জিবলু রহমান ::
প্রতিদিনকার জীবনের চলার পথে কত অভিজ্ঞতা, বকাঁঝোকা আর টেনশনের মধ্যে কাটাতে হয়। পরিবারের সবাইকে মানিয়ে চলে আবার কারো ভুলকে এবাউট করে বাবা-মা’র শাসানোর প্রক্রিয়া থেকে একান্ত আপনজনকে বাঁচানোর জন্য নিজের ঘাড়ে দোষ তুলে নেয়া-এ রকম হাজারো ঘটনা আমাদের সমাজে বিদ্যমান। কেউ এ গুলোকে স্বীকার করে নেন, কেউবা করেন না।
সমাজের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারলেইতো আমরা শিখবো-শুধাবো। আরমানউজ্জামান পেশায় ব্যাংকার। ব্যাংকের লোক নাকি কৃপণ হয়। মন-মানুষিকতা হিসাবের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। ব্যাতিক্রম লক্ষ্য করলাম আরমানউজ্জামান-এর বেলায়। নিজ পেশার সচেতনাতাকে ডিঙিয়ে তিনি ২০১৬ সালের বই বেলায় প্রকাশিত ‘বুকের অদূরে প্রেম’ গ্রন্থে এমন সব বিষয় লিখনীর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন যা পড়লে মনে হয় তার শয়নে-স্বপনে-নিরবে-নিশিতে শুধু সাহিত্য চর্চা-সমাজ নিয়ে ভাবনা। অবশ্য বই রচনা এটা নতুন নয়। এর আগে আরো বই প্রকাশিত হয়েছে।
মাত্র বছর ৪০ আগে, অতীত সভ্যতার ধারক ও বাহক ছিল বই। সূদূর অতীতে মেসোপোটিয়ার সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা ব্যাবলিনীয় সভ্যতা বা সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বইকে কন্দ্রে করে। ফলে সেখানে গড়ে উঠেছে বড় বড় গ্রন্থাগার। ধন-সম্পদ দিয়ে কোনদিনই কোন জাতীর সভ্যতা নির্ণিত হয়নি। কোন জাতীকে ধ্বংস করতে চাইলে প্রথমে ধ্বংস করা হয় সেই দেশের গ্রন্থাগারকে।
বৃটিশ মিউজিয়ামের পাঠকক্ষে কয়েকটি কথা লিখা আছে ‘যে দ্রব্যটি তুমি ধরে আছো তাকে যত্ন করঃ ও সোনার চেয়েও দামি। যদি বই না থাকে তাহলে সভ্যতা টুকরো হয়ে যাবে। এ এমন একসেতু বন্ধন যা আমাদেরকে বর্বরতা থেকে জ্ঞানী, নৈরাজ্য থেকে সরকারে, বিদ্রোহ থেকে স্বাধীনতা উর্ত্তীণ করেছে। একে ছাড়লে আমরা সেই উৎসাহ-ই হারিয়ে ফেলবো যা মানুষকে মহৎ কর্মে নিত্য প্রণিত করে।’ টলষ্টয় বলেছেন, জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন; বই বই বই।
ম্যাস্কিম গোর্কি বই সম্পর্কে মন্তব্য করলেন এভাবে-আমার মধ্যে উত্তম বলে কিছু যদি থাকে তার জন্য আমি বইয়ের কাছে ঋণী।’
আর শরৎচন্দ্র বলেছেন,‘বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখ কষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।’
জন লিলি‘বই বিহীন কক্ষকে আত্মা বিহীন দেহের সাথে তুলনা করেছেন।’
‘বুকের অদূরে প্রেম’ গ্রন্থের উৎসর্গ কিন্তু বেশ বৈচিত্রময়। বড় আপু, চতুর্থ ভাই এবং ছোট আপুর প্রতি লেখক আরমানউজ্জামান- এর যে হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধাবোধ তা প্রকাশিত হয়েছে। গর্ব করার মতো সজ্জন পরিবারের অংশ না হলে তিনি এতো সামাজিক হতে পারতেন না। কারণ পরিবারই আমাদের প্রথম পাঠশালা। পরিবার সামাজিক জীবনের প্রাথমিক ইউনিট। পরিবারের কাঠামোর মধ্যেই মানুষ খুঁজে পায় নির্ভরতা, নিরাপত্তা, স্নেহ, প্রেম-প্রীতি ও ভালোবাসা।
