Friday, November 4

অন্ধকার জয় করার অদম্য গল্প

অন্ধকার জয় করার অদম্য গল্প
কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: মীর আরশেদুল করিম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার রিসোর্স সেন্টারের সহকারী গ্রন্থাগারিক। টাঙ্গাইল সদরে জন্ম। সেখানেই বেড়ে ওঠা। ২ বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে আরশেদুল করিম ৫ নম্বর। তবে আর দশ জনের মতো স্বাভাবিক মানুষ নন তিনি। জন্ম থেকেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তবে দৃষ্টিহীনতা তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়েছেন।

শত প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে অধ্যয়ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিও করছেন এখন। আরশেদুল করিম অন্ধ হলেও ব্যবহার করতে জানেন কম্পিউটার। মাইক্রোসফট অফিস প্রোগ্রামের পাশাপাশি কন্ট্রোল প্যানেলের কাজও করতে পারেন।

কম্পিউটারের উইন্ডোজও সেটআপ দিয়েছেন জীবনে অনেকবার। এছাড়া তিনি বই ও গান লিখেছেন অনেকগুলো। তার জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার গল্প বলেন মানবজমিনের কাছে। অকপটে তুলে ধরেন পড়াশুনা, চাকরি ও অন্যান্য স্মরণীয় ঘটনা।

আরশেদুল করিম বলেন, ভাইবোনের মধ্যে আমার মতো এতোটা অক্ষম কেউ ছিল না। তবে দৃঢ় মনোবল আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। ১৯৮১ সালে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ক্লাস ওয়ানে পড়ালেখা শুরু করি। তখন প্রতিবন্ধীদের জন্য পড়ালেখা করা সহজ ছিল না। ১৯৯১ সালে টাঙ্গাইল বিবেকানন্দ স্কুলের রিসোর্স প্রোগ্রামের আওতায় মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করি। ১৯৯৩ সালে ময়মনসিংহ অ্যাডওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন থেকে আইএ পাস করি। পরে ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজ বিজ্ঞানে অনার্স ও ২০০০ সালে মাস্টার্স পাস করি।

তিনি বলেন, পড়ালেখা শেষ করেছি অনেক কষ্টে। তবে চাকরিতে যোগদানের আগের সময়টা ছিল খুবই কষ্টের। দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি চাকরির জন্য। বহু জায়গায় দিয়েছি ইন্টারভিউ। কিন্তু কেউই আমাদের নিতে চাইতো না। এর মধ্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ৮ বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরে অবশেষে ২০০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে চাকরি পেয়েছি। আমি যখন মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি তখন আমাদের কোনো বই ছিল না। সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে ‘ব্লেইন্ড’ পদ্ধতিতে লেখা নোটের উপর ভরসা করে পড়তে হতো। কাগজে প্রিন্ট করা লেখাকে বিশেষ পদ্ধতিতে খোদাই করে ‘ব্লেইন্ড’ ভাষায় লেখা হয় এটি। এখনকার ছেলেমেয়েরা যেমন অডিও পদ্ধতিতে পড়ালেখা করতে পারে তখন গ্রামে বা মফস্বল শহরে এগুলো কোনোটা অতটা সহজ ছিল না। এমনকি আমরা গ্রামে থাকাকালীন ব্লেইন্ডের জন্য নির্ধারিত কাগজ পেতাম না। সেক্ষেত্রে একবার ব্লেইন্ড করা কাগজকে দ্বিতীয়বার ব্লেইন্ড করার জন্য কাপড় স্ত্রির মতো স্ত্রি করে সমান করে আবার ব্লেইন্ড করতাম। এভাবে মেট্রিক ও আইএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করি। পরীক্ষার সময় শ্রুতি লেখক দিয়ে লিখিয়েছি। কমপক্ষে ২/৩ বছরের জুনিয়রদেরকে শ্রুতি লেখক হিসেবে অনুমতি দেয়া হয়। নিজে লিখলে যেভাবে দ্রুত লেখা যায় শ্রুতি লেখকরা ততোটা দ্রুত লিখতে পারে না। এর পর তারা জুনিয়র, অনেক কিছু কম বোঝে।

তিনি বলেন, পড়ালেখার সময় বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তে হতো। কলেজে যাওয়ার সময় অনেক সময় বাসে উঠতে পারতাম না। একদিন বাস থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়ে খুব ব্যথা পেয়েছিলাম। কারণ বাসটি পুরো না দাঁড়িয়ে রানিংয়ের উপর থেকে আমাকে নামিয়ে দেয়। কিন্তু আমি তো সাধারণ মানুষের মতো দেখতে পারি না। তাই পড়ে গিয়েছিলাম। এছাড়া কলেজে যাওয়ার সময় আমাকে ৩ বার কুকুরে কামড়িয়েছে। তারপরও আমি থেমে থাকিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর এখানে ‘ব্লেইন্ড’ পদ্ধতির পাশাপাশি অডিও পদ্ধতিতে পড়ালেখা করার সুযোগ পাই।

আরশেদুল করিম চাকরির পাশাপাশি একজন লেখকও। ‘স্বপ্নে আমি বাস্তবে তুমি’ নামের একটি বই বের হয়েছে তার। এছাড়া, ১৫টির বেশি বইয়ের পাণ্ডুলিপি রয়েছে। কিন্তু প্রকাশকদের অনাগ্রহের কারণে সেগুলো ছাপা হয়নি। বইয়ের পাশাপাশি আরশেদুল লিখেছেন প্রায় ৬০০ থেকে ৭০০ সংগীত।

