Saturday, November 5

সুন্দরী তরুণীদের প্রতারণার মহাফাঁদ; টার্গেট লোভী ব্যক্তিরা

সুন্দরী তরুণীদের প্রতারণার মহাফাঁদ; টার্গেট লোভী ব্যক্তিরা

কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: ‘পাত্র চাই। ধনাঢ্য পিতার একমাত্র সুন্দরী ডিভোর্সি কন্যা। ঢাকায় নিজের নামে বাড়ি ও দুটি দোকান রয়েছে। সম্পদ দেখাশোনা করার জন্য সৎ, শিক্ষিত পাত্র চাই। পাত্রকে প্রতিষ্ঠিত করা হবে। প্রকৃত পাত্ররা যোগাযোগ করুন। সরাসরি।’ নিচে পাত্রীর ফোন নম্বর। বিভিন্ন পত্রিকায় এভাবেই বিজ্ঞাপন প্রচার করে প্রতারণায় নেমেছিল চক্রটি। এ এক ভয়াবহ প্রতারণা। টার্গেট উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবক। সহজে বিত্তশালী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন
 যারা। তাদেরকে ফাঁদে ফেলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় এই চক্র। নারী-পুরুষের সমন্বয়ে গড়ে উঠা এরকম বিভিন্ন চক্র রয়েছে রাজধানী জুড়ে।

সম্প্রতি এরকম একটি চক্রের তিন জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে আদালতে। তারা জানিয়েছে দীর্ঘদিন থেকে ঢাকার বিভিন্নস্থানে অভিজাত বাসা ভাড়া নিয়ে প্রেম ও বিয়ের নামে প্রতারণা করে আসছে। এই চক্রে যেমন ভুয়া প্রেমিকা ও পাত্রী আছে। তেমনি আছে ভুয়া ডিবি পুলিশ ও সাংবাদিক। পত্রিকায় পাত্র চাই বিজ্ঞাপন দিয়ে বা ফোনে কথা বলে যুবকদের আকৃষ্ট করা হয়। নিপুণভাবে করা হয় প্রেমের অভিনয়। অভিসারের নামে ডেকে নেয়া হয় বাসায়। অন্তরঙ্গ মুহূর্তেই প্রকাশ পায় ওই সুন্দরী পাত্রীর স্বরূপ। হাজির হয় সাংবাদিক ও পুলিশ। ফাঁসানো হয় পাত্র বা প্রেমিককে। দাবি করা হয় লাখ লাখ টাকা।

প্রতারণার এসব কৌশলের কথাই স্বীকার করেছে গ্রেপ্তার তিন জন।

বাড়ির নাম এমপি ভবন। ৯১/১ স্বামীবাগ, ঢাকা। সপ্তম তলা ভবনের ষষ্ঠ তলার একটি ফ্ল্যাটে ঘটে এ ঘটনা। একটি দুটি না, একাধিক ঘটনা। ঘনঘন বাসা পরিবর্তন করে প্রতারণার ঘটনার জন্ম দেয় এই চক্র। সর্বশেষ একটি রাজনৈতিক দলের জেলাপর্যায়ে প্রথম সারির নেতা তাদের প্রতারণার শিকার হন। তার কাছ থেকে নগদ পাঁচ লক্ষাধিক টাকা ও পাঁচ লাখ টাকার একটি চেক লিখে নেয় চক্রটি।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পটুয়াখালীর ওই নেতা দীর্ঘদিন থেকে বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছিলেন। একটি দৈনিকে বিজ্ঞাপন দেখে সরাসরি পাত্রীর ফোনে কল দেন। আকর্ষণীয় কণ্ঠ। সেদিন অল্প কথা বলেন পাত্রী। কয়েক বাক্যে পাত্রী বুঝিয়ে দেন এমন পাত্র চাই যে তার অভিভাবক হতে পারবে। তার বিশাল সম্পত্তি দেখাশোনা করবে। পাত্রের মন-মানসিকতা ভালো হলেই চলবে। এজন্য জানাশোনা দরকার। বিয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আগে কাউকে না জানানোর পরামর্শ দেন পাত্রী।  শুরুটা গত মে মাসে।

