Friday, December 25

যিনি ছিলেন সুমহান চরিত্রের অধিকারী


মাওলানা নাইমুল ইহসান বারকাতী: উসওয়ায়ে হাসানাহ বা উত্তম চরিত্র মানবজীবনে একজন ব্যক্তির সর্বোত্তম সম্পদ। ব্যক্তি জীবনে এ ক্ষেত্রে যার উৎকর্ষতা যত বেশি সমাজ ও রাষ্ট্রে তার মূল্যায়ন ও গ্রহণযোগ্যতা তত বেশি। আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে মানবজাতির সঠিক দিশা প্রদানের নিমিত্ত যেসব মহামানবকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন মানবজাতির কাছে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় করার জন্য, তাদের মধ্যে উসওয়ায়ে হাসানাহ তথা উত্তম চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন। আমাদের পেয়ারা হাবিব হজরত রাসুলে আকরাম (সা.) এর সম্মান ও চরিত্রকে আল্লাহ এভাবে আখ্যায়িত করেছেন 'আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।' (সূরা আল কলম : ৪)। অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, 'নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।' (সূরা আল আহজাব : ২১)। এটি কিন্তু কোনো মামুলি ও সামান্য বিষয় নয়। যেখানে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত এ বিশাল আকাশ, বিস্তীর্ণ ভূম-লকে সামান্য বলে আখ্যায়িত করেছেন, অন্যদিকে আমাদের পেয়ারা নবীর চরিত্রকে 'আজিম' (মহান) বলে আখ্যায়িত করেছেন। এখানে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার প্রিয় হাবিবের উন্নত চরিত্রের সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে স্বীয় পরিচয় উম্মতের কাছে তুলে ধরার নিমিত্ত এবং উম্মতকে সৎচরিত্রের প্রতি উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নিজেও তাঁর আখলাক সম্পর্কে বিভিন্ন বাণী প্রদান করেছেন। যেমন তিনি বলেন, 'আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের জন্য প্রেরিত হয়েছি।' (কানজুল উম্মাল)। মুসনাদে আহমদ, ইমাম বোখারি (রা.)-এর আদাবুল মুফরাদসহ বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে একই অর্থবোধক বর্ণনায় রয়েছে- 'সৎচরিত্রের পূর্ণতা প্রদানের জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি।' একজন ব্যক্তির চরিত্র কেমন তার বর্ণনা সবচেয়ে উত্তমরূপে তার স্ত্রীই দিতে পারেন। বোখারির একটি হাদিসে রয়েছে, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুহাম্মদ (সা.) তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা.) কে হেরা পাহাড়ে ঘটে যাওয়া ওহি ও জিবরাঈল সংক্রান্ত সব কথা বলেন ও ভয়ার্ত চিত্তে বললেন, 'আমি আমার জীবন সম্পর্কে আশঙ্কা করছি।' খাদিজা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, 'আল্লাহর শপথ! তা কখনও হতে পারে না, তিনি আপনাকে অপদস্থ করবেন না। ১. আপনি আত্মীয়তার বন্ধন সংরক্ষণ করেন, ২. আপনি দুস্থ মানুষের বোঝা হালকা করেন, ৩. নিঃস্বদের আহার করান, ৪. অতিথিদের সেবা করেন, ৫. সত্যের পথে নির্যাতিতদের সাহায্য করেন।' একবার হজরত আয়েশা (রা.) কে মহানবীর চরিত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, 'তাঁর চরিত্র ছিল আল কোরআন।' মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) এর জীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও