কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক:
২১১টি আসনে জিতে ফিরে এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত সাড়ে চার বছরে অনেক বার লিখেছি, পশ্চিমবাংলায় এবং তার আগের বাংলায় রাজনৈতিক ইতিহাসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো জনপ্রিয় নেতা কেউ ছিলেন না। লিখেছি, একেবারে তৃণমূল থেকে উঠে আসা এক জন নারী যে জায়গায় পৌঁছেছেন তা প্রায় নবম আশ্চর্যের বলা যেতে পারে যে দেশের পুরুষরা তো বটেই, নারীরাও আর এক জন নারীকে পেছনে ফেলে রাখতে পছন্দ করে সেখানে কালীঘাটের এই মহিলা অবশ্যই ইতিহাস তৈরি করেছেন। এই উত্তরণকে উপেক্ষা করা মানে হল অসৎ উদ্দেশ্যে চোখ বন্ধ করে রাখা।
গত সাড়ে চার বছর আগে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে যখন জনমত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল তখন বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রহণ করেছিল পশ্চিমবাংলার মানুষ। সে সময় বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ মমতার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। নির্বাচনের ফল বের হলে দেখা গেল বামফ্রন্ট মুছে গিয়েছে। একটা কলাগাছের গায়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে দাঁড় করালে সেটাও জিতে যেত।
কিন্তু এই বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় এলেও গত সাড়ে চার বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক মানুষের বিরক্তিভাজন যে হয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। অত্যন্ত স্পষ্টবাদী, যিনি সাদাকে সাদা বলাই উচিত মনে করেন তাকেও সমস্যায় পড়তে হল। যাদের নিয়ে তিনি শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করছিলেন তাদের সম্পর্কে মানুষের ক্ষোভ জন্মাচ্ছিল। সারদা বা নারদের সঙ্গে জড়িত সেই লোকগুলোর বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না, এই অভিযোগ অনেকেরই ছিল। গ্রামে যেমন সুন্দর রাস্তা হয়েছে, বিভিন্ন শ্রী-প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষ উপকৃত হল তেমনই চোখের উপর পাঁচ বছর আগের বিত্তহীন বা নি¤œবিত্ত তৃণমূল নেতা বিশাল বাড়ির মালিক হয়ে যাচ্ছেন। যে কোনও অন্যায় করলেও পুলিশ যাকে সমীহ করে চোখ বন্ধ রাখছে, এদের কেন মমতা শাসন করছেন না, সেই অভিমান জমা হচ্ছিল। মাঝে মাঝে ওর মুখ থেকে কিছু বেঁফাস কথা বেরিয়েছিল, যেমন পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণ কা- হওয়ার পরে, অধ্যক্ষকে মারধর করেছিল যে তৃণমূলের মধ্যবয়স্করা তাদের ছেলেমানুষ বলে এড়িয়ে যাওয়া। বিদেশে দলবল নিয়ে ব্যবসায়ী ধরতে গিয়ে খালি হাতে ফিরে এসেও প্রচার করা শিল্পের বন্যা আসছে। এগুলো মানুষ ভাল চোখে দেখেনি। অনুব্রত ম-লের অসংলগ্ন কথাকে চাপা দিতে বলেছেন, ওর মাথায় অক্সিজেন কম যায়। সারের দাম কবে কমবে প্রশ্ন করাতে সাধারণ চাষিকে মাওবাদী ভেবে ক্ষিপ্ত হয়েছেন। তখন মনে হত তিনি চাপ সামলাতে পারছেন না।
আমার কেবলই মনে হত, তৃণমূল এমন একটা রাজনৈতিক দল যার পুরোটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তিনি যা বলবেন সেটাই শেষ কথা, এমন কোনও আদর্শ এই দলের সামনে নেই যা গৌতম দেব থেকে অনুব্রত ম-ল অনুসরণ করতে বাধ্য, দলের সদস্য হিসেবে তারা কোনও আদর্শের কাছে নয়, ব্যক্তির কাছে মাথা নত করছেন। সেটাই ভয়ঙ্কর চাপে ফেলেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনি যতই মা-মাটি-মানুযের কথা বলুন না কেন, দলের অন্যরা নিজেদের স্বার্থে এই স্লোগান ব্যবহার করেছেন। আমার বিশ্বাস, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ সব জানতেন। কিন্তু ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় করতে হত। প্রথম পাঁচ বছরে সেটা সম্ভব ছিল না কিন্তু পশ্চিমবাংলার অনেক মানুষ যে এটা পছন্দ করেননি তাতে সন্দেহ নেই।
