিতে পরিবারের সদস্যদের ওসিয়ত করে গেছেন। বেতন বাবদ তিনি যে-পরিমাণ অর্থ মাদরাসা থেকে নিয়েছিলেন তার চেয়ে বহুগুণ সম্পদ মাদরাসার নামে দান করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেন শায়েখ মহেষপুরী।
সত্যকে সত্য, সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। বিভিন্ন সময় বয়ানে তিনি ইসলামের প্রতিপক্ষের মুখোশ উন্মোচনে কোরআন-সুন্নাহ নির্ভর সারগর্ভ এবং অত্যন্ত সুশীল ভাষায় আলোচনা করতেন।
২০০৭ খ্রিস্টাব্দে জামিয়া ইসলামিয়া হোসাইনিয়া নয়াসড়ক মাদরাসায় তাঁর মাধ্যমে দরসে বোখারি (হাদিসের ক্লাস) চালু হয়। সেখানে একাধারে ৫ বছর হাদিসের দরস দেন। ২০১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে অসুস্থতার কারণে নিয়মিত আসতে পারেননি। আধ্যাত্মিক ময়দানে তিনি প্রথমে বাহরুল উলুম আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী (র.)-এর হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। অতঃপর স্বীয় মুর্শিদের ইন্তেকালের পর ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগ্রামী নেতা শায়খুল ইসলাম সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী (র.)-এর সুযোগ্য সন্তান ফেদায়ে মিল্লাত সৈয়দ আসআদ মাদানী (র.)-এর কাছে বায়াত দেন। পরবর্তীকালে তাযকিয়ায়ে ক্বলবের মেহনতে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে হযরত সৈয়দ আসআদ মাদানী (র.)-এর নিকট থেকে খিলাফতপ্রাপ্ত হন। শায়খুল হাদীস মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ী, মাওলানা শিহাবুদ্দিন রেঙ্গা, মাওলানা নছিব আলী, মাওলানা শফিকুল হক সুড়ইঘাটি, মাওলানা আলিম উদ্দীন দুলর্ভপুরী প্রমুখ মরহুমের ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম।
তিনি জীবনে ৭ বারেরও অধিক পবিত্র হজ্ব পালন করেন। পারিবারিক জীবনে ১ ছেলে ও ৭ মেয়ের জনক। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিষনপুর নিবাসী উসমান আলীর ৪ র্থ কন্যা আলেয়া বেগমের সাথে প্রথমে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ তরফে কোনো সন্তানাদি নেই। এরপর একই গ্রামের হাজি ইমরান আলীর ২য় মেয়ে বেলায়তুননেছার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ তরফে ১ ছেলে ও ৭ মেয়ে জন্মলাভ করেন। বিভিন্ন সময়ে মোট ৪ টি বিয়ে করেন। একমাত্র ছেলে মাওলানা আব্দুল লতিফ দারুল উলুম কানাইঘাট মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন।
খবর বিভাগঃ
প্রতিদিনের কানাইঘাট
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়