মুফতি দিদার শফিক:
কথায় বলে, দুর্নীতি রকেটগতিতে বেড়েই চলছে। কারণ কী? নীতিনৈতিকতা, ধর্মীয় অনুশাসন, সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ইসলামী মহামনীষী, নবী-রাসুলের জীবনমাধুর্য প্রায়োগিক জীবনে চর্চিত ও অনুসৃত না হওয়ায় নানা সঙ্কট ও দুর্নীতি মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলছে। হালে মানুষ অল্পে তুষ্টির অপার্থিব স্বস্তি লাভ থেকে বঞ্চিত। ক্রমে হয়ে উঠছে খাই-খাই, নাই-নাই স্বভাবের। সবার কাঁধে জেঁকে বসেছে সম্পদের মোহ। বৃদ্ধি পাচ্ছে অল্প সময়ে অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ার মানসিকতা, লিপ্সা। স্বাভাবিক বিষয় অস্বাভাবিকভাবে পেতে গেলে ছন্দপতন ঘটে। এ ছন্দপতনই সমাজে দুর্নীতি হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। দ্রুতগতিতে সম্পদ বাড়ানোর মানসিকতা অসদুপায়ে অর্থ উপার্জনের পথ উন্মোচিত করে, যা অযাচিত, বর্জিত। বোদ্ধামহলে ঘৃণিত, গর্হিত। সুস্থ সমাজে প্রাণনাশক বিষবাষ্প। অল্পে তুষ্টি, পরোপকার ও জনহিতৈষী চেতনার বীজ হৃদয়ের গভীরে বপিত হলে, হালাল রিজিক অন্বেষণ ও হারাম উপার্জন থেকে নিজেকে নিবৃত্তকরণ স্বভাবে পরিণত হলে।' দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রয়োজন হবে না। এমনিতেই দুর্নীতি বিদায় নেবে। হালাল খাদ্য গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আল্লাহ তোমাদের যে হালাল ও উৎকৃষ্ট জীবিকা দিয়েছেন তা থেকে ভক্ষণ করো এবং ভয় করো আল্লাহকে, যার প্রতি তোমরা বিশ্বাসী।' (সূরা মায়েদা : ৮৮)।
ঘুষ ছাড়া অফিস-আদালতে টেবিলের ফাইল টেবিলেই পড়ে থাকা জনজীবনে দুর্ভোগের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। অথচ সুদ-ঘুষ গ্রহণ করাকে কোরআনে আল্লাহ নিকৃষ্ট বলে অভিহিত করেছেন। আল্লাহ বলেন, 'তাদের অনেককেই তুমি দেখবে পাপ, সীমালঙ্ঘন ও অবৈধ (অবৈধ উপায়ে লব্ধ বস্তু; সুদ, ঘুষ প্রভৃতি) ভক্ষণে তৎপর; তারা যা করে নিশ্চয় তা নিকৃষ্ট।' (সূরা মায়েদা : ৬২)। চাকরিজীবীর অফিস টাইম, অর্থের বিনিময়ে শ্রমিকের নির্ধারিত সময়ে শ্রমদান আমানত। এ আমানত রক্ষা করা হলে জান্নাতুল ফেরদাউস হবে চিরনিবাস। আল্লাহ বলেন, 'যারা নিজেদের আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে এবং যারা নিজেদের সালাতে যত্নবান থাকে তারা হবে অধিকারী; অধিকারী হবে ফেরদাউসের, যাতে তারা স্থায়ী হবে।' (সূরা মোমিনুন : ৮-১১)।
কলমের খোঁচা, লাঠি-খুঁটি- বাহুবল-পেশিশক্তির অপপ্রয়োগেও শোঁ শোঁ করে বয়ে যায় দুর্নীতির বাতাস। সবলের জোর-জুলুম। দুর্বলের কান্না, বঞ্চনা। এটিই আজ সমাজের বাস্তব চিত্র। কালো টাকার লোভে প্রলুব্ধ হয়ে নীতিনৈতিকতা বিসর্জন দিচ্ছে দাপুটে মহল। সাহায্য করছে অন্যায় ও অসঙ্গত কাজে। মন্দ কাজে সমর্থন, সহায়তা চরম দুর্নীতি। মন্দকাজে সাহায্য বর্জন এবং ভালো কাজে সাহায্যের হাত সম্প্রসারণ দুর্নীতি দমনে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখে। মন্দ কাজে বারণ এবং ভালো কাজে উৎসাহিত করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'সৎকর্ম ও তাকওয়ায় (আল্লাহভীতিতে) তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর।' (সূরা মায়েদা : ২)।
