Tuesday, December 8

মানব জীবনের নিরাপত্তায় ইসলাম


আহনাফ আবদুল কাদির: ইসলাম মানবজীবনের নিরাপত্তা বিধানে একটি সুরক্ষিত দুর্গের ভূমিকা পালন করে। মানুষের মৌলিক অধিকারের সর্বোচ্চ দিক হচ্ছে নিজ জীবনের নিরাপত্তা। জীবনের নিরাপত্তা বিঘি্নত হলে পৃথিবীতে সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করবে এবং মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হবে। তাই ইসলাম মানবজাতির জীবনের নিরাপত্তা প্রদানে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র মানবজাতিকে একই বন্ধনে আবদ্ধ করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ঐক্য, সংহতি ও নিরাপত্তার বিধান নিশ্চিত করেছে। পবিত্র কোরআন মাজিদে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন, 'হে মানবজাতি তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের দাসত্ব করো যিনি তোমাদের একই আত্মা থেকে সৃষ্টি করেছেন।' (সূরা নিসা : ১)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, 'মানুষ আদিতে একই জাতি ছিল। অতঃপর তারা মতানৈক্য সৃষ্টি করে বিভক্ত হয়ে গেল।' (সূরা ইউনুস : ১৯)। মহান আল্লাহ প্রদত্ত এ জাতিগত সম্প্রীতির কথা ভুলে গিয়ে মানুষই আজ মানুষের নিরাপত্তাহীনতার একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার ফলে তুচ্ছ কারণে একে অপরকে হত্যা করছে। প্রকাশ্য কিংবা রাতের অাঁধারে কেড়ে নিচ্ছে একজন অপরজনের প্রাণ। অথচ হত্যা তো দূরের কথা, ইসলাম বিনা অনুমতিতে কারও বাসস্থান ও গৃহে প্রবেশ পর্যন্ত নিষেধ করে দিয়েছে। আল কোরআনের ভাষায়, 'হে ঈমানদাররা তোমরা নিজেদের বাসস্থান ব্যতীত অন্যের বাসস্থানে অনুমতি না নিয়ে কিংবা গৃহে অধিবাসীদের সালাম না দিয়ে প্রবেশ করো না।' (সূরা নুর : ২৭)। কেউ ভিন্ন মত বা ভিন্ন পথের অভিযাত্রী হলেই যে তাকে মেরে ফেলতে হবে এ বিধান ইসলামে নেই। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'নরহত্যা বা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যতীত কোনো ব্যক্তি যদি অপর কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করে তবে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানব সম্প্রদায়কে হত্যা করল, আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবতার জীবন রক্ষা করল।' (সূরা মায়িদা : ৩২)। কেউ মৃত্যুদ- পাওয়ার মতো অপরধ করলে যথাযথ প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে তার শাস্তি প্রয়োগ করবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রাষ্ট্রনায়ক হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে ন্যায়বিচারের নির্দেশ প্রদান করে বলেন, 'বলো! আমার প্রভু আমাকে ন্যায়বিচার করার নির্দেশ প্রদান করেছেন।' (সূরা আরাফ : ২৯)। সঙ্গে সঙ্গে যারা প্রাণনাশ এবং নিরাপত্তা বিঘি্নত করার কাজে লিপ্ত তাদের বিচারের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করার আদেশ দেয় ইসলাম। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর বাণী, 'হে ঈমানদাররা! তোমাদের প্রতি নিহতদের ব্যাপারে কিসাস গ্রহণ করা বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তি স্বাধীন ব্যক্তির পরিবর্তে, দাস দাসের পরিবর্তে এবং নারীর পরিবর্তে নারী।' (সূরা বাকারা : ১৮৪)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, 'আমি এ গ্রন্থে তাদের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চক্ষুর বিনিময়ে চক্ষু, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং জখমগুলোর বিনিময়ে সমান জখম। অতঃপর যে ক্ষমা করে, সে গোনাহ থেকে পাক হয়ে যায়। যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না