পাত্রীর আকর্ষণীয় কণ্ঠ, কথায় মুগ্ধ ওই নেতা। নিজ উদ্যোগেই কল দেন তাকে। কথা হয় রাত-বিরাতে। পাত্রীর নাম শাওন। শাওন জানান, নেতার ব্যবহারে মুগ্ধ তিনি। তিনি নিজের অজান্তেই প্রেমে পড়েছেন তার। শিগগিরই তাকে কাছে পেতে চান। তারপর দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায় তাদের সম্পর্ক। কীভাবে কোথায় বিয়ে হবে, বিয়ের পরে দেশের বাইরে কোথায় বেড়াতে যাবেন এসব পরিকল্পনার কথাই বলছিলেন পাত্রী। স্বপ্নগুলো ঘুম কেড়ে নিয়েছিল ওই নেতার। পটুয়াখালী থেকে ছুটে আসেন ঢাকায়। আমন্ত্রণ পাত্রীর বাসা স্বামীবাগে।

সেদিন ২৮শে মে, দুপুর। গুলশান-২ এর ঘনিষ্ঠজনের বাসা থেকে যাত্রা করেন শাওনের বাসার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে নিয়ে যান মিষ্টি ও পাত্রীর জন নানা গিফট। বাড়ির ষষ্ঠ তলার ফ্ল্যাটের দরজায় নক করতেই তা খুলে দেন একজন নারী। তার নাম সালমা। কিছুক্ষণ ড্রয়িং রুমে বসতেই সুন্দরী শাওন এসে হাজির। কথা বলেন দুজনে। সালমা আড়ালে চলে যায়। বাসায় আর কেউ নেই। পাত্রী জানান, বিয়েটা কয়েক দিনের মধ্যেই করতে চান। এভাবে থাকতে চান না তিনি। পাত্রকে ঢাকায় তার বাসাতেই থাকতে প্রস্তাব দেন। এর মধ্যে ওই নেতাকে আপ্যায়নের জন্য কয়েক বার পাশের রুমে যান ওই পাত্রী।

আপ্যায়ন করা হয়। ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেন দুজন। অতঃপর বেডরুমে নিয়ে যান নেতাকে। দরজা চাপানো। দুজনের রোমান্টিক প্রস্তুতি। একটি অন্তরঙ্গ মুহূর্তের প্রাক পর্ব। যেন এমনটির জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন ওই নেতা। কিন্তু তা বেশিদূর এগুয়নি। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ। এই কলিংবেলের শব্দ সব এলোমেলো করে দেয়। বাসায় ঢুকে কয়েক ডিবি পুলিশ ও সাংবাদিক। ক্লিক ক্লিক করে স্বল্প বস্ত্র পরনে থাকা ওই নেতা ও পাত্রীর ছবি ফ্রেমবন্দি হয় ক্যামেরায়। হাতে-পায়ে ধরেও পুলিশ ও সাংবাদিকদের ম্যানেজ করতে পারছিলেন না নেতা। পাত্রী নির্বাক দাঁড়িয়ে।

নেতার কাছে ২০ লাখ টাকা দাবি করে ওই চক্র। নতুবা ছবিগুলো পত্রিকায় প্রকাশ করা হবে। তার নামে মামলা হবে। এই মামলায় তাকে জেলে যেতে হবে। মান-সম্মান থাকবে না। বাধ্য হয়েই পরিবারের কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা এনে দেন তিনি। এ ছাড়াও তার কাছ থেকে দেড় লক্ষাধিক টাকার স্বর্ণ ও মোবাইলফোন লুটে নেয় এই চক্র। এ ঘটনায় গেন্ডারিয়া থানায় মামলা হয়েছে। মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এসব তথ্য পেয়েছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। শুধু একটি দুটি ঘটনা না। এরকম নানা ঘটনা ঘটিয়েছে এই চক্র। এই চক্রের খুলনার মেয়ে সালমা আক্তার বিথী, আবদুল মালেক হাওলাদার কবির ও গাজী আবু জাফর মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু চক্রের সুন্দরী নারী শাওন ও আজাহার এবং মোস্তফাকে এখনও গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