প্রতিদিনের সংবাদপত্র বা মিডিয়ায় চোখ বুলালে অনুভব করা যায়, দেশে বেকারের মিছিল একদিকে যেমন দীর্ঘ হচ্ছে, তেমনি দক্ষতার সংকটও প্রকট। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে পে-অর্ডারসহ চাকরির দরখাস্ত করার খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন কর্মহীন যুবক বয়সীরা। অধিকাংশ আবেদনই তাদের জন্য কোনো সুখবর আনতে পারছে না। অন্যদিকে দরখাস্তের স্তুপ থেকে ‘যোগ্য প্রার্থী’ খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হচ্ছেন নিয়োগকারীরা। তাঁরা বলছেন, ডিগ্রী থাকলেও প্রকৃত দক্ষ আবেদনকারীর সংখ্যা নগন্য।
চাকরির জন্য বেকাররা প্রতিবছর কত টাকার পে-অর্ডার, ট্রেজারি চালান বা পোস্টাল অর্ডার করছেন তার সমন্বিত কোন হিসাব কারো কাছে নেই। ব্যাংকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত যেসব পে-অর্ডার হয় তার প্রায় সবই করেন চাকরি প্রার্থীরা। বিসিএস ক্যাডার বা নন ক্যাডার পদের জন্য আবেদনপত্র নেওয়ার সময় দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় প্রতিদিন গড়ে ৮০০ প্রার্থী চাকরির জন্য পে-অর্ডার করেন।
সদ্য পাস করা এসব শিক্ষিত বেকারের মধ্যে হতাশার ছাপ আরো বেশি। খেয়ে-না খেয়ে, ধারদেনা করে চাকরির বিজ্ঞাপনদাতার শর্ত অনুযায়ী পে-অর্ডার, ট্রেজারি চালান বা পোস্টাল অর্ডারের খরচ যোগাড় করা সম্ভব হলেও চাহিদা অনুযায়ী ‘অভিজ্ঞতা’ না থাকায় চাকরি পান না তাঁরা। বেশিরভাগ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির বিজ্ঞপ্তিতেই চাওয়া হয় অভিজ্ঞতা। অথচ চাকরি দাতাদের চাহিদার এই অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। উল্টো অভিজ্ঞতার কাছে হার মানে শিক্ষাগত যোগ্যতা। অনেক বিজ্ঞাপনেই লেখা থাকে ‘অভিজ্ঞদের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিলযোগ্য।’ কিন্তু উচ্চ শিক্ষিতদের জন্য অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিল করা হচ্ছে না।
যে পরিবারে আয়-রোজগার করার লোক বেশি থাকে, সেই পরিবারের পক্ষে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত থাকার সম্ভাবনা বেশি। এ কথা বোঝার জন্য খুব বেশি জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। একই আকারের দুটি পরিবারের মধ্যে যে পরিবারের সমপর্যায়ে আয় করার লোক বেশি থাকে সেই পরিবারটি তুলনামূলকভাবে সচ্ছল হয়।
‘বুকের অদূরে প্রেম’ গ্রন্থের প্রথম গল্প চাকরির ইন্টারভিউ কার্ডের কর্তন সংক্রান্ত। এ মামা-চাচার বা অদৃশ্য বড় ভাইয়ের হস্তক্ষেপের জোর না থাকলে এ বাজারে চাকরির প্রত্যাশা ডুমুরের ফুলই বলা চলে। বেকার যুবক, মাথায় সবসময় সকলের চিন্তা থাকলেও এ বাজারে কি করবেন? তবে চিন্তায় চিন্তায় তিনি ‘হীরক রাজার দেশে’র রাজার মতো আবার মাথা কিছুটা খারাপ করে ফেলেবেন নাতো।
হতাশার বাজারে কিভাবে সকলকে নিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে হাসিমুখে পরিবারে থাকা যায় তা জানতে পড়তে হবে ‘বুকের অদূরে প্রেম’ গ্রন্থের প্রথম গল্প। গল্পের মূল নায়ক প্লাবন। টিউশনির টাকা দিয়ে পড়াশুনার ব্যয় নির্বাহ করেছে সে।
প্লাবন, সকলকে নিয়ে চলার স্পৃহা কাজ করতো মাথায় সর্বসমময়। তাইতো ছোট বোন তুলির ইন্টারভিউ কার্ডের সঠিক সময় না পৌঁছানোকে ‘ছেলেবেলায় এরকম ঘটে’ মনোভাব পোষণ করে মেনে নিয়েছিলো। তুলি ছোট মানুষ। সঠিক সময়ে ইন্টারভিউ কার্ডটি ভাই প্লাবনকে দিতে ভুলে গেছে। এটা তুলির ইচ্ছাকৃত দোষ নয়, বিভিন্ন করণে হয়তো সে ভুলে গেছে। যখন মনে পড়েছে তখন ইন্টারভিউ কার্ডের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে গেছে, সময় কবেই পেরিয়ে গিয়েছিল। তাই বোনকে সে বলেছিল ইন্টারভিউ কার্ডের তিরোধান তথা ছিঁড়ে ফেলার জন্য। একটা চাকুরের ভীষণ প্রয়োজন ছিল প্লাবনের, তাই বলে ছোট বোনের ভুলে যাওয়াকে সে গুরুত্ব দেয়নি। উস্কানী দিয়ে ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথের মতো বলেনি, ‘সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না।’
