Wednesday, December 16

মানব হত্যা মহাপাপ


শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: মানব ইতিহাসে প্রথম সংঘটিত অপরাধ হলো মানব হত্যা। এটি শিরকের পরেই 'কবিরা গোনাহ' বা সবচেয়ে বড় অপরাধ। আদি পিতা আদম (আ.) এর দ্বিতীয় ছেলে কাবিল আপন বড় ভাই হাবিল (রা.) কে অন্যায়ভাবে হত্যা করে। এ প্রসঙ্গটি কোরআনে এভাবে এসেছে, 'আদম (আ.) এর দুই ছেলের বৃত্তান্ত তুমি তাদের যথাযথভাবে শোনাও। যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কবুল হলো না। সে বলল, আমি তোমাকে হত্যা করবই। অপরজন বলল, অবশ্যই আল্লাহ মোত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন। আমাকে হত্যা করার জন্য তুমি হাত তুললেও তোমাকে হত্যা করার জন্য আমি হাত তুলব না; আমি তো জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি। তুমি আমার ও তোমার পাপের ভার বহন করো এবং অগি্নবাসী হও, তাই আমি চাই এবং এটি জালেমদের কর্মফল। অতঃপর তার চিত্ত ভ্রাতৃহত্যায় তাকে উত্তেজিত করল। ফলে সে তাকে হত্যা করল; তাই সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হলো। অতঃপর আল্লাহ একটি কাক পাঠালেন, যে তার ভ্রাতার মরদেহ কীভাবে গোপন করা যায় তা দেখানোর জন্য মাটি খনন করতে লাগল। সে বলল, হায়! আমি কী এ কাকের মতোও হতে পারলাম না, যাতে আমার ভ্রাতার মরদেহ গোপন করতে পারি? অতঃপর সে অনুতপ্ত হলো। এ কারণেই বনি ইসরাইলের প্রতি এই বিধান দিলাম যে, নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করা; হত্যার শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদন্ড ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করল, আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। তাদের কাছে তো আমার রাসুলরা স্পষ্ট প্রমাণ এনেছিলেন; কিন্তু এরপরও তাদের অনেকে দুনিয়ায় সীমালঙ্ঘনকারীই রয়ে গেল। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করে বেড়ায় তাদের জন্য শাস্তি হলো, তাদের হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো হবে বা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদের দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় এটিই তাদের লাঞ্ছনা ও পরকালে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে। তবে তোমাদের আয়ত্তাধীনে আসার আগে যারা তওবা করবে, তাদের জন্য নয়। সুতরাং জেনে রাখো যে, আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।' (সূরা মায়েদাহ : ২৭-৩৪)। ইসলামের শিক্ষা হলো সব মানুষ এক আল্লাহর বান্দা। যারা বিশ্বাসী, তারা অনুগত বান্দা; আর যারা অবিশ্বাসী, তারা পাপাচারী। সব মানুষ একই মা-বাবার সন্তান; সব মানুষ একই রক্তে-মাংসে গড়া; তাই সাদা-কালোয় কোনো প্রভেদ নেই। সব মানুষ আখেরি নবী মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মত। কালেমা পড়া মুসলমান সবাই সমান। কবরে ও হাশরে সবাইকে একই প্রশ্ন করা হবে। কবরে প্রশ্ন করা হবে না, তুমি কি শিয়া ছিলে না কি সুনি্ন ছিলে। প্রশ্ন করা হবে না, তুমি কি হানাফি ছিলে নাকি সালাফি ছিলে। বরং প্রশ্ন করা হবে- তুমি কি বিশ্বাসী মোমিন ছিলে? নাকি অবিশ্বাসী কাফের ছিলে? আরও প্রশ্ন করা হবে, তোমার জীবন পদ্ধতি কী ছিল? এবং মানবতার মুক্তির দূত শান্তির নবী মুহাম্মদ (সা.) এর সঙ্গে তোমার জীবনাচারের কী সম্পর্ক ছিল। প্রশ্ন তিনটি হবে এভাবে- 'মান রব্বুকা, ওয়া মা দ্বীনুকা, ওয়া মান হাজার রজুল।' অর্থাৎ তোমার রব বা প্রভু কে? তোমার ধর্মাচার কী ছিল? এবং এ ব্যক্তি [মুহাম্মদ (সা.)] কে? একমাত্র সঠিক উত্তর হবে- 'রাদিতু বিল্লাহি রব্বাওঁ ওয়া বিল ইসলামে দ্বীনাওঁ ওয়া বি মুহাম্মাদিন (সা.) নাবীয়্যাওঁ ও রসুলা।' অর্থাৎ আমার রব আল্লাহ, আমার দ্বীন-ধর্ম ইসলাম এবং মুহাম্মদ (সা.) আমার নবী ও রাসুল; এতেই আমি সন্তুষ্ট। সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় তিনবার করে এ দোয়া পড়বে (অর্থাৎ উপরোক্ত ঘোষণা দেবে), আল্লাহ তায়ালার ওপর ওয়াজিব (অবধারিত) হয়ে যাবে কেয়ামতের দিন তাকে (জান্নাত দানের মাধ্যমে) খুশি করা এবং তার কবরের সওয়ালের জওয়াব দেয়া সহজ হবে।' (তিরমিজি : ৩৩৮৯)। ইসলামে মানব হত্যার পরকালীন বিধান সম্পর্কে কোরআনে বলা হয়েছে, 'কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মোমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রূষ্ট হবেন, তাকে লানত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।' (সূরা আন নিসা : ৯৩)। আরও সতর্ক করে বলা হয়েছে, 'আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তোমরা তাকে হত্যা করবে না।' (সূরা আনআম : ১৫১)। 'আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তোমরা তাকে হত্যা করো না! কেউ অন্যায়ভাবে নিহত হলে তার উত্তরাধিকারীকে তো আমি তা প্রতিকারের অধিকার দিয়েছি; কিন্তু হত্যার ব্যাপারে সে যেন বাড়াবাড়ি না করে; সে তো সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছে।' (সূরা আল ইসরা/বনি ইসরাইল : ৩৩)। মানব হত্যার জাগতিক বিধান সম্পর্কে কোরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, "হে মোমিনরা! নিহতের ব্যাপারে তোমাদের জন্য 'কিসাস' এর বিধান দেয়া হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তির বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, ক্রীতদাসের বদলে ক্রীতদাস ও নারীর বদলে নারী; কিন্তু তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে কিছুটা ক্ষমা প্রদর্শন করা হলে যথাযথ বিধির অনুসরণ করা ও সততার সহিত তার দেয় আদায় বিধেয়। এটি তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে ভার লাঘব ও অনুগ্রহ। এরপরও যে সীমালঙ্ঘন করে তার জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে।" (সূরা বাকারা : ১৭৮-১৭৯)। ইসলামে মৃত্যুদন্ডের যথার্থ কারণ তিনটি। প্রথমত হলো, কোনো জ্ঞানসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান অন্য কোনো মুসলমানকে বিনা কারণে ও সজ্ঞানে ইচ্ছাকৃতভাবে 'কতল' বা হত্যা করে এবং নিহতের অভিভাবক ও উত্তরাধিকারীরা 'দিয়াত' বা রক্তপণ গ্রহণে সম্মত না হন। দ্বিতীয়ত হলো, কোনো জ্ঞানসম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্ক বিবাহিত মুসলমান যদি বিনা কারণে ও সজ্ঞানে 'জেনা' বা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। তৃতীয়ত হলো, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমান পুরুষ যদি 'মুরতাদ' বা ধর্মত্যাগী হয় এবং বিজ্ঞ পন্ডিত আলেম-ওলামা কর্তৃক তাকে ধর্ম-দর্শন ও ইসলামী বিশ্বাস এবং বিধানের যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা বোঝানোর পরও যদি সে সত্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায় এবং ধর্মের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে। এ তিনটি কারণ ছাড়া অন্য কারণে কোনো মুসলমানকে হত্যা করা কোনোভাবেই বৈধ নয়। ইসলামী শরিয়তের প্রধান উদ্দেশ্য হলো : জীবন, সম্পদ, সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা, জ্ঞান, বংশ ও ধর্ম রক্ষা। এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, শরিয়তের মূল পাঁচটি লক্ষ্যের শেষটি হলো ধর্ম রক্ষা এবং প্রথমটি হলো জীবন রক্ষা; কারণ প্রাণ না থাকলে ধর্ম অচল। আজকাল অনেকেই খুঁটিনাটি কারণে সন্ত্রাস, হত্যা, গুপ্তহত্যাসহ খুনখারাবি করতে দ্বিধাবোধ করেন না। এটা ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলামে জীবন রক্ষার জন্য প্রাণবধের বিধান রয়েছে বটে; কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতে হলে শরিয়া আইন অনুসরণ করতেই হবে। ইসলামী আদালত বা খলিফা কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধি বিচারের দায়িত্ব পালন করবেন। কেউ যদি এমন কোনো অপরাধও করেন, যাতে তার প্রাণ নিধনের বিধান আছে; তবে তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বাস্তবায়ন করা ইসলামসম্মত নয়; বরং তা যথাযথ আদালত ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই শুধু বাস্তবায়নের এখতিয়ার রাখেন। কারণ কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত বিধিবিধান, যা অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থাৎ ব্যক্তির একান্ত নিজের নয়; তথা সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তা কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায় নিজেদের মতো করে বাস্তবায়ন করা শরিয়ত সিদ্ধ নয়; এটি শুধু আদালত ও সরকারের দায়িত্ব। লেখক : যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়