এই সময় বিরোধীরা কী করছিল? সারদা নিয়ে ছোটখাটো কিছু মিছিল হয়েছে, নারদ নিয়ে কোনও বড় আন্দোলনের কথা তারা চিন্তা করলেন না। মানুষ দেখছিল এই সব বামপন্থী নেতা বয়সের কারণে একটু একটু করে স্থবির হয়ে যাচ্ছেন। যে দৌড়বীর যৌবনে ম্যারাথন দৌড় জিততো অনায়াসে, সে বার্ধক্যে এসে যদি বলে আমি দৌড়বীর-এখনও দৌড়তে পারি তা হলে যে হাস্যকর শোনাবে তা এরা বুঝলেন না। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মেলাতে না পেরে আদর্শ আদর্শ করে জপ করতে লাগলেন। যদিও জানেন সেই আদর্শ মুখ থুবড়ে পড়েছে। নির্বাচন আসছে কিন্তু কেন মানুষ তাদের ভোট দেবে এ বিষয়ে কোনও বিশ্লেষণ করলেন না। তাদের ধারণা হল মমতার উপর বিরূপ হয়ে মানুষ তাদের আশীর্বাদ করবেন।
কংগ্রেসের অবস্থা এই পশ্চিমবাংলায় আরও করুণ ছিল। কয়েক জন মধ্যবয়স্ক বামপন্থী নেতার সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেসের নেতারা সহমত হয়ে জোট গড়তে চাইলেন। একা যা পারা যাবে না, তা জোট বাঁধলে সম্ভব হবে। কিন্তু সেই জোট তৈরি করতে সমস্যা। আলিমুদ্দিনের বৃদ্ধরা হ্যাঁ বলতে গিয়ে ঢোক গিললেন, এত কালের শত্রুদের সঙ্গে হাত মেলাবো? প্রদেশ কংগ্রেসের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব ছিল না। দিল্লিতে ছুটতে হল তাদের। সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধীকে বোঝাতে প্রচুর সময় গেল। যেই তারা রাজি হলেন অমনি প্রচার শুরু হয়ে গেল নীচের তলার কর্মীদের চাপে জোট তৈরি হল। নীচের কর্মীরা যখন জোট বেঁধেছে, তখন আর বাঁধা কীসের? অথচ সেই সময় থেকে নির্বাচন পর্যন্ত আলিমুদ্দিন এক বারও বলেনি বামফ্রন্ট কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধেছে। তারা কথার শাকে মাছ ঢেকেছেন। সমমনস্ক দল একত্রিত হয়েছে, এটা ঠিক জোট নয়, এটাই বলে গেছেন তারা। আড়াই মাস আগে তথাকথিত যে জোট হয়েছিল তার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা কথাও বলা হয়নি। যদি জোট জেতে তাদের মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন তা মানুষকে জানাবার প্রয়োজন মনে করেননি। একটা গোঁজামিল সৈন্যবাহিনী তৈরি করে মূর্খস্বপ্ন দেখতে গিয়ে সূর্যকান্ত মিশ্র দুশো আসনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা পরে অস্বীকার করেছেন।
মমতার আচরণে বিরক্ত হয়ে অনেক ভোটার যে সমস্যা পড়েছিলেন তা হল, কাকে ভোট দেবেন? জোটকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না, যে কোনও দিন ভেঙে যেতে পারে। জোটের কোনও বিশ্বাসযোগ্য নেতা নেই। ওদের ভোট দেওয়া তাই অনিশ্চয়তাকে ডেকে আনা। ২০১১ সালে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পেয়েছিল। ২০১৬ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যে কেউ নেই। তাই মমতাকে ভোট দিলে আগামী পাঁচ বছরে সরকার ভাঙবে না। এই বিশ্বাসে মানুষ তাকে ভোট দিয়েছে।
এখন ওর পায়ের তলার মাটি শক্ত। এখন যদি ঝেঁটিয়ে আবর্জনা বিদায় করেন, তা হলে মানুষ তাকে দুই হাত তুলে আশীর্বাদ করবেই। সূত্র: আনন্দবাজার
খবর বিভাগঃ
দেশের বাইরে
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়