Sunday, May 22

ব্রিটেনে বাংলাদেশের মুখ সিলেটের রুশনারা


শামছুল হক রাসেল :: বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করেছে যে কজন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। এমনকি ২০১১ সালে ব্রিটেনের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পত্রিকা নিউ স্টেটসম্যান ‘পার্লামেন্টের উদীয়মান তারকা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেখানে অনূর্ধ্ব ৪০ বয়সের ২০ জন এমপির তালিকা দিয়ে বলা হয়, তাদের মধ্য থেকে অনেকেই ব্রিটেনের মন্ত্রিসভায় স্থান করে নেবেন এবং বেরিয়ে আসবে ব্রিটেনের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী। যার কথা বলছি তিনি আর কেউ নন— রুশনারা আলী এমপি। গত কয়েক বছরে ব্রিটেনের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ নারী। লেবার পার্টি থেকে দুই দুই বারের নির্বাচিত এই এমপি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এ অবস্থান তৈরি করেছেন। ২০১০ সালে বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো থেকে নির্বাচিত প্রথম বাংলাদেশি এমপি এবং নির্বাচিত প্রথম তিনজন মুসলিম মহিলা এমপির অন্যতম রুশনারা আলী। এমনকি হয়েছেন লেবার দলের ছায়া শিক্ষামন্ত্রী। আবার এই ছায়া মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে হৈচৈ ফেলে দেন গোটা ব্রিটেনে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালের মে মাসে ফের নির্বাচিত হন তিনি। সম্প্রতি বাংলাদেশের বাণিজ্য দূত হিসেবে নিয়োগ পান রুশনারা আলী। দেশটির ক্রস পার্টি বাণিজ্য দূত হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন তাকে এই দায়িত্বে নিয়োগ দেন। রুশনারা আলীর এই পথচলা খুব মসৃণ ছিল না। ছিল কণ্টকাকীর্ণ। এ দীর্ঘপথ জানতে একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে— ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের সিলেট জেলার বিশ্বনাথে জন্ম নেন রুশনারা আলী। মাত্র সাত বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে লন্ডনের পূর্ব প্রান্তে অভিবাসিত হন। সেখানে তিনি মালবেরি স্কুলস অব গার্লস ও টাওয়ার হ্যামলেট কলেজে শিক্ষা লাভ করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জনস কলেজে তিনি দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেন। এরপর মাইকেল ইয়ং-এর গবেষণা সহকারী হিসেবে তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন ও টাওয়ার হ্যামলেটস সামার বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সংস্কার প্রজেক্টের কাজ করেন। যেখানে মুক্ত শিক্ষার কর্মসূচি চালু আছে ১১ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের জন্য। ভাষা সংযোগের উন্নতির জন্য তিনি কাজ করেন যা একটি জাতীয় দূরালাপনী ব্যাখ্যাকারী কর্মকাণ্ড যেখানে ১০০টির মতো ভাষায় এটা করা হয়। ১৯৯৭-৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি সংসদ সহকারী ছিলেন সংসদ সদস্য ওনা কিং-ইয়ের যিনি বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বোর জন্য মনোনীত ছিলেন। এ ছাড়া মানবাধিকার বিষয়ে তিনি বিদেশি কার্যালয়ে কাজ করেন ২০০০-০১ সাল পর্যন্ত। এর আগে রুশনারা একজন গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন আইপিপিআরে। বার্নলে, ওল্ডহ্যাম ও ব্র্যাড ফোর্ডে ২০০১ সালের দাঙ্গার ফলে স্থানীয় ও জাতীয় মাধ্যমকে গতিশীল করতে একটি কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দেন তিনি। এটা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল ২০০২-০৫ সাল পর্যন্ত হোম অফিসের কমিউনিটিস ডাইরেক্টরেট হিসেবে কাজ করে। এটা করা হয়েছিল যাতে আর কোনো রকম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি না হয়। রুশনারা আলী বেথনাল গ্রিনে অবস্থিত ইয়ং ফাউন্ডেশনের সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই ফাউন্ডেশনে তাদের তুলে ধরা হয়। যারা নতুন ধরনের সামাজিক বিষয়ে আলোকপাত করেন। তিনি একই সঙ্গে টাওয়ার হ্যামলেটস সামার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সদস্য, একজন কমিশনার লন্ডন শিশু দারিদ্র্য কমিশনের, বোর্ড সদস্য টাওয়ার হ্যামলেট কলেজের, পল হ্যামলাইন ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি