Friday, September 23

হাওরের নৈসর্গিক দৃশ্য মন কেড়ে নেয়


আমিনুল হক সাদী: আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল/বাতাসের আছে কিছু গন্ধ, রাত্রির গায়ে জ্বলে জোনাকী/তটিনীর বুকে মৃদু ছন্দ.......গাজী মাজহারুল আনোয়ারের এ গানের দৃশ্যটিই দেখা গেছে কিশোরগঞ্জের হাওরে। কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার চৌগাঙ্গার হাওরে বিকালের নৈসর্গিক এমন গানের দৃশ্য উপভোগ করছে প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা শত শত মানুষ। হাওর-বাঁওড় আর সমতলভূমির বৈচিত্রময় ভূ-প্রকৃতির বিস্তীর্ণ জনপদ কিশোরগঞ্জ। বৃহত্তর ভাটির দেশ বা ভাটি কন্যা বা রাজার দেশ হিসেবেও পরিচিত রয়েছে এ জেলার। সৌন্দর্য যদিও এ জেলার সর্বত্র, তবে প্রকৃতির এক অপরূপ মিলন ঘটেছে মূলত হাওর অঞ্চলগুলোতে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জ এ সাত জেলা মিলেই মূলত বাংলাদেশের হাওরাঞ্চল। এখানে ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে রয়েছে ৪২৩টি হাওর। তন্মধ্যে কিশোরগঞ্জেই রয়েছে ১২২টি হাওর। কিশোরগঞ্জের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো- এর একটি বিশাল এলাকা বছরের প্রায় ছয় মাস পানিতে ডুবে থাকে। কিশোরগঞ্জের ১৩টি উপজেলার মধ্যে মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, ইটনা ও নিকলী অধিক বন্যাপ্রবণ হাওর অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এ এলাকার বিশাল হাওর একদিকে যেমন মিঠাপানির বিশাল ভা-ার, তেমনই প্রচুর মৎস্য সম্পদে ভরপুর। হাজারো জীববৈচিত্রের পাখি, জলজ উদ্ভিদ ও মুক্তাসহ ঝিনুক রয়েছে হাওরের সর্বত্র। শীতকালে যে এলাকা শুকনো কিংবা খটখটে বালুচর, বর্ষাকালে সেখানে এমন জলধারা যে দিগন্ত বিস্তৃত চারদিক জলে থৈ থৈ করে। জলরাশিতে দ্বীপের মতো গুচ্ছগ্রামগুলো ভাসতে থাকে। বর্ষাকালে যে হাওরের পাগল করা ঢেউয়ের দোলায় শুষ্ক প্রান্তরগুলোও উত্তাল হয়ে ওঠে যেখানে শুকনো মৌসুমে পানি থাকে না একফোঁটাও। তখন যতদূর চোখ যায় শুধু বোরো ধানের শীষ বা সোনারাঙা ধানের সুবিপুল প্রশস্ত আঙিনা প্রাণকে করে উদ্বেলিত। শীতকালে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির আগমন হাওর অঞ্চলে নতুনভাবে প্রাণ সঞ্চার করে। বিশেষত বর্ষায় হাওর হয়ে যায় কূলহীন সাগরের মত। বিশাল জলরাশির বুকে বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোকে ছোট ছোট দ্বীপের মতো লাগে। দূর থেকে মনে হয়, কচুরিপানা হয়ে যেন পানিতে ভাসছে গ্রামগুলো। হাওরজুড়ে গলা ডুবিয়ে থাকা হিজল গাছের সারি মন কাড়ে যে কারও। পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা করচের বন, হাঁসের ডিমের মতো সাদা ফল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বরুণ গাছ, কিংবা গাঙ্গেয় মিঠাপানিতে শুশুকের লাফ-ঝাঁপ দেখলে বিনোদিত না হয়ে পারা যায় না। কবি আহমেদ তানভীর বলেন, রাতে হাওরের মাঝখানে ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় কুপিবাতি জ্বালিয়ে জেলেরা যখন জাল দিয়ে মাছ ধরে, দূর থেকে দেখে মনে হয় কারা যেন শত শত প্রদীপ জ্বালিয়ে হাওরের পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছে। রাতভর হাওরে ভেসে ভেসে জ্যোৎস্না উপভোগ করাটা আনন্দের বিষয়। অভিলাষী মনকে জ্যোৎস্নায় ঠাঁই দেয়ার এমন সুযোগ হাওর ছাড়া আর কোথায় আছে! হাওরে ট্রলারের ছাদে বসে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখাটাও সৌভাগ্য বটে। এখানে হিজল করচের মাথা ছুঁয়ে সূর্য যখন ডুবে, দিগন্তজুড়ে হাওরের পানি রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। বাউল শিল্পী ও কবি কফিল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সূর্যের লাল-সোনালি-হলুদ আলোর রশ্মি অপূর্ব রেখা ছড়িয়ে দেয় হাওরের পুরো আকাশজুড়ে। হাওরের সুন্দর দৃশ্যটি খুবই চমৎকার। ইটনার চৌগাঙ্গার হাওরে ভ্রমণে আসা হাবিবুর রহমান বিপ্লব বলেন, এখন বর্ষা চলছে। পানি ও বাতাসের সঙ্গে লড়াই করছেন হাওরবাসী। এ যুদ্ধক্ষেত্র একবার দেখে এলে মন্দ হবে না। তাড়াইলের মৃঘা হাওর দেখতে আসা শফিক কবীর ও ফারুকুজ্জমান বলেন, এ হাওরে একটি রাত ও একটি দিন কাটানো যেতেই পারে হাওরে। কাছে না এসে দেখলে হাওরে নৈসর্গিত রূপ বুঝাই যাবে না। হাওরপাড়ের বাসিন্দা ফরহাদ আহমেদ কেনেডি, জুয়েলুর রহমান জুয়েল, রতন মিয়া ও মোহাম্মদ শফিক বলেন, হাওরের উর্মিমালা ও আকাশ এক অপরূপ দৃশ্য। প্রতিদিন সূর্য অস্ত ও ডুবার দৃশ্য উপভোগের মজাই আলাদা। আবহাওয়া খারাপ না থাকলে ঢেউগুলো অতটা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে না। ২৪ ঘন্টার জন্য নৌকাই হতে পারে বাড়ি, নৌকাই হতে পারে ঘর। হাওরে নাওয়া, নৌকাতে খাওয়া। নৌকাতেই ঘুম। প্রতিদিনই আমাদের পানির সাথে যুদ্ধ করে চলতে হয়। হাওর অঞ্চলবাসী কিশোরগঞ্জের প্রধান সমন্বয়কারী মেহের উদ্দিন বলেন, হাওরের নৈসর্গিক দৃশ্য সম্বলিত স্থানগুলোকে পর্যটন কর্পোরেশন সংরক্ষিত করা হলে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। হাওরের ঝিনুক মুক্তাও হতে পারে জাতীয় অর্থনীতিতে এক সহায়ক শক্তি। হাওরবাসী ও হাওরের দর্শনার্থীরা কিশোরগঞ্জের নৈসর্গিক হাওরগুলোকে সংরক্ষিত করে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়েতোলার আহবান জানিয়েছেন।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়