তদন্তকারী কর্মকর্তা  মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক ডিএমএ মজিদ বলেন, শাওন নামের ওই তরুণী কখনও প্রেমিকা কখনও পাত্রী সেজে অভিনয় করে ছেলেদের আকৃষ্ট করে। পরে বাসায় ডেকে নিয়ে ফাঁদে ফেলে দেয়। ওই সময়ে ভুয়া পুলিশ ও সাংবাদিক সেজে চক্রের অন্য সদস্যরা মেয়ের সঙ্গে বিবস্ত্র অবস্থায় ছবি ধারণ করে। ছেলের আর্থিক অবস্থা বুঝে অর্থ দাবি করে। তা দিতে না চাইলে তা মিডিয়ায় প্রকাশ ও মামলার ভয় দেখায়।

তিনি জানান, এভাবে অর্থ আদায় করে এই চক্র। প্রয়োজনে মারধরও করে। এই অপকর্মের জন্য ঘনঘন বাসা পরিবর্তন করে এই চক্র। চক্রের শাওন নামের তরুণীর বাড়ি বরিশালে বলে জানা গেছে। শাওনসহ চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তার করতে তৎপরতা চলছে বলে জানান তিনি।
তার আগে গত বছরের ১৭ই নভেম্বর খিলগাঁওয়ের মালিবাগ থেকে প্রতারক চক্রের দুই তরুণীসহ সাত জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৩।

মালিবাগের চৌধুরীপাড়ার চানবেকারী গলির একটি বাসা ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে প্রতারণা করে আসছিল এই চক্র। সর্বশেষ এই চক্রের ফাঁদে পড়েন সোহেল নামের এক যুবক। দক্ষ অভিনেত্রীর মতো সোহেলের মতো তরুণদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের সূত্রপাত করে তানিয়া। নিজেকে কখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, কখনও কর্মহীন বলে পরিচয় দিতো।

মূলত সংশ্লিষ্ট ছেলের সঙ্গে তাল মেলাতে যে পরিচয় দিতে হয় তাই দিত। প্রেমের ফাঁদে ফেলে গত ১৫ই নভেম্বর সোহেলকে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের আস্তানায়। তারপরই তিন যুবক ওই ঘরে প্রবেশ করে। তরুণী তানিয়ার সঙ্গে কিসের সম্পর্ক, কেন এই বাসায় আসছে নানা প্রশ্ন। কেড়ে নেয়া হয় তার সঙ্গে থাকা মোবাইলফোন ও মানিব্যাগ। হুমকি-ধমকির একপর্যায়ে মারধর করা হয় তাকে। বেঁধে রাখা হয় মুখ, হাত ও পা। একপর্যায়ে তার বাড়ির নম্বর দিতে বলে চক্রের সদস্যরা। ফোনে কান্নার শব্দ শোনানো হয় তার বাবাকে। মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করা হয় তিন লাখ টাকা। মুক্তিপণ না দিলে হত্যার হুমকি দেয়া হয় তাকে। সোহেলের পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি জানান র‌্যাবকে। বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে রেকি করা হয় ওই বাড়ি। তাকে আটক করার পরদিন রাতেই অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা হয় সোহেলকে। গ্রেপ্তার করা হয় ওই চক্রের কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ খুদির জঙ্গল গ্রামের মামুন, একই এলাকার সুমন, কাঞ্চন, রংপুরের গঙ্গাচরার হাজীপাড়া গ্রামের রুবেল, উত্তর শাহজাহানপুরের ৫৪১ নম্বর বাড়ির শাওন আহমেদ, ঝালকাঠির রাজাপুরের তানিয়া ও কিশোরগঞ্জের তারাকান্দি থানার পাগলী শিমুল পাড়ার হাসনাকে।

সূত্র: মানবজমিন

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়