প্লাবন স্বাভাবিক নিয়মে বিষয়টি হ্যান্ডেল করেছে। না হলে পারিবারিক বিভিন্ন কটুবাক্য সবসময় তুলির মাথার উপর বৃষ্টির মতো বর্ষিত হতে থাকতো। আরমানউজ্জামান-নিজ বৃদ্ধির বলয়ে ঘটনাটির অন্যমাত্রা দিয়েছে। প্লাবন-তুলির ভূমিকা দুই নয়ন-তিন নয়ন বা ভিন্ন কোন উপমায় সাজানো হয়নি। এখানে পরিবারের শান্তির জন্য নিজের ক্ষতি হলেই সমঝোতার জন্য চুপ থাকা উত্তম ভূমিকাটি ফুটে উঠেছে।
আরমানউজ্জামান-এর দ্বিতীয় গল্প প্লাবনের মামাতো বোন শিলার বইয়ে প্রতি অনুরাগ ও ‘সাহিত্য রস’ নামক একটি পত্রিকার প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে। তবে এ গল্পে অনেক আবেগ ও বাস্তবতা রয়েছে। এই জীবনে কত মানুষইতো আমরা দেখি। কত মানুষের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটল, ঘটছে, আরো ঘটবে। কত মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠতা হলো। ঘনিষ্ঠতা হবার পর কিছু মানুষের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়; মানে ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আবার কোনো মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠতা হবার পর শেষমেষ একটা তিক্ত পরিসমাপ্তি ঘটে।
ছোট্ট এই জীবনে কত মানুষইতো আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেল। সে যে গেল আর ফিরে এলো না। হারিয়ে গেল সারাজীবনের তরে। এখনো তাদের কথা মনে হলে বুক ধুকপুক করে ওঠে। চোখের কোণায় চিকচিক করে অশ্র“রাশি। কতক মানুষের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়। কারো কারো সাথে সারাজীবনে একবারও দেখা হয় না। কিছু মানুষ এমনও আছে, যাদের সাথে সারাজীবনের তরে মাত্র একটিবার দেখা করার জন্য আমরা মুখিয়ে থাকি। কই সে সমস্ত মানুষের সাথে আমাদের আর দেখাই হয় না। এমনও তো হতে পারে, অনেককে আমরা দেখি; কিন্তু সময় এবং বয়সের হাত ধরে সে মানুষের পুরো অবয়বে এত বেশি পরিবর্তন সূচিত হয়েছে যে তাকে আমরা চিনতেই পারি না। অথচ এক সময় সেই মানুষটিই কতই না প্রিয় ছিল আমার বা আপনার!
এ রকই আবেগময় বাস্তবতা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শাহনেওয়াজ শিমুল-এর জীবনে। শাহনেওয়াজ শিমুল শিলার মধ্যে তার ছোট বোন অদিতিকে খুঁজে পেয়েছিলেন। শাহনেওয়াজ শিমুলের ছদ্দ নাম ‘অয়ন।’ ছোট বোনের প্রতি তার অফুরন্ত ভালোবাসা প্রকাশ করেছেন ‘সাহিত্য রস’ পত্রিকার মাধ্যমে। তিনিতো জানতেন না দুঃসংবাদ যেমন বাতাসের আগে যায় তেমনি মনের গভীর থেকে প্রকাশিত আওয়াজও সঠিক গন্তেব্যে পৌঁছায় ঠিকই। এ যেন ক্রিকেট খেলার ‘লাগলে বারি বাউন্ডারী’-মতো। শাহনেওয়াজ শিমুল-এর আবেগী কথার মর্ম বের করতে শিলার সময়ে বেশি ক্ষয় হয়নি। কারণ শাহনেওয়াজ শিমুল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকবার শিলাকে তার বোনের মতো দেখতে হুবহু মিল রয়েছে-এমন মনোভাব প্রকাশ করেছিল। শিলা তার সাংবাদিকতাকে প্রথমে উপহাস করেছিল ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে একটি প্যাকট শাহনেওয়াজ শিমুল সম্পর্কে তার ধারণার ছন্দপতন করেছিল।