বিশ্বজয়ী উপাদান হলো তার চরিত্র মহিমা। এই চরিত্র মহিমার কারণেই তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে তাবৎ দুনিয়ার সব বিবেকবান মানুষ। বাহ্যিক শত্রুতা পোষণ করেও মনে মনে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েছে অনেকে। মূলত প্রিয় নবীর উত্তম চারিত্রিক দিকটি বিশ্বমানবতাকে সর্বাধিক প্রভাবিত ও আকৃষ্ট করেছে। প্রিয় নবীর চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো তাঁর সাদাসিদে জীবন। একদা ওমর (রা.) আল্লাহর রাসুলের কাছে এলেন, তখন তাকে সাধারণ একটি বিছানায় দেখে বললেন, কায়সার ও কিসরা (রোম ও পারস্যের সম্রাটরা) এমন এমন (অনেক আরামদায়ক) স্থানে ঘুমায়, অথচ আপনি আল্লাহর রাসুল, তবুও আপনি ঘুমান এরকম বিছানায়। আল্লাহর রাসুল বললেন, আমার সঙ্গে দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের কীসের সম্পর্ক? আমি তো এখানে পথিকের মতো, যে গাছের ছায়া গ্রহণ করে, অতঃপর তা ছেড়ে চলে যায়।' (তিরমিজি)। একবার বদর প্রান্তরে আল্লাহর রাসুল স্বীয় হস্তে বিদ্যমান লাঠি দ্বারা সৈন্যদের কাতার সুবিন্যস্ত করেন, এ সময় ছাওয়াদ বিন গাজিয়াহ কাতারের বাইরে থাকার কারণে তার পেটে লাঠি দ্বারা খোঁচা মেরে বললেন, হে ছাওয়াদ, সোজা হয়ে দাঁড়াও। সে বলল, হে আল্লাহর রাসুল আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন অথচ আল্লাহ আপনাকে হক ও ইনসাফ সহকারে প্রেরণ করেছেন। আপনি আমাকে আপনার কাছ থেকে কিসাস (প্রতিশোধ) নেয়ার সুযোগ করে দিন। একথা শুনে আল্লাহর রাসুল সন্তুষ্ট চিত্তে নিজের পেট খুলে দিলেন এবং বললেন, হে ছাওয়াদ! তুমি আমার কাছ থেকে কিসাস নিয়ে নাও। কিন্তু ছাওয়াদ তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং তাঁর পেটে চুমু খেলেন। আল্লাহর রাসুল বললেন, হে ছাওয়াদ তুমি এরকম কেন করলে? উত্তরে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি যা দেখছেন (যুদ্ধ) তা একেবারে সনি্নকটে, অতএব, আমার ইচ্ছা হচ্ছে, আমার চামড়া আপনার চামড়ার সঙ্গে স্পর্শ হওয়া যেন আপনার সঙ্গে শেষ মিলন হয়। এ কথা শ্রবণে আল্লাহর রাসুল তার কল্যাণের দোয়া করলেন। মোট কথা, আল্লাহর রাসুলের চরিত্র ছিল পূতঃপবিত্র। এর মধ্যে বিন্দুমাত্র ত্রুটি বা কলঙ্কের অবকাশ ছিল না। তাঁর জীবনের প্রতিটি দিকই ছিল সব কালের, সব যুগের শ্রেষ্ঠতম আদর্শ। একজন মানুষের মধ্যে যেসব উত্তম গুণাবলি থাকতে পারে তার সবক'টি তাঁর মধ্যে সর্বোত্তমরূপে সনি্নবেশিত হয়েছিল। সততা, সত্যবাদিতা, আমানতদারী, আতিথেয়তা, অঙ্গীকার পালন, পারস্পরিক দায়িত্ববোধ, ন্যায়পরায়ণতা, দয়া, উদারতা, নির্ভীকতা, বিনয়-নম্রতা, মমত্ববোধ, মহানুভবতা ইত্যাকার সব গুণাবলিই তাঁর জীবনীতে উত্তমরূপে প্রস্ফুটিত হয়েছিল। তাঁর চরিত্র কেয়ামত পর্যন্ত গোটা মানবজাতির জন্য অনুসরণীয়, অনুকরণীয়। মানবতার গৌরব হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্যের কথা বলে শেষ করা যায় না। এমন মহামানব পৃথিবী একবারই পেয়েছে। তাঁর আগে কখনও পায়নি। অনাগত মহাকালেও পাবে না। ফারসি কবি শেখ সাদীর ভাষায় 'বা'দ আয খোদা তু বুজুর্গ, কেচ্ছা ইঁ মুখতাছার' 'খোদার পরে তুমিই মহান সংক্ষেপে মোরা এ-ই জানি।'

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়