ফয়ছল আহমদ:
আম্মাজান, আসসালামু আলাইকুম। কিতা খররায়, ভালা আছইন নি। হুনলাম তোমার শরীল ভালা নায়। এখন কিতা খবর ? খমছে নি। সামনর মাসও বাড়িত আইমু। তোমার লাগি কিতা আনতাম? এক নাগাড়ে প্রবাসে থাকা ছেলে কথাগুলো বলে যাচ্ছে। ও প্রান্ত থেকে মা টেপ রেকর্ডারে ছেলের পাঠানো ক্যাসেটে কথাগুলো শুনছেন, আর অঝুরে ফেলছেন চোখের পানি।
প্রবাসী অধ্যূষিত সিলেটে প্রবাসে থাকা আত্নীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি ও ক্যাসেট। আত্নীয়য়ের ক্যাসেট যখন ডাক পিয়ন বাড়িতে নিয়ে আসতো, ঐ বাড়িতে বয়ে যেত খুশির হাওয়া। আনন্দে বড় অংকের বখশিশ দেওয়া হতো ডাকপিয়নকে। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ার এখন আর ক্যাসেট আসে না। অপেক্ষা করতে হয় না ডাকপিয়নের।
আগেকার দিনে প্রবাসে থাকা আত্নীয় স্বজনদের জন্য যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি পত্র ও
ক্যাসেট। চিঠির মাধ্যমে লেখনি পৌছানো যেত কিন্তু প্রিয় স্বজনদের কণ্ঠ শুনার একমাত্র মাধ্যম ছিল
ক্যাসেট। আর ক্যাসেটের মাধ্যমে ফুটে উঠত দেশে ও প্রবাসে থাকা আত্নীয় স্বজনদের সুখ দুঃখের
চিত্র। কালের বিবর্তনে তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে এখন আর ক্যাসেট নেই। হারিয়ে গেছে এক
কালের স্বজনদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র এ বাহনটির। তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষে আগের মতো
ডাক পিয়নের ডাক শুনা যায় না। পোস্টমাস্টারের আসার অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না প্রবাসীর
বধূদের। মোবাইলের পর যোগ হয়েছে নানা ধরণের প্রযুক্তি। ওয়্ট্সাঅ্যাপস্, ইমু, ভাইবার,
ম্যাসেঞ্জারের এ যুগে পূর্বেকার ক্যাসেটের কথা শুনে অনেকের তা জানার আগ্রহ অতুলনীয়। কেউ
কেউ স্মৃতির আয়নায় আলস্যে রাখা ক্যাসেটটি খোঁজে নতুন করে প্রিয় জনের কণ্ঠ শুনে স্মৃতিকে
স্মরণ করেন। কেউ বা রেখেছেন অতীত দিনের স্মৃতি।
প্রবাসীর স্বামীরা নতুন বউকে উপহার দিতেন টেপরেকর্ডার ও ক্যাসেট। প্রবাসে থাকাকালীন নববধূরা টেপরেকর্ডারে স্বামীর কণ্ঠ শুনে শুনে রাত্রিতে বালিশে মাথা গুজতেন। আর প্রবাসে থাকা স্বামীও টেপরেকর্ডারে প্রেয়সীর কণ্ঠ শুনে শুনে কাটাতেন দিনের পর দিন। বাড়িতে থাকা বধূও টেপরেকর্ডার ছাড়া প্রিয় স্বামীর কণ্ঠ শুনার আর কোন মাধ্যম ছিল না।
শেখঘাট এলাকার বাসিন্দা রাজিয়া বেগম জানান, আমি ছোট বেলা থাকতে আমার মামার কাছে জায়গা কিনতে আমার নানী ক্যাসেট পাঠিয়ে ছিলেন। পাশের বাড়ির আমার আরেক নানা জায়গা বিক্রি করবেন তাই এই জায়গা আমার নানা কিনবেন। তিনি মামার কাছে একদিন ক্যাসেট পাঠানোর জন্য কথা রেকর্ড করলেন। তিনি মামাকে বললেন, মাস শেষে টাকা পাঠানোর জন্য। তোমার নামে কিছু জায়গা কিনব। আমার নানার একটি টেপরেকর্ডার ছিল। তিনি টেপরেকর্ডারের মধ্যে ক্যাসেট ডুকালেন। তারপর সামনে বসে কথাগুলো বললেন। রেকর্ড শেষে ক্যাসেটটি খুলে আরেক মামার সাতে বিদেশে পাঠিয়ে দিলেন। মামা ক্যাসেটটি পেয়ে তখন মোবাইল ফোন না থাকায় চিঠির মাধ্যমে টাকাসহ তার উত্তর পাঠালেন। পোস্ট মাস্টার নানা বাড়িতে এসে চিঠির খামটি দিলেন। নানা টিপসহি দিয়ে পোস্ট মাস্টারের কাছ থেকে চিঠিটি রাখছেন। শেষে টাকা গুলো ব্যাংকে গিয়ে তুলে জায়গা কিনলেন।