অয়নের বিভিন্ন লেখা শিলাকে মোহিত করেছে। বিশেষ করে প্রদত্ত প্যাকেট উদ্বেলিত করেছে অয়নের দুঃখকে ভাগ করে নেয়ার জন্য। মন চাইলেইতো সব সময় ইচ্ছার প্রতিফলন হয় না। তাই বলে কলমতো আটকে থাকে না। চেষ্টাতো বন্ধ করা যায় না।
শিলাও শাহনেওয়াজ শিমুল বা অয়নের ভালোবাসার জবাবে ‘প্রিয় অয়ন ভাইয়া’ সম্ভোধন করে লিখতে বসলো জীবনের প্রথম চিঠি। চিঠিতে যেন নয়, সাগর আর মহাসাগরের পানির জোয়ার। আবেগ আর ভালবোসা চলমান পানির স্রোতের মতো-মাপার কোন যন্ত্র নেই। শিলা নিজেও যে ভালোবাসার কাঙ্গাল তা এক ভাইকে লেখা চিঠির মাধ্যমে প্রকাশ্যে আনলো। নাতিদীর্ঘ চিঠির শেষাংশে শিলা নয়নকে তার ছোট বোন অদিতির জায়গায় কিছুটা স্থান দেয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করেছিল।
মানুষ কত কিছুকেই তো ভালোবাসে। যেমন ধরুন, একটি বাগানে সুন্দর একটি ফুল ফোটে রয়েছে। সকলেই সে ফুলের দিকে তাকিয়ে তার সৌন্দর্য উপভোগ করবে। পাশ দিয়ে যেতে পথিক সে সুন্দর ফুলটির দিকে একটিবারের জন্য হলেও চেয়ে দেখে নেয়। তাকিয়ে থাকবে মুহূর্তের তরে হলেও। অনেকে আবার ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যায় ভালোবাসার মানুষটিকে দিবে বলে। ফুল হাতে পেয়ে প্রিয় মানুষটির মুখে হাসি ফুটে উঠে। ফুলতো চিরন্তর ভালোবাসারই প্রতীক। তাইতো মানুষ জন্মদিনে, বিবাহবার্ষিকীতে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে থাকে। অনেকে আবার পশুপাখিকে ভালোবাসে। তবে মজার ব্যাপার হলো, যে মানুষটি বিড়াল পোষে সে-ই আবার মানুষের সাথে খারাপ আচরণ করে বসে। মানুষকে সে গালি দেয়, অথচ পশুর সাথে বসবাস করে। একদিকে মানুষকে গুলী করে মারে, অন্যদিকে মানবসেবায় সে অন্তপ্রাণ হয়ে উঠে। সমাজসেবক হিসেবে প্রমাণ দিতে তার কী প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। এ রকম ভালোবাসার কোনোই দরকার নেই। এ যেন ফুটে থাকা বাগানের গন্ধহীন ফুলটির মতোই।
যে ভালোবাসা মানুষকে সত্যিকারার্থে মহৎ মানুষে পরিণত করতে পারে না সে ভালোবাসাতো অর্থহীন। এটি ভালোবাসার নামে ফাঁকা বুলি আওড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়। ভালোবাসা হলো শুধুই ভালোবাসা। এটি হওয়া উচিত খাদহীন স্বর্ণের মতো। শিলা ও শাহনেওয়াজ শিমুল বা অয়নের ভালোবাসা ছিল খাদহীন স্বর্ণের মতো। এ ধরনের নিখুঁত চিত্র তুলে ধরেছেন লেখক আরমানউজ্জামান।
আরমানউজ্জামান লেখার ধারাবাহিকতায় আরো চমক এসেছেন। রহস্য নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। ‘বুকের অদূরে প্রেম’ গ্রন্থ পড়তে পড়তে আবিস্কার করলাম, শিলার ভাগ্যকাশ্যে আচমকা চাকুরি জুটেছে। হটাৎ প্রাপ্তি। শিক্ষিকা হলো শিলা। বাচ্চাদের সাথে বসবাস। তার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন ক্লাস, ভাই অয়নের বিভিন্ন কাজের পরামর্শদাতা এবং অংশীদ্বার হওয়া-সব মিলিয়ে ব্যস্ত এক মানবী শিলা। এর মধ্যে অয়নের বন্ধুদের আড্ডায় আমন্ত্রিত হয়ে শিলার উপস্থিতি ও সামাজিক কিছু কাজে অংশগ্রহণের ইচ্ছা সকলকে উচ্ছ্বসিত করলো।
