Thursday, December 24

যার জন্মে আলোকময় সারা জাহান


সাইয়্যেদ নাইমুল ইহসান বারকাতী: মিলাদ কথাটি আরবি। এটি মাওলুদ থেকে উৎপন্ন। শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে জন্ম। আরবি ভাষার বিখ্যাত অভিধান লিসানুল আরব গ্রন্থে মিলাদ শব্দের অর্থ হচ্ছে জন্ম, জন্মদিন, জন্মকাল। এছাড়াও আল মুজামুল ওয়াফি গ্রন্থকার মাওলুদ কথাটির অর্থ জন্ম বা উৎপন্ন হিসেবে নিরূপিত করেছেন। সাধারণ ইসলামী পরিভাষায় মিলাদুন্নবী অর্থ হলো মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম, জন্মকাল এবং তাঁর জন্মসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি স্মরণ করা তথা তাঁর পবিত্র সিরাতের আলোচনা করা। ঈদে মিলাদুন্নবী কথাটির অর্থ হচ্ছে, মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম ও জন্মকাল তথা সিরাত সম্পর্কে আলোচনা করা এবং তাঁর দুনিয়ায় আগমন উপলক্ষে আনন্দ ও খুশি পালন করা হামদ, নাতে রাসুল, মিলাদ, দরুদ ও সালাম ইত্যাদির মাধ্যমে। বিশ্বের নানা দেশে বিভিন্নভাবে ও নামে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা হয়। আলজেরিয়ান ও আফ্রিকা অঞ্চলবাসী একে মাওলুদুন-নবওয়ি, মালয়েশিয়া ও মালে, মাওলুদুর-রাসুল, আরব, ইরাকবাসী ইয়াওমুন-নবী, তুর্কিবাসীরা মাওলুদ শরিফ, ইরানবাসী জহুরে পায়গাম্বারে আকরাম প্রভৃত নামে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করেন। প্রিয়নবী (সা.) এমনই একজন নবী, যার আগমনের জন্য ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেছিলেন, যাঁর শুভাগমনের ব্যাপারে ঈসা (আ.) বনি ইসরাইল জাতিকে সুসংবাদ দিয়েছিলেন। তাঁরই সৌজন্যে আল্লাহ এ ত্রিভুবন সৃষ্টি করেছেন; যার প্রতি ঈমান আনার জন্য আর সমর্থনদানের জন্য আল্লাহ সব আম্বিয়ায়ে কেরাম থেকে কঠোর অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন; যার মাধুর্যপূর্ণ চরিত্রে বিদ্যমান রয়েছে আমানতদারি, দানশীলতা, উদারতা, মহানুভবতা, বিনয়-নম্রতা, সততা, সত্যবাদিতা, ধৈর্য-সহনশীলতা, বীরত্ব ও সাহসিকতা; যার উছিলায় আরব ভূখন্ড থেকে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর অভিশাপ চিরতরে দূরীভূত হলো, অনুৎপাদনশীল জমি ফসল ফলনে ভরপুর হয়ে উঠলো, দুগ্ধশূন্য উট ও বকরিগুলোর স্তন দুগ্ধে পরিপূর্ণ হলো। সদা দয়াবান-আল আমিন যাঁর উপাধি; যিনি আরব-আজমিদের মধ্যে সমমর্যাদা প্রণয়নকারী; উম্মতের কষ্টে তিনি ব্যথিত, আনন্দে তিনি আনন্দিত, পরিবারের প্রতি যত্নবান, প্রতিবেশীদের শুভাকাঙ্ক্ষী, আত্মীয়তার বন্ধনকে সুদৃঢ় করা এবং শক্রকে মিত্রে পরিণত করা তাঁর দুর্লভ আদর্শ। তিনি হলেন আমাদের প্রিয়নবী তাজদারে মদিনা, মুক্তির দিশারি, শান্তির অগ্রদূত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহু (সা.)। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের কথা। রবিউল আউয়ালের এক প্রভাতে আরব-মরুর মক্কা উপত্যকায় জন্মেছিলেন আল্লাহর রাসুল (সা.)। যার নূরে বিদীর্ণ হয়েছিল গোমরাহি ও জাহেলিয়াতের পর্দা। সে প্রভাতের বিভায় অবিচার ও অনাচারের লু-হাওয়া পরিণত হয়েছিল তওহিদের শীতল হাওয়ায়। সে খুশির বারতা পৌঁছে গিয়েছিল দিকদিগন্তে। মহানবীর (সা.) জন্মের শুভমুহূর্তের আলোড়িত সব ঘটনাই জানান দিচ্ছিল বিশ্বমানবতার গগনে প্রদীপ্ত সূর্যের উদয়ের কথা। তিনি আদম সন্তানরূপে জন্মলাভ করেছেন প্রথম আমেফিল (যে বছর আবরাহা কর্তৃক কাবাঘর হামলা করার চক্রান্ত হয়েছিল) ১২ রবিউল আউয়াল (মতান্তরে ৭, ৯, ১১ রবিউল আউয়াল), সোমবার দিন ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে সুবহে সাদিকের সময়। প্রিয়নবী দুনিয়ায় আসার ধারাবাহিকতায় শেষ নবী; কিন্তু বাস্তবে তিনি আল্লাহর সর্বপ্রথম সৃষ্টি। প্রিয়নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, কাতাদা (রা.) থেকে মুরসাল সনদে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, 'সৃষ্টির দিক থেকে আমি সর্বপ্রথম এবং নবীরূপে প্রেরিত হওয়ার দিক থেকে আমি তাদের সর্বশেষ।' (ইবনে সা'আদ)। প্রিয়নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, 'আমি ওই সময়ও নবী ছিলাম, যখন আদম (আ.) পানি ও মাটির মাঝামাঝিতে ছিলেন।' (মাদারিজুন নবুয়ত)। বছরের পর বছর ধরে যে আরব ভূমি তথা বিশ্বমানবতা পিপাসায় হাহাকার করছিল, তার ওপর বয়ে যায় রহমতের বারিবর্ষণ। যাতে সততা, নিষ্ঠা, ভ্রাতৃত্ব, হৃদ্যতা, ন্যায় ও সাম্য থেকে বঞ্চিত মানবতার রুক্ষভূমি পূর্ণ হয়ে ওঠে শ্যামল শোভায়। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির জন্মের সেই শুভমুহূর্তে আনন্দের বন্যা বইয়ে যায় সবখানে। এ আনন্দ প্রকাশ থেকে বাদ যায়নি কাফেরদের সর্দার আবু লাহাব। যে আত্মীয়তার সম্পর্কে আল্লাহর রাসুলের চাচা। উরওয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, 'আবু লাহাব সুয়াইবিয়াকে মুক্ত করে, এরপর সে রাসুলকে দুধ পান করায়। অতঃপর আবু লাহাবের মৃত্যুর পর তার জনৈক আত্মীয় আব্বাস (রা) তাকে খুব খারাপ অবস্থায় স্বপ্নে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সঙ্গে কীরূপ আচরণ করা হচ্ছে? উত্তরে আবু লাহাব বলল, তোমাদের থেকে চলে আসার পর অর্থাৎ আমার মৃত্যুর পর শান্তিতে থাকার সুযোগ আমার হয়নি, তবে মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মে খুশি হয়ে আমার দাসী সুয়াইবিয়া মুক্ত করার কারণে আমি প্রতি সোমবার একটু পানি পান করে শান্তি পাই। অতঃপর শাহাদাত আঙুল ও মধ্যমা অঙ্গুলির প্রতি ইঙ্গিত করে।' (বোখারি)। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় অধিকাংশ মোহাদ্দেস বলেছেন, এক কাফের ব্যক্তি যার ওপর লানত করে আল্লাহ কোরআনে একটি সূরা নাজিল করেছেন, সেই কাফের ব্যক্তি যখন প্রিয়নবীর জন্মের সংবাদ শুনে আনন্দিত হয়ে শুধু একটি ভালো কাজ করার কারণে মহান আল্লাহ যখন তার আজাব জাহান্নামে লাঘব করেন, তখন আমরা যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান রাখি এবং নবীকে মনেপ্রাণে মহব্বত করি আমরা যদি প্রিয়নবীর জন্মের খুশিতে সামান্য আনন্দ বা উৎসব পালন করি তবে এর প্রতিফল যে আল্লাহ কী দেবেন তা আল্লাহই ভালো জানেন। তবে এ আনন্দ-উল্লাস দুনিয়ার অন্যান্য আনন্দ উৎসবের মতো নয়। এটি একটি সম্পূর্ণ পবিত্র ভাবধারার আনন্দ। এ আনন্দ-উৎসব অবশ্যই শরিয়তের নীতিমালা ও সীমারেখায় থেকে করতে হবে। অতএব প্রিয়নবীর দুনিয়াতে আগমন হিসেবে আনন্দ-খুশি উদযাপন করা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সহায়ক। তাই আমরা যদি সেই দিন প্রিয়নবীর জীবন চর্চা, সিরাত আলোচনা, তাঁর শানে নাতে রাসুল পরিবেশন, মিলাদ কিয়ামের মাধ্যমে ঈদে মিলাদুন্নবী তথা নবীর জন্মের আনন্দ ও খুশি পালন করি তবে রোজ কেয়ামতে নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের এর বিরাট প্রতিদান দেবেন

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়