তিনি বলেন, এখন প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকার অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। তারপরও অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। নিয়ম থাকার পরও অনেক কিছুর বাস্তবায়ন নেই। আইন থাকার পরও অনেক আইনের প্রয়োগ নেই। এর মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে গিয়ে অনেক ধকল সামলাতে হয়। আমরা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা অনেকেই স্বাক্ষর দিতে পারি না। টিপসই দিতে হয়। কিন্তু টিপসইয়ের মাধ্যমে একাউন্ট খুলতে চায় না প্রাইভেট ব্যাংকগুলো। এরকম বিভিন্ন ধরনের সেবা থেকে আমরা বঞ্চিত হই। আমরা চাই বিদেশে প্রতিবন্ধীরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পায় সরকার যেন আমাদের দেশেও সেই ধরনের সুবিধা দেয়। আমাদের সুযোগ দিলে আমরা নিজেদের বোঝা হিসেবে নয় দেশের সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবো।

এমনিভাবে প্রতিবন্ধিত্বকে জয় করেছেন ইমাম হোসেন ও মোছা. সোনাই খাতুনও। ইমাম হোসেনের জন্ম যশোর সদর উপজেলার সারাকুল রূপদিয়া গ্রামে। তার বয়স যখন দুই মাস তখন হাম রোগে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারায়। পরে খুলনার খালিসপুরের গোয়ালখালী সরকারি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। ২০১৩ সালে মাগুরার এবিসি ব্লেইন্ড হোস্টেল থেকে এসএসসি পাস করেন। ২০১৫ সালে ঢাকা কলেজ থেকে পাস করেন এইচএসসি। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে অনার্স প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত। থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে। দুই ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে ইমাম হোসেন ৫ নম্বর। তার অন্য ভাইবোনরা কেউ প্রতিবন্ধী নয়।

ইমাম হোসেন বলেন, আমার বাবা একজন গরিব কৃষক। তার পক্ষে আমার পড়ালেখার খরচ বহন করা খুবই কষ্টসাধ্য। তবে আমার মনোবল দৃঢ় থাকার কারণে আমি এ পর্যন্ত আসতে  পেরেছি। হাইস্কুলে পড়াকালীন সব সময় ক্লাসে প্রথম হতাম। এটা দেখে গ্রামের সিরাজ মামা নামের এক লোক আমার পাশে দাঁড়ায়। তিনি ঢাকার বাংলামোটরে গার্মেন্টস সামগ্রীর ব্যবসা করেন। স্কুল লাইফ থেকে আমাকে সহযোগিতা করছেন, এখনও করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মাসে ২৫০০ টাকা করে ডাচ্‌ বাংলা ব্যাংকের (ডিবিবিএল) বৃত্তি পাচ্ছি। এর বাইরে পরীক্ষার ফিসসহ বিভিন্ন সময় টাকার প্রয়োজন হলে সিরাজ মামা সহযোগিতা করেন।

ভবিষ্যৎ স্বপ্ন জানতে চাইলে ইমাম হোসেন বলেন, আমি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার হতে চাই। শিক্ষা ক্যাডার হলে প্রজেক্টরের মাধ্যমে ক্লাস নিতে পারবো। প্রতিবন্ধীরা সাধারণত কম্পিউটারের যেসব  প্রোগ্রামের কাজ জানে আমিও সেসব প্রোগ্রামের কাজ করতে পারি।

সোনাই খাতুনের বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার ডাঁতপুর গ্রামে। ৪ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে সোনাই দ্বিতীয়। ভাইবোনদের মধ্যে এক বোন বোয়ালখালী সরকারি কলেজে অনার্স অধ্যয়নরত। এবং সোনাই বরিশালের সাগরদী সরকারি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে এখন পুরান ঢাকার বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে এইচএসসিতে পড়ালেখা করেন। কলেজের হলেই থাকেন।

সোনাই জানান, আমি বাড়িতে থাকাকালীন কারো সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। প্রাইমারিতে পড়াকালীন যোগাযোগের সুযোগ থাকলেও কোনোদিন কারো সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। সব সময় হীনমন্যতায় ভুগতাম। হাই স্কুলে থাকাকালীন আমার বাড়ির পাশের শিহাব উদ্দিন নামের এক প্রতিবন্ধী ছাত্রকে স্কাউটের জন্য নিতে যান খুলনার গোয়ালখালী স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ সামিরুল আলম। তখন আমার কথা জানতে পারেন ওই শিক্ষক। পরে আমাকেও তিনি নিয়ে তার স্কুলে ভর্তি করেন। পরে বরিশাল থেকে এসএসসি পাস করি।

ভবিষ্যৎ স্বপ্ন সম্পর্কে বলেন, এখনো নির্দিষ্ট না। তবে পড়ালেখা শিখে নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই।
 
আরশেদুল করিম, ইমাম হোসেন ও সোনাই খাতুনের মতো অনেক প্রতিবন্ধিই প্রতিদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় গ্রন্থাগারের সংশ্লিষ্ট কর্ণারে গিয়ে পড়ালেখা করেন ব্লেইন্ড পদ্ধতিতে। এমনকি অডিও বিজুয়াল সার্ভিসের মাধ্যমেও পড়ালেখা করেন। ভাগাভাগি করেন নিজেদের মধ্যে থাকা কষ্ট গাথা। একে অপরের বিভিন্ন ধরণের সমস্যায় সহযোগিতার হাত বাড়ান দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ভাগ্য বিড়ম্বিত এসব প্রতিবন্ধীরা।

সূত্র: মানবজমিন

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়