ও টেট ব্রিটেন কাউন্সিলের সদস্য। দ্য গার্ডিয়ান, প্রোসপেক্ট ও প্রোগ্রেস ম্যাগাজিনে তিনি জাতীয় ও স্থানীয় নানা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। এ ছাড়াও রুশনারা কোয়েশ্চন টামি এক্সট্রা, বিবিসি রেডিও ৪-এর উইমেন্স আওয়ার এবং থিঙ্কিং অ্যালোডে উপস্থিত হন। দ্য গার্ডিয়ানের মতে তিনি ব্রিটেনের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মহিলাদের একজন। ২০০৭ সালে শুরু হয় রুশনারার ক্যারিয়ারর টার্নিং পয়েন্ট। ওই বছরের এপ্রিলে লেবার পার্টির পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো এলাকার জন্য নির্বাচিত হন তিনি। ২০১০ সালের ৬ মে তিনি হাউস অব কমনসে নির্বাচিত প্রথম বাংলাদেশি এবং নির্বাচিত প্রথম তিনজন মুসলিম মহিলা এমপির অন্যতম। তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে পাওয়া যায় টানটান উত্তেজনা। এ ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। পদত্যাগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, কোয়ালিশন ফ্রন্ট আইএসের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তা তিনি মেনে নিতে পারেন না। তিনি মনে করেন, যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। বরং এ ধরনের যুদ্ধ আরও রক্তাক্ত আগামী তৈরি করবে। তবে রুশনারা তার দলের প্রধানের জন্য পদত্যাগপত্রে শুভ কামনা করেন। রুশনারা আলী ব্রিটেনের বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। এই এলাকায় একনাগাড়ে দীর্ঘ ৪০ বছর সংসদ সদস্য ছিলেন লেবার দলের পিটার শো। তিনি বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। অনেক বাংলাদেশি তার বন্ধুও ছিলেন। তিনি যুদ্ধবিরোধী একজন নেতা। বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসন মূলত বাঙালি ভোটার-অধ্যুষিত এলাকা। রুশনারা আলীর আগে লেবার ও কনজারভেটিভ, কোনো দলই এ আসনে বাঙালি প্রার্থী মনোনয়ন দেয়নি। পিটার শোর পরে লেবার দল মনোনয়ন দেয় ওনা কিংকে। তিনিও বাংলাদেশিদের ভোটে নির্বাচিত হন। ইরাক যুদ্ধের সময় টনি ব্লেয়ারকে সমর্থন দিলেও তার আসনের ভোটাররা এর বিরুদ্ধে ছিলেন। আর রুশনারা আলী ছিলেন যুদ্ধের বিরুদ্ধে। সব সময় ছিলেন শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বলীয়ান। তাই বেথনাল গ্রিন বোর আদিবাসীরাও তাকে সানন্দে বেছে নিয়েছেন। দৃপ্ত করেছেন রুশনারার এ রাজনৈতিক পথচলা। নিজ এলাকার ভোটার এবং বাংলাদেশের নাগরিকদের কথা বিবেচনা করে বেশকিছু সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশ নেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— ব্রিটেনে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে রুশনারার বিশেষ পিটিশন। ব্রিটেন সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে ২০১৩ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ২৫ হাজারেরও বেশি লোকের স্বাক্ষর সংবলিত একটি পিটিশন জমা দেন তিনি। ব্রিটিশ ব্যাংক বার্কলেস সেই সময় এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যাংকিং সেবা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে এগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রবাসীরা নিজেদের দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন। পিটিশন জমা দেওয়ার সময় ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে অনেক সোমালিয়ান ও বাংলাদেশি বিক্ষোভ করেন। তারা জানান, আড়াইশর মতো এজেন্সি বন্ধ হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ব্রিটিশ ব্যাংক বার্কলেস ব্যাংকিং সেবা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতেতে রুশনারা আলী ২৫ হাজারেরও বেশি লোকের স্বাক্ষর সংগ্রহের পর একটি পিটিশন জমা দেন। তার এই উদ্যোগ গোটা ব্রিটেনে হইচই ফেলে দিয়েছিল। ব্যক্তিত্ব হিসেবে রুশনারার গ্রহণযোগ্যতা ঈর্ষণীয়। নিজ দল লেবার পার্টি এবং কনজারভেটিভ পার্টির নেতাদের কাছেও তার অবস্থান অন্যরকম। সবাই তাকে আলাদা ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবে জানেন। অন্যায়ের সঙ্গে কখনো আপস করেননি রুশনারা। তাই তো বহমান তার রাজনৈতিক পথচলা। সিলেটভিউ২৪ডটকম/

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়