মোগলাবাজার এলাকার পিকলু পাল বলেন, আমার ছোট জ্যাটার কাছে আমাদের বাড়ির সবাই একসাথে বসে ক্যাসেট রেকর্ড করে জ্যাটার কাছে পাঠাতাম। সেটার মধ্যে আমরা সবাই এক এক করে জ্যাটাকে নমস্কার দিয়ে আমাদের পরিচয় দিয়ে কথা বলতাম এবং আমরা কেমন আছি ও তিনি কেমন আছেন তা বলতাম। ক্যাসেট পাঠানোর পর তিনি তা শুনে প্রতি উত্তরে ক্যাসেট পাঠাতেন। আমার বাড়ির সকলে মিলে টেপরেকর্ডারে ক্যাসেট শুনতাম।
মিডওয়াইফ সাহানা আক্তার বলেন, আমার ভাবী প্রবাসে থাকা ভাইয়ের সাথে ইমুতে কথা বলেন। ক্যাসেটের কথা আমরা শুনে অবাক হয়েছি। এখনকার দিনে ক্যাসেটের কথা শুনে ভাবীর কাছে পুরাতন প্রবাসের ক্যাসেটের কথা বললাম। ভাবী তার আলমারীতে রাখা একটি ক্যাসেট বের করে টেপরেকর্ডারে লাগালেন। কিন্তু হয়! ক্যাসেটটি অনেক দিনের পুরাতন হওয়ায় সেটি আর চলল না। তাই আমার প্রবাসী ক্যাসেট শুনা হল না।
জকিগঞ্জের সাধনা রানী নাথ বলেন, ক্যাসেটের কথা কল্পনাই করা যায় না। আমাদের আগেকার দিনের লোকজন প্রবাসে থাকা আতœীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগের জন্য ক্যাসেট ব্যবহার করতেন সেটা শুনে অবাক হয়েছি।
সূর্যের হাসি কিনিকের প্যারামেডিক শাহেরা বেগম বলেন, আমি একদিন আমার নানা বাড়িতে গিয়ে মামার কাছে ক্যাসেট পাঠানোর জন্য রেকর্ড করছেন। এমতাবস্থায় আমি টেপরেকর্ডারের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, আসসালামুআলাইকুম। তখন নানা-নানীরা ভাবছেন আমি প্রবাসে থাকা মামাকে সালাম করছি। কিন্তু আমি আমার নানা-নানীকে সালাম করেছিলাম।
জৈন্তাপুরের শিলা রানী পাল বলেন, আমার নতুন মেয়ের পর প্রবাসে থাকা স্বামীর কাছে ক্যাসেট পাঠানোর জন্য আমার স্বামী আমাকে একটি টেপ রেকর্ডার উপহার দিয়ে ছিলেন। তখনকার দিনে স্বামীর কাছে রেকর্ড করে ডাক যোগে ক্যাসেট পাঠাতাম। প্রবাসে থাকা স্বামী আমার ক্যাসেট শুনে তিনিও ক্যাসেট রেকর্ড করে পাঠাতেম। টেপরেকর্ডারে স্বামীর কণ্ঠ শুনে অঝোরে ঝরতো চোখের পানি। এক ক্যাসেট পাঠানোর পর প্রতি উত্তর আসতে দেড় থেকে দুই মাস সময় লেগে যেত।
জকিগঞ্জের ফাতেহা বেগম বলেন, আমার বিয়ের পর আমার স্বামী আমাকে একটি টেপরেকর্ডার ও দশটি ক্যাসেট উপহার দিয়ে ছিলেন। আজ অনেক দিন পরও স্বামীর উপহার টেপরেকর্ডারটি যতনে রেখেছি।
গোলাপগঞ্জের হুসন মিয়া বলেন, আমার বড় ছেলের ১৪ বছর বয়সে সৌদি আরব পাঠাই। তার সাথে আমাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি আর ক্যাসেট। আমার একমাত্র সন্তান এর কথা শুনার জন্য আমরা চিঠির চাইতে ক্যাসেট বেশি পাঠাতাম। সেও সেখান থেকে ক্যাসেট পাঠাতো। একদিন তার নানী মারা গেলেন। সে ছিল তার নানীর খুব আদরের। নানী মারা যাওয়ার পর দিনই মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে আমরা ডাকডোগে ক্যাসেট পাঠালাম। সেই ক্যাসেট তার কাছে পৌছিতে পৌছিতে দেড় মাসের বেশি সময় লেগে গেল। সে ক্যাসেট টে পেয়ে তার নানীর মৃত্যু সংবাদের খবর শুনে বাড়িতে আসার বিমান ধরল। সে বাড়িতে এসে তার নানীর জন্য খুবই কান্নাকাটি করল। এখানকার যুগের মতো যদি মোবাইল ফোন থাকতো তবে সাথে সাথে তার মৃত্যু সংবাদটি জানানো যেতে।
দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা ফারুক আহমদ বলেন, প্রবাসে থাকাকালীন দেশে থাকা আতœীয় স্বজনদের কণ্ঠ ক্যাসেটে শুনে শান্তনা পেতাম। তখন আমার প্রথম সন্তান পৃথিবীর আলোর মুখ দেখল। এর দ;ুই মাস পর আমার স্ত্রীর পাঠানোর ক্যাসেটের মাধ্যমে আমি খবরটি পেলাম।
খবর বিভাগঃ
ফিচার
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়