পঞ্চায়েত, সালিশি বৈঠক, বিচারালয়ের প্রহসন, পক্ষপাতদুষ্টতায় অতিষ্ঠ মানুষ। প্রকৃত অপরাধীকে শাস্তি প্রদানে ছাড় না দেয়া। বিচারকার্যে পাপীর প্রতি সদয় না হওয়া কোরআনের দাবি। ব্যভিচারী নারী-পুরুষকে শাস্তি প্রদানে দয়া যেন প্রতিবন্ধক না হয়। অন্যায়ে যেন প্রশ্রয় দেয়া না হয়। সে দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, 'ব্যভিচারী ও ব্যবিচারিণী তাদের প্রত্যেককে ১০০ কষাঘাত করবে (অবিবাহিত ব্যভিচারীর জন্য এ শাস্তি, বিবাহিত ব্যভিচারীর শাস্তি প্রস্তর নিক্ষেপে মৃত্যুদ-) আল্লাহর বিধান কার্যকরে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদের প্রভাবান্বিত না করে।' (সূরা নূর : ২)। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ সম্ভব। বিচারিক রায় নিজের, আপনজনের, দলীয় মানুষের বিপক্ষে গেলেও সঠিক রায় প্রকাশ করা কোরআনের দাবি। স্বার্থ বা রক্তের টানে 'সাত খুন মাফ'_ জাতীয় কোনো বক্তব্যের স্থান নেই কোরআনে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'হে মোমিনরা! তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় থাকবে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ। যদিও তা তোমাদের নিজেদের, অথবা মা-বাবা এবং আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়; সে বিত্তবান (যার বিচার করা হয়) হোক বা বিত্তহীন হোক আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হইও না। যদি তোমরা পেঁচানো কথা বলো অথবা পাশ কাটিয়ে যাও (ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে) তবে তোমরা যা করো আল্লাহ তো তার সম্যক খবর রাখেন।'মিথ্যা সাক্ষ্যদান বাণিজ্যিক রূপ পেলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।
সত্য সাক্ষ্যদান ও ন্যায়বিচারের জোর নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, 'হে মোমেনরা! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে; কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন কখনও সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে, সুবিচার করবে, এটি তাকওয়ার (আল্লাহভীতির) নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় করবে। তোমরা যা করো নিশ্চয় আল্লাহ তার সম্যক খবর রাখেন।' (সূরা মায়েদা : ৮)।
জোরপূর্বক অন্যের জমি দখল, সম্পদ ভোগ, অর্থ আত্মসাৎ মারাত্মক গোনাহ।
চূড়ান্ত মাত্রার দুর্নীতি। এ দুর্নীতিরোধে আল্লাহ বলেন, 'হে মোমিনরা! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কিন্তু তোমাদের পরস্পর রাজি হয়ে ব্যবসায় করা বৈধ এবং একে অপরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু। আর যে সীমালঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তাকে অগি্নতে দগ্ধ করব, এটি আল্লাহর পক্ষে সহজ।' (সূরা নিসা : ২৯-৩০)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, 'তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিয়দংশ জেনে-শুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকদের কাছে পেশ করো না।' (সূরা বাকারা : ১৮৮)।
স্ত্রীর মন পেতে, সন্তান-সন্ততির সঙ্গতিপন্ন জীবনযাপনের উপকরণ জোগাতে, যারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, তাদের মনে রাখা উচিত, কেয়ামতের মাঠে প্রিয়জন কেউ তার এ পাপের ভার বহন করবে না। কোরআনে আল্লাহ বলেন, 'কেউ (কোনো বহনকারী) অপরের (পাপের) বোঝা বহন করবে না। আর মানুষ তাই পায়, যা সে করে। আর তার কর্ম অচিরেই দেখানো হবে। আর তাকে দেয়া হবে পূর্ণ প্রতিদান।' (সূরা নাজম : ৩৯-৪০)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া
ইসলামবাগ, ঢাকা
খবর বিভাগঃ
ইসলাম
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়