Friday, January 15

দাওয়াত ও তাবলিগের মূলনীতি


মাহবুবুর রহমান নোমানি: যে ব্যক্তি মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয় তাকে দাঈ বলা হয়। আল্লাহর পথের দাঈর সম্মান ও মর্যাদা অনেক। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, 'যে ব্যক্তি মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা কারও হতে পারে না?' (সূরা হামিম সেজদা : ৩৩)। জগতে প্রেরিত প্রত্যেক নবীই মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিয়েছেন। সুতরাং দাওয়াত অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠতম কাজ। এই কাজের ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য, গুণাবলিও শ্রেষ্ঠতম। তাদের অন্তর হবে নবীদের মতো উদার। দিলে থাকবে উম্মতের নাজাতের দরদ ও ফিকির। তাদের জীবন হবে সাদাসিধে। আখলাক হবে পবিত্র ও উন্নত। মুয়ামালাত (লেনদেন), মুয়াশারাত (আচার-ব্যবহার) হতে হবে স্বচ্ছ ও সুন্দর। দাঈর বৈশিষ্ট্য প্রবাহিত পানির মতো। কখনও সে গাফেল থাকবে না। অযথা সময় নষ্ট করবে না। দাওয়াতের কাজের জন্য এখলাছ ও নিষ্ঠা অতি জরুরি। নবীরা মানুষকে দিতেন এবং বলতেন, আমার বিনিময় আল্লাহর কাছ থেকে নেব। দাঈ এরকম ধারণা করবে না যে, আমি মানুষের হেদায়েত করছি। হেদায়েত করার মালিক আল্লাহ। দাওয়াতের ভাষা হবে নরম ও দরদমাখা। আল্লাহ মুসা ও হারুন (আ.) কে দাম্ভিক ফেরাউনের কাছে দাওয়াতের কাজে পাঠিয়ে বলেছিলেন, 'তাকে তোমরা নরম ভাষায় দাওয়াত দেবে। হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে কিংবা ভয় করবে।' (সূরা ত্বাহা : ৪৪)। দাঈকে কুশলী হতে হবে। হেকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে দাওয়াত দিতে হবে। আল্লাহ বলেন, 'উত্তম উপদেশ ও হেকমতের সঙ্গে তোমার রবের দিকে মানুষকে দাওয়াত দাও।' (সূরা নাহল : ১২৫)। দাঈকে অত্যন্ত ধৈর্যশীল হতে হবে। দাওয়াতের কাজে চরম ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। আল্লাহ নবীদের ব্যাপারে বলেছেন, 'আমি তাদেরকে ইমাম বানিয়েছি মানুষের পথপ্রদর্শনের জন্য, তারা ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে এবং আমার আয়াতের প্রতি তাদের অগাধ বিশ্বাস ছিল।' (সূরা ইসরা : ৩৩)। দাওয়াতের কারণে নবীরা অমানবিক কষ্ট ও নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন। সব নির্যাতন অমস্নান বদনে সয়ে নিয়েছেন। কোনো প্রতিবাদ করেননি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, 'মন্দকে উত্তম পদ্ধতিতে প্রতিহত করো। তখন তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা রয়েছে সেও তোমার বন্ধু হতে বাধ্য।' (সূরা হামিম সেজদা : ৩৪)। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আয়াতে দাওয়াতকারীদের প্রতি এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, মন্দকে উত্তম পন্থায় প্রতিহত করবে। আর তা হলো মন্দ আচরণকারীকে ক্ষমা করে দেয়া, অধিকন্তু তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা। রাসূল (সা.) বলেন, 'যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার সঙ্গে তুমি সম্পর্ক গড়। যে তোমার প্রতি জুলুম করে তাকে মাফ করে দাও। এবং যে তোমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করে, তার সঙ্গে তুমি ভালো আচরণ করো।' নবীদেরকে তাদের জাতি যখন বলেছে, আমরা তোমাকে নির্বোধ মনে করি, আমাদের দৃষ্টিতে তুমি মিথ্যুক, তখন নবীরা জবাবে বলেছেন, 'হে আমার গোত্রের লোকেরা! আমি নির্বোধ নই। বরং আমি তো মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসুল।' আল্লাহর পথের দাঈকে নবীদের এই চরিত্র অর্জন করতে হবে। দাওয়াতের দুটি পদ্ধতি রয়েছে। এক. ইনফিরাদি বা একাকভাবে দাওয়াত দেওয়া। দুই. ইজতেমায়ি বা সংঘবদ্ধভাবে দাওয়া প্রদান করা। ওয়াজ, মাহফিল, সেমিনার ইত্যাদির মাধ্যমে ইজতেমায়ি দাওয়াত হচ্ছে। বর্তমানে প্রচলিত তাবলিগ জামাতও ইজতেমায়ি দাওয়াতের কাজ করে যাচ্ছে। ইজতেমায়ি তাবলিগ ফরজে কেফায়া; কিন্তু ইনফিরাদি তাবলিগ ফরজে আইন। নিজের চোখের সামনে কাউকে অন্যায় কাজে লিপ্ত দেখলে তাকে বাধা দেয়া এবং দ্বীনের কথা বুঝিয়ে অন্যায় থেকে বিরত রাখা প্রত্যেকের ওপর ফরজ। মনে করা উচিত নয় যে, এটা আলেমদের কাজ কিংবা তাবলিগকারীদের দায়িত্ব। বরং প্রিয় নবীর ভাষ্য মতে, এ কাজের দায়িত্ব প্রত্যেক মুসলমানের ওপর অবশ্য পালনীয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'তোমাদের প্রত্যেকে দায়িত্বশীল। আর প্রত্যেককেই তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।' (বোখারি ও মুসলিম)। বর্তমানে ইনফেরাদি দাওয়াতের কাজে বড় অবহেলা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বলা যেতে পারে, একটা স্বতন্ত্র ফরজ আদায়ের ব্যাপারে বড্ড অবহেলা করা হচ্ছে। শরিয়তের বিধি-বিধান দুই ধরনের_ করণীয় ও বর্জনীয়। তেমনি দাওয়াতের বিষয়ও দুটি। তথা 'আমর বিল মারুফ' ও 'নাহি আনিল মুনকার'। আখেরাতের মুক্তির জন্য শুধু করণীয় কাজ আদায় যথেষ্ট নয়। বর্জনীয় কাজ থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। তাই শুধু 'আমর বিল মারুফ' তথা সৎকাজের আদেশ যথেষ্ট নয়। মানুষকে অন্যায় ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা অতি জরুরি। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, 'তোমাদের কেউ অন্যায় কাজ হতে দেখলে শক্তি দ্বারা তা প্রতিহত করবে। তা না পারলে কথার মাধ্যমে বন্ধ করবে। তাও সম্ভব না হলে অন্তরে ঘৃণা করবে। এটা ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর।' (মুসলিম শরিফ)। অবশ্য অন্যায় কাজে বাধা দেয়ার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম জেনে রাখা দরকার। যেমন_ এক. মন্দকর্মে লিপ্ত ব্যক্তির ব্যাপারে যদি এই ধারণা প্রবল হয় যে, এ মুহূর্তে তাকে বাধা দিলে সে মন্দকর্ম থেকে বিরত হবে না, উল্টো শরিয়তকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে, তখন 'নাহি আনিল মুনকার' এর ফরজিয়্যাত রহিত হয়ে যায়। কেননা শরিয়তের বিধান তুচ্ছাকারী ব্যক্তি ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করা উচিত, হে দয়াময় আল্লাহ! আপনার এ বান্দা কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত। আপনার দয়া ও অনুগ্রহে তাকে এ ব্যাধি থেকে আরোগ্য দান করুন। দুই. দাওয়াত শুনে অন্যায় থেকে বিরত হওয়া বা না হওয়া উভয়টির সম্ভাবনা থাকে। সে ক্ষেত্রে হক কথা বলে দেয়া উত্তম। তিন. যদি এরকম ধারণা হয় যে, গোনাহে লিপ্ত ব্যক্তিকে দাওয়াত দিলে সে শরিয়তের বিধান তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করলেও দাঈকে কষ্ট দেবে, তখন তাকে বাধা প্রদান না করার অনুমতি রয়েছে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়