তারাই জালেম।' (সূরা মায়িদা : ৫৪)। মানুষের জীবনের মর্যাদা সম্পর্কে রাসুল (সা.) বিদায় হজের ভাষণে দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, 'হে লোক! তোমাদের কারও জানমাল, ইজ্জত আব্রুর ওপর হস্তক্ষেপ করা তোমাদের জন্য হারাম করা হলো। তোমাদের আজকের এ দিন, এ (জিলহজ) মাস, এ শহর (মক্কা) যেমন পবিত্র ও সম্মানিত অনুরূপভাবে উপরোক্ত জিনিসগুলোও সম্মানিত ও পবিত্র। সাবধান আমার পরে তোমরা পরস্পর পস্পরকে হত্যা করে কাফেরদের দলভুক্ত হয়ে যেও না।' (বোখারি : ৬৭; মুসলিম : ১২১৮)। শুধু মুসলিম নয়, অমুসলিমদের জীবনের নিরাপত্তাও দিয়েছে ইসলাম। এ সম্পর্কে বিশ্বের সফল রাষ্ট্রনায়ক মুহাম্মদ (সা.) বলেন, 'যে ব্যক্তি কোনো জিম্মিকে হত্যা করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।' (সুনানুন নাসাঈ : ৪৭৪৭)। তিনি আরও বলেন, 'যে ব্যক্তি মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসরত কোনো অমুসলিমকে হত্যা করে সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না।' (বোখারি : ৩১৬৬)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, 'নবী (সা.) এর যুগে একটি মৃতদেহ পাওয়া গেল, কিন্তু হত্যাকারীর কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। মহানবী (সা.) চরম অসন্তুষ্ট অবস্থায় ভাষণ দিতে গিয়ে বললেন, হে লোক সবাই! ব্যাপার কী, আমি তোমাদের মাঝে বর্তমান আছি অথচ মানুষ নিহত হচ্ছে এবং হত্যাকারীর পরিচয়ও মিলছে না? জেনে রেখো! একজন মানুষ হত্যা করার জন্য যদি আসমান-জমিনের সব একত্র হয়ে যায় তবুও আল্লাহ এদের সবাইকে শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দেবেন না।' (তাবরানি)। মক্কা বিজয়ের পর রাসুল (সা.) ইসলামের চিরশত্রুদের হাতের নাগালে পেয়েও কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। কাবার প্রাঙ্গণে সমবেত জনতার উদ্দেশে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, 'হে কোরাইশরা! আমি তোমাদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করব বলে তোমরা আশা করো?' সবাই বলে উঠল, 'উত্তম আচরণ। আপনি দয়ালু ভাই ও দয়ালু ভাইয়ের ছেলে।' রাসুল (সা.) বললেন, 'শোন! আমি তোমাদের সেকথাই বলছি, যেকথা ইউসুফ তার ভাইদের বলেছিলেন, 'তোমাদের প্রতি আজ আমার আর কোনো অভিযোগ নেই।' (সূরা ইউসুফ : ৯২)। যাও তোমরা সবাই মুক্ত-স্বাধীন।' (আল-বিদায়াহ : ৪/৩০১; সিরাতু ইবনে কাছির : ৩/৫৭০; ফিকহুস সিডরাহ : ১/৩৮২)। বিশিষ্ট সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) কাউকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করাকে অপছন্দ করতেন। তিনি বলতেন, 'যতদূর সম্ভব মুসলমানকে (নাগরিক) বেত্রাঘাত ও মৃত্যুদ- থেকে অব্যাহতি দাও।' (বায়হাকি, মুছান্নাফ ইবনু আবি শায়বা, ইরওয়াউল গালিল হা : ২৩৫৫)। কিন্তু সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার এ যুগেও ইসলামের এসব শান্তির বার্তাকে উপেক্ষা করে কিছু মানুষ অশান্তি ও অরাজকতায় মত্ত হয়ে দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলের নিমিত্তে অবলীলায় মানুষের জীবনকে নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ব্যক্তিগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে মানুষরূপী হায়েনারা মানুষকে হত্যা করছে। নিরাপত্তা বিধানে দায়িত্বরত নিরাপত্তাকর্মীরাই রয়েছে অনিরাপত্তায়। এ অবস্থায় আল্লাহ প্রদত্ত শাশ্বত জীবন বিধানের পরিপূর্ণ অনুসরণই মানবজীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, যেমন পেরেছিলেন মানবতার মহান বন্ধু বিশ্বশান্তির অগ্রদূত বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়