Friday, January 15

বিশ্বাসের ইজতেমা


মুফতি আবুল কালাম আনছারী: ঋতুবৈচিত্র্যের বাংলাদেশে বর্তমানে চলছে শীতকাল। হিমেল হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতকাল আমাদের অনেক কিছুই উপহার দিয়ে যায়। বয়ে আনে হাজারো খুশির সংবাদ। কিন্তু অর্ধশতাব্দীকাল ধরে আমরা আরও কয়েকটি উপহার পেয়ে আসছি। এর মধ্যে আছে তুরাগ তীরের বিশ্ব ইজতেমা। শীতের কোনো এক বরকতি ক্ষণে আমাদের ওপরে বহমান হয় রহমতের এই বারিধারা। যার পরশে ধন্য হয় বাংলাদেশ। ধন্য হয় বিশ্বাসী ও বিশ্ববাসী। পরোপকার, কল্যাণকামিতা ও ঈমানের খোরাক নিয়ে উপস্থিত হয় এই ইজতেমা। যার ফলে সবার দুয়ারে দুয়ারে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে। সবার হৃদয়ে স্পন্দিত হয় ঈমানের নূর। সজীবতা আসে প্রাণে। সতেজ হয় ঈমান। দলে দলে মানুষ ছুটে আসে তুরাগ তীরের এইখানে। আসে সবাই ঈমানের টানে। বিশ্ব ইজতেমা, তাবলিগি ইজতেমা, দ্বীনের ইজতেমা- এ ইজতেমা রহমতের সন্ধান দেয়। হেদায়েতের পথ দেখায়। পাপ-পঙ্কিলতা দূর করে। গোনাহগারদের সংশোধিত হওয়ার অবারিত সুযোগ এনে দেয়। অনানুষ্ঠানিক প্রচারণায় বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে তার দাওয়াত পৌঁছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটি থেকেও হাজারও মুসলমান ছুটে আসেন। ঈমানের টানে জমায়েত হন লাখো যুব-তরুণ, বয়োবৃদ্ধ আমজনতা। আসেন শত কাজে ব্যস্ত থাকা, সামান্য সময়ের জন্যও অবসর না পাওয়া লোকটি। পড়াশোনায় নিমগ্ন মেধাবী ছাত্রটি। চবি্বশ ঘণ্টার রুটিন বাঁধা শিক্ষকটি দিব্যি তিন দিন বয়ান শুনে যান গভীর মনোযোগে। ইজতেমার সব কিছুই চলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে। নির্ধারিত সময়ে বয়ান। মাঝে মাঝে বিরতি। সময়ে সময়ে তাশকিল। সবকিছুই সুচারুরূপে সম্পাদিত হচ্ছে। প্রতিটি কাজে পরিলক্ষিত হচ্ছে বরকতের ছটা। মুরবি্বদের বয়ানে এক ধরনের নূর আছে। আছে ব্যাপক সম্মোহনী শক্তি। সকাল, দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা ও রাত্রিবেলায় বয়ান হতে থাকে। বয়ানের পুরোটা ঘিরে থাকে ঈমান মজবুতির আলোচনা। থাকে আল্লাহ থেকে নেয়ার, সব সমস্যার সমাধান আল্লাহ থেকে পাওয়ার মাশওয়ারা। আলোচনা হয় দ্বীনের পথে, আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার গুরুত্ব। প্রত্যেকের নিজ নিজ দায়িত্ব ও পরকালে জবাবদিহিতার কথা। সবাই দিল-দেমাগ লাগিয়ে বয়ান শোনে। মন-মগজে বসিয়ে নেয়। ঈমানি খোরাক পায়। লুফে নেয় তার সবটুকু। শুধু শোনা নয়। কাজে পরিণত করে। আমলে বাস্তবায়ন করে। হৃদয়ের ক্যানভাসে গেঁথে নেয় সব কথা। বয়ানের প্রভাব দেখা যায় সবখানে। উপস্থিতদের কথোপকথনে। চলনে-বলনে পরিবর্তন দেখা যায়। ইজতেমায় এসে কারও মধ্যে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। আদরের দুলাল, পদস্থ অফিসার, রাশভারি বস, বেকার যুবক, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি সবাই তখন এক কাতারে। কেউ বয়ান শোনায় ব্যস্ত, কেউবা আছেন খেদমতে। কালিমাখা হাঁড়ি নিয়ে ব্যস্ত সময় যাচ্ছে কোনো ধনীর দুলালের। এসি অফিস-ফ্ল্যাটে অভ্যস্ত বসরাও থাকছেন চটের সামিয়ানার নিচে। যার মধ্য দিয়ে অবাধে যাতায়াত করছে ঠা-ার মিশেলে কনকনে বাতাস। এত কিছুর পরও কারও অভাব-অভিযোগ নেই। দিব্যি হাসিমুখ নিয়ে, আগ্রহী অন্তর নিয়ে, দ্বীনহারা, পথহারা মানুষদের প্রতি দরদ নিয়ে ফিকিরে আছেন সবাই। আপাতত নিজের জন্য কারও কোনো চিন্তা নেই। ইজতেমার বয়ান শুনে মন গলে গেছে। পাষ- অন্তরেও মায়া এসেছে। নিজের অজ্ঞতা, ঈমানি দুর্বলতা বুঝে এসেছে। ক্ষীণকায় ঈমানে বিশ্বাসের নীড়ে উঠেছে ঝড়। টঙ্গীর তুরাগ তীরের এই বাড়িঘর থেকে কলুষিত অন্তরে আলোর ছটা লেগেছে। ঈমানি আলোচনায় ভরপুর মজমা থেকে দ্বীনের বুঝ এসেছে। শ্বাপদসঙ্কুল জাহান্নামের শাস্তির কথা শুনে, পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত জীবন গঠনের স্বাদ জেগেছে। অনুপ্রেরণা এসেছে সত্যের পথে চলার। তাই তো দেখি ইজতেমায় এসে নাম লেখাচ্ছে এক চিল্লা, তিন চিল্লা, এক সালে। পাড়ার সেই উদ্ভ্রান্ত ছেলেটিও দ্বীনের পথে বেরোচ্ছে। আল্লাহর রাস্তায় নাম লেখাচ্ছে। আপন ঘর ছেড়ে, বাবা-মা, স্ত্রী-পরিজন সব ছেড়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। স্বীয় ঈমানের ওপর মেহনত করছে। মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দিচ্ছে। ফলে তার ভেতরেও পরিবর্তন আসছে। দ্বীনের রাস্তায় মেহনতের ফলে তার দিলের কালিমা দূর হয়ে সেও পরিণত হচ্ছে সোনার মানুষে। চিল্লা শেষে ফেরার পর দেখা যায়, লোকটির দেহ আগের মতোই থাকে। তবে পাল্টে যায় তার মন। পরিবর্তন হয় তার আমল। যারা আগে তাকে দেখে ভয় পেত, ক্ষতির আশঙ্কা করত, মুখের সামনে প্রশংসা করলেও পেছনে মন্দ বলত, এখন তারাই তার কাছে এসে নিজেকে অপরাধী ভাবে। তার চরিত্র-মাধুরী দেখে নিজেরা লজ্জিত হয়। তার ফেরেশেতাসুলভ আচরণ দেখে দ্বীনের পথে আসার প্রতিজ্ঞা করে। বিনিময়ে ফিরে পায় প্রকৃত সুখ-শান্তি ও পাপাচারমুক্ত জীবন। দ্বীনের পথ থেকে ফিরে আল্লাহর ওপর তার আস্থা বেড়ে যায়। যাবতীয় সমস্যার সমাধান সে আল্লাহ থেকেই কামনা করে। প্রভু থেকে নেয়াই হয় তার অধিক পছন্দ। নড়বড়ে ঈমানে শক্তি আসে। বিশ্বাসে দৃঢ়তা পয়দা হয়। মোমিনের সব গুণ জমা হয় তার হৃদয়তন্ত্রীতে। জীবনে সফলতা আসে। দিন বদলে দেখা যায় সেও হয়ে ওঠে ঈমানের বলে বলীয়ান। প্রিয় পাঠক, তাদের এই বিশ্বাসী হওয়ার, পরিবর্তিত জীবনে সফলতা পাওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা বিশ্ব ইজতেমার। সেখানের দ্বীনি আলোচনার। বিশ্ব ইজতেমা কল্যাণের ইজতেমা। সবার ঘরে ঘরে ঈমানের দাওয়াত পৌঁছাক। সবাই বিশ্বাসী হোক। সবার জীবনে সফলতা আসুক। এটাই আমাদের প্রত্যাশা। লেখক : সহকারী মুফতি জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়