Thursday, May 5

চুড়ি বিক্রেতা রামু এখন যুগ্ম সচিব, আকাশ ছোঁয়ার গল্প

চুড়ি বিক্রেতা রামু এখন যুগ্ম সচিব, আকাশ ছোঁয়ার গল্প

কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক: যারা দরিদ্রতাকে জয় করতে চায়, শত বাধা টপকে এগিয়ে যেতে চায়। তাদের অনন্য জন্য অনন্য উদাহরণ একসময়ের প্রতিবন্ধি ও চুড়িওয়ালা রমেশ গোলাপ। কঠোর পরিশ্রম ক্ষমতা ও একাগ্রতা থাকলে, কোনও কিছুই যে অসম্ভব নয়, দেখিয়ে দিয়েছেন সেই রামু। যিনি এখন আইএএস রমেশ।

রমেশ গোলাপ যদিও গ্রামের মানুষের কাছে আজও স্নেহের রামু। যার বাড়ি ভারতের মহারাষ্ট্রের সোলাপুরের অখ্যাত এক গ্রাম মহাগোয়ানে। ছোট থেকেই অসম্ভব মেধাবী। অভাবী ঘরের মেধাবী ছাত্ররা যেমন হয়ে থাকে আর কী।

আগে বাবার একটা সাইকেল সারানোর ছোটখাটো দোকান ছিল। সেখান থেকে যা আয় হত, তাতে চার জনের সংসার ভালোভাবে চলে যাওয়ার সমস্যা ছিল না। কিন্তু, নেশা ক্রমে গ্রাস করতে থাকে তার বাবাকে। আয়ের একটা অংশই ওড়াতেন নেশায়। রোজ রোজ নেশার ধকল, শরীর নিতে পারেনি। দোকান শিকেয় ওঠে, অসুস্থ হয়ে পড়েন রামুর বাবা।

অগত্যা সংসারের জোয়াল কাঁধে তুলে নেন রামুর মা বিমলা দেবী। গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাচের চুড়ি বেচতে শুরু করেন। রামুর বাঁ পা পোলিওয় আক্রান্ত হলেও, সেসবের তোয়াক্কা না-করে, মায়ের সঙ্গী হন। তাদের সঙ্গে যেত রামুর আর এক ভাইও।

দুই ভাইয়ের কাজ ছিল জানান দেওয়া। চিত্‍‌কার করে বলতেন, 'চুড়ি কিনবেন নাকি কাচের চুড়ি'? তা শুনে উত্‍‍‌সাহে ভিড় করতেন গ্রামের মেয়ে-বউরা।

যে গ্রাম থেকে রামু উঠে এসেছেন, সেখানে একটিই মাত্র প্রাইমারি স্কুল। তাই প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে, তাকে চলে যেতে হয় কাকার কাছে বারশিতে। ছোট বয়সেই এটা রামুর মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, দারিদ্রের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে, মন দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। তাই পড়াশোনায় খামতি ছিল না। ভালো ছাত্র হওয়ায়, স্কুলের শিক্ষকরাও তাকে ভালোবাসতেন।

রামু যখন বারো ক্লাসে, কলেজে মডেল পরীক্ষা চলছে। একদিন খবর এল, বাবা মারা গিয়েছেন। সেটা ২০০৫ সাল। বারশি থেকে যেতে হবে গ্রামের বাড়ি মহাগায়নে। বাসভাড় ৭ টাকা। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তার ভাড়া ছিল মাত্র ২ টাকা। সেই দু-টাকা খরচ করার মতো ক্ষমতাও তখন ছিল না রামুর।

তার প্রতিবেশীরাই সেই ভাড়া দিয়েছিলেন। যাতে বাবার শেষকৃত্যে ছেলে হাজির থাকতে পারেন। বাবা মারা যাওয়ার ঠিক চার দিনের মাথাতেই ছিল রসায়নের পরীক্ষা। মায়ের পীড়াপীড়িতে পরীক্ষায় বসতে হয়। বাকি পরীক্ষাগুলোয় অবশ্য তাকে বসানো যাননি। ফাইনাল পরীক্ষার একমাস আগে স্কুল থেকে এক শিক্ষকের চিঠি পান।