দুঃসহ যন্ত্রণা আর শারীরিক কষ্ট লাঘবের আশায় চিকিৎসা সেবার পেছনে ছুটতে গিয়ে অর্থ বিত্ত আর সময় যারা ব্যয় করেন তাদের নিয়ে শিলাদের ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন- লেখকের চিন্তায়। বাহ! কি চিন্তার খোরাক।
আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত একের পর এক ভুল চিকিৎসার খেসারতের পাল্লাটাও ভারী হয়ে উঠছেই। আর রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লে সঠিক সময়ে রক্ত দেয়া যায়নি তাই বাঁচানো গেল না বলে ডাক্তারদের মুখস্ত বুলি প্রতিনিয়ত শুনতে হয়। এর বিকল্প কি? আরমানউজ্জামান তুলে ধরেছেন বিকল্প সামাজিক কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি।
সময়ের প্রয়োজন অনেক দৃশ্যপটের সৃষ্টি করে। সূত্রে না মিললেও তা মেনে নিতে হয়। অনেক সময় এর ভেতরেই খুঁজে পাওয়া যায় কল্যাণ। চীনা প্রবাদে রয়েছে-প্রাণী হিসেবে ‘সাপ হয়ে থাকে প্রতিশোধপরায়ণ। কুকুর হয়ে থাকে প্রভুভক্ত। ঘোড়া প্রতিনিধিত্ব করে উদ্যমতার। গরু প্রতিনিধিত্ব করে পরিশ্রমের। বাঘ প্রতিনিধিত্ব করে সাহসিকতার। খরগোশ প্রতিনিধিত্ব করে সতর্কতার। মানুষ প্রতিনিধিত্ব করে মানবতার।
কোনো জাতির সব ব্যাপারে স্ট্যান্ডার্ড বা মান তৈরি খুব জরুরি। তার শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, পাবলিক সার্ভিস-সবকিছুরই একটা ন্যূনতম মান নির্দিষ্ট থাকতে হবে। মনে হয় আ ধরনের চিন্তা থেকে আরমানউজ্জামান ‘ইচ্ছেরা ভবঘুরে আতœপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
অয়ন-শিলাদের সামজিক সংগঠন ‘ইচ্ছেরা ভবঘুরে।’ অয়নের নেতৃত্বে সবাই মিলিতভাবে সেচ্ছায় রক্ত দান কর্মসূচি, শীতবস্ত্র প্রদান, বিভিন্ন হাসপাতালের অসুস্থ মানুষগুলোর সমস্যা সমাধানের উপায় নির্ধারণের জন্য কর্মসূচি হাতে নিলো। সহজভাবে মানবাধিকার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেকেই বলে থাকেন, ‘যেকোনো ধরনের ভয় থেকে মুক্ত থাকাই হচ্ছে মানবাধিকার।’ আমাদের অসহায় মানুষগুলো তার দৈনন্দিন সমস্যাগুলো কোথায় গেলে সমাধান পাবে বা কারা করবে এনিয়ে চিন্তিত থাকে। লংঘিত হয় তাদের মানবাধিকার।
বলা নিষ্প্রয়োজন যে দ্ব›দ্ধ পৃথিবীর প্রায় সব সমাজেই লক্ষণীয়। বিরাজমান বিভিন্ন দল, গোষ্ঠীর চাহিদা, স্বার্থ ও মূল্যবোধের অসামঞ্জস্যতা দ্ব›েদ্ধর প্রকাশ ঘটায়। দ্ব›দ্ধ-সংঘাত সংকটে রূপ নিতে পারে। যার নেতিবাচক প্রভাব পুরো সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পড়ে ও জাতীয় সংহতি বিনষ্ট করে দেয়। এ রোগের উপসর্গ হিসেবে সহিংসতার প্রকাশ ঘটে, যার সমাধান নির্ভর করে কীভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় দ্ব›দ্ধ নিরসনের উদ্যোগ গৃহীত হয়, তার ওপর। দ্ব›দ্ধ-সংঘাতের মূল উৎপাটনে ক্রিয়াশীল ও কার্যকরী উপাদানগুলোকে শক্তিশালীকরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ উল্লেখযোগ্য। এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞ অংশগ্রহণমূলক মেকানিজম জরুরি বলে বিবেচিত।
আমাদের সকল প্রকার কুৎসিত মনোভাব ত্যাগ করে সকলের প্রতি ভালোবাসার বন্ধন অটুট রাখতে হবে। ‘ইচ্ছেরা ভবঘুরে’ সমাজের সকল স্তরে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে আরমানউজ্জামান-এর ‘বুকের অদূরে প্রেম’ গ্রন্থের সার্থকতা মিলবে।
খবর বিভাগঃ
মতামত
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়