Friday, January 8

বিশ্ব ইজতেমা কল্যাণের ঝরনাধারা


মুহাম্মদ মিনহাজ উদ্দিন: মুসলমানদের মন-মানসে ব্যাপক ধর্মীয় আগ্রহ, উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ভাবগাম্ভীর্যময় আবেগ-জজবা এবং আধ্যাত্মিক প্রেরণা জাগানিয়া এক স্বর্গীয় আবহ সৃষ্টি করে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাসমাবেশ বিশ্ব ইজতেমা। বিশ্ব ইজতেমা মূলত তাবলিগ জামাতের বার্ষিক সম্মেলন হলেও সর্বস্তরের মুসলমান, যারা সাধারণত বছরের অন্য কোনো সময় দাওয়াতের কাজে তেমন শরিক হতে পারেন না, তারাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ জমায়েতে শামিল হন। দ্বীনের দাওয়াত মানুষকে অজ্ঞতার ঘোর অমানিশা থেকে জ্ঞানের প্রোজ্জ্বল আলোর দিকে, প্রবৃত্তির অন্ধ অনুসরণ থেকে শৃঙ্খলার দিকে, সঙ্কীর্ণমনা থেকে উদারতার দিকে, হিংসা-বিদ্বেষ ও ক্রোধ-দম্ভ ইত্যাদি থেকে সম্প্রীতি-ভালোবাসা ও কল্যাণকামিতার দিকে ধাবিত করে। সর্বোপরি হৃদয়কন্দরে আল্লাহপ্রেম ও দ্বীনের প্রতি অতিশয় আগ্রহ ও কৌতূহলতা সৃষ্টি করে। লাখো মানুষের পুণ্যময় এ মহাসমাবেশে এমন অসংখ্য মুসলি্ল আসেন, যারা আল্লাহর পথে সদা আত্মসমর্পিত ও নিবেদিতপ্রাণ। মহান প্রভুর সন্তুষ্টি কামনায় কল্যাণের পথে মানুষকে আহ্বান ও ইসলামের ক্রমোন্নতির লক্ষ্যে এবং দাওয়াতের কাজের ব্যাপক প্রচার-প্রসারে অনেকে সারা জীবনের তরে বেরিয়ে পড়েছেন, তারা খোদাপ্রেমে মশগুল থেকে ত্যাগ-সাধনা ও মুজাহাদার মাধ্যমে পুণ্যবানদের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। বিশ্ব ইজতেমার প্রতি ওয়াক্তে সর্ববৃহৎ জামাতে নামাজ আদায় কিংবা প্রবল এখলাস-নিষ্ঠা সমৃদ্ধ ইসলামী জিন্দেগানির বিভিন্ন দিকের ওপর কোরআন-হাদিসভিত্তিক বয়ান শ্রবণ এবং ইজতেমার প্রতিটি আমল বিপুল প্রতিক্রিয়াশীল। সমাগত অজানা-অচেনা লাখো আল্লাহর অলির সানি্নধ্যপরশ ও লাখ লাখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের সঙ্গে একত্রে পরম করুণাময়ের দরবারে ক্ষমা প্রার্থনার আশায় মুসলমানমাত্রই আবেগাপ্লুত হন এবং অপার্থিব শিহরণ-পুলক অনুভব করেন। দ্বীনের দাওয়াত মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে নিরন্তর সহায়তা করে। মানুষের চিন্তাধারার উৎকর্ষ সাধনে সুবিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমনটি দাওয়াত ও তাবলিগের আজীবন মুরুবি্ব, মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশে প্রচলিত নিয়মে দাওয়াতের কাজের সূচনাকারী, তাবলিগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলয়াস (রহ.) এর একান্ত আস্থাভাজন, আরব ও আজমের আধ্যাত্মিক রাহবার, বিশ্ববরেণ্য মহান ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) এর জীবন-অভিধানে দেখা যায়। এক্ষেত্রে আল্লামা নদভীর (রহ.) স্বরচিত 'মুজাক্কারাতু ছা-ইহিন ফিশশরকিল আরবি' বা 'মধ্যপ্রাচ্যের ডায়েরি' এবং 'ইলা মুমাচ্ছিলি-বিলাদিল মুসলিমিন' বা 'মুসলিম দেশের প্রতিনিধিদের বলছি' গ্রন্থদ্বয়ের রচনার প্রেক্ষাপট, অধিকাংশ কিতাবে উক্তি-ঘোষণা ও বিস্তারিত বিবরণ বিষয়টির আরও চরম স্ফুরণ ঘটায়। আদর্শ সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ বিশ্ব ইজতেমার একটি কার্যকরী ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। অন্যায়, অবিচার-জুলুম, ছিনতাই-রাহাজানি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, কলহ-বিবাদ প্রতিনিয়ত প্রতিটি ব্যক্তি, সমাজ ও দেশ-জাতিকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিয়ে যাচ্ছে। অবিরাম দাওয়াতি কার্যক্রমই শুধু হুশ ফেরাতে পারে বিপন্ন মানবতার। দিতে পারে মুক্তি, শান্তি-কল্যাণ ও সমৃদ্ধি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সিরাত, সাহাবাদের স্বর্ণোজ্জ্বল জীবনী, সুফিয়ায়ে কেরাম ও অলি-বুজুর্গদের দ্যুতিময় আখ্যান আমাদের সে কথারই জ্ঞান দেয়। চরিত্র, কর্মসূচি-কার্যক্রম ও বক্তব্য- মোদ্দাকথা সব দিক থেকে তাবলিগ সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ধর্মীয়-দাওয়াতি আন্দোলন। দাওয়াত ও তাবলিগের মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি স্তরে ইসলামী চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধ ও ভাবধারা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইবাদত-বন্দেগি, আল্লাহভীতি ও পরকালের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। পথহারা-দিশেহারা লাখো-কোটি পথিক সুপথের দিশা পাচ্ছে। আধুনিক-শিক্ষিত পর্যায়ে ক্রমপরিবর্তন, ধর্মীয় তৎপরতা-সততা, নিষ্ঠা-নিষ্কলুষতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরির ক্ষেত্রে তাবলিগের ভূমিকা উল্লেখ করার অপেক্ষা রাখে না। বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহ, প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্ট, অভিনেতা-পপতারকারা যাদের কাছে দাওয়াত নিয়ে যাওয়া চরম দুষ্কর, তারাও আজ তাবলিগের বদৌলতে পরিপূর্ণ আল্লাহর হুকুম পালন ও সুন্নত অনুযায়ী জীবনযাপনের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কাতারের যুবরাজ, মৌরিতানিয়ার প্রেসিডেন্ট, সৌদি বাদশাহর ভগি্নপতি, পপতারকা জুনায়েদ জামশেদ, ক্রিকেট লিজেন্ড ইনজামামুল হক, গ্রেট মুহাম্মদ ইউসুফ, সাইদ আনোয়ার, সাকলাইন মুশতাক, হাশিম আমলা, মঈন আলী ও ইমরান তাহিরদের দেখলে মন সত্যি ঈর্ষাক্রান্ত হয়ে পড়ে। বিশ্বের প্রতিটি দেশে হাজার হাজার ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর ইসলাম গ্রহণ, শত শত গির্জা, মন্দির, প্যাগোডা ও বিধর্মীদের মাঝে তাবলিগের সুফল এর একনিষ্ঠতার ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণা দেয়। ইজতেমার ৯০ ভাগের বেশি মানুষ মুসাফির। মুসাফিরের ও সম্মিলিত দোয়া কবুল হওয়ার ব্যাপারে হাদিসে স্পষ্ট বর্ণনা এসেছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে ও মজমার সামগ্রিক বিবেচনায় সুদীর্ঘ আখেরি মোনাজাত করা হয়। মোনাজাতে অংশ নিতে ময়দানের উদ্দেশে ছোটে লাখ লাখ ধর্মপাগল মানুষ। আখেরি মোনাজাতের দিন ইজতেমা ময়দান ছাপিয়ে রাজপথ, টঙ্গীর আশপাশ, অলি-গলি, বাসা-বাড়ি, আনাচে-কানাচে সবখানে- এমনকি বিমানবন্দর এলাকাও লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। মুসলি্লদের জিকিরে-ফিকিরে তুরাগ তীর হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত ও মুখরিত। ইজতেমার প্রথম দিন টঙ্গী পরিণত হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ জুমার নামজ আদায়ের নগরে। দেশ-বিদেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের উপস্থিতিতে টঙ্গীর তুরাগ তীরের বিস্তীর্ণ প্রান্তর সমবেত মুসলি্লদের ইবাদত-বন্দেগি, জিকির-আসকারে রূপ ধারণ করে এক পুণ্যভূমির। আখেরি মোনাজাতে যখন দেশ-জাতির সার্বিক কল্যাণ ও সমগ্র মুসলিম উম্মাহর শান্তি কামনা করে সমবেত ও আগত সবাই কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করে এবং সম্মলিতভাবে 'আমিন' 'আমিন' বলে, তখন টঙ্গীর আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে। ঐশী রহমতের ফল্গুধারা প্রবল প্রবাহে বইতে থাকে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়