তাতে উল্লেখ করা হয়, রামু রসায়নে ৪০-এর মধ্যে পেয়েছেন ৩৫। তাকে উত্‍‌সাহিত করার জন্য ওই শিক্ষক দেখাও করতে চেয়েছিলেন মেধাবী এই ছাত্রের সঙ্গে। টেস্টের সব পরীক্ষা না দিলেও, ফাইনালে ৮৮.৫% নম্বর পেতে সমস্যাই হয়নি তার।

রামুর যা নম্বর, তাতে অন্য কিছু করতেই পারতেন। কিন্তু বেছে নেন ডি.এড কোর্স। যাতে কোর্সের খরচও কম পড়ে, আবার তাড়াতাড়ি স্কুলে মাস্টারিও শুরু করা যায়। এই ডি.এড করার পাশাপাশি মুক্তবিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্টস নিয়ে স্নাতকও হন। ২০০৯ সালে স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিও জুটে যায়। পরিবার এতেই খুশি। এই সুখী স্বপ্নই দেখেছিলেন রামুর মা।

ওই বছরই নিজের স্বপ্নের দিকে প্রথম পা বাড়ান রামু। ইউপিএসসি পরীক্ষার বসার পরিকল্পনা করেন। মা আপত্তি করেননি, উলটে সেল্ফ-হেল্প গ্রুপ থেকে নেওয়া ঋণের টাকা দিয়ে দেন ছেলের পড়ায়। এরপর স্কুলের চাকরি থেকে ছ-মাসের জন্য ছুটি নিয়ে, পুনায় গিয়ে পুরোদমে ইউপিএসসির প্রস্তুতি শুরু করে দেন।

রামুর কথায়, গ্রামের ছেলে হওয়ায় এমপিএসসি, ইউপিএসসি-র মানেও ঠিক করে জানা ছিল না। তাই ইউপিএসসি কোচিংয়ের প্রথম ক্লাসে গিয়েই শিক্ষকের কাছে আগে জানতে চাই, আদৌ কি আমি এই পরীক্ষায় বসার যোগ্য? ইউপিএসসির মানে কী? এই পরীক্ষা কি মারাঠিতে দেওয়া যায়?

শেষমেশ ২০১০ সালে ইউপিএসসি পরীক্ষায় বসেন। কিন্তু, তার দুর্ভাগ্য সাফল্য পাননি। এর মধ্যে রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়েন। সেখানেও ব্যর্থতা। গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার আগে রামু বলে যান একদিন বড় অফিসার হয়ে ফিরবেন। এর পর অবশ্য রামুকে আর থামানো যায়নি। স্কুলের চাকরি ছেড়ে 'স্টেট ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কেরিয়ারস'- এর পরীক্ষায় বসেন। তার পর ফের ইউপিএসসিতে বসে ২৮৭ র‌্যাঙ্ক করেন। দ্বিতীয়বার আর কারও কাছে কোচিং নিতে হয়নি তাকে।

২০১২-য় আইএএস অফিসার হয়ে প্রতিশ্রুতি মতো গ্রামে ফেরেন। রামু তখন রমেশ গোরখ গোলাপ, আইএএস।

এর কয়েক মাস পরেই এমপিএসসি-র রেজাল্ট বেরোলে, সেখানেও দেখা যায় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন। ১৮০০-র পরীক্ষায় তিনি পান ১২৪৪ । যা তার আগে কেউ পাননি। আইএএস রমেশ এখন রয়েছেন ঝাড়খণ্ডে। সেখানকার বিদ্যুত্‍‌ দফতরের যুগ্ম সচিব।

সূত্